যে মানুষ আমি সেই মানুষ তুমি

থাকা সত্ত্বেও সমাজে তাদের ভূমিকা স্বীকৃতিহীন। মেধা আর শ্রমে, আত্মত্যাগ আর বাৎসল্যে এই সমাজের চাকাকে সচল রাখার সব গৌরব মিথ্যা হয়ে যায় নারীর, শুধু নারী হয়ে জন্ম নেয়ার কারণে। নারীর জীবন ও মর্যাদা, তার মানবাধিকার যে পুরুষের চেয়ে কর্ম আমাদের প্রতিদিনের অভ্যাসে তা পরিস্ফুট হয়ে ওঠে প্রতিনিয়ত। জন্মের পর থেকেই মেয়েরা অবমূল্যায়ন ও অমর্যাদার শিকার হয়। হিন্দু শাস্ত্রকার মনু বলে গেছেন : ‘নারী কুমারীকালে পিতার, যৌবনে স্বামীর ও বার্ধক্যে পুত্রের তত্ত্বাবধানে থাকবে। নারী কখনোই স্বাধীন থাকার উপযুক্ত নয়।’ খ্রিস্টান ধর্মযাজক জন পলের বক্তব্য হচ্ছে : ‘নারী পরাধীন থেকে নীরবে শিক্ষালাভ করুক, তারা চুপচাপ থাকুক। তারা যে শেখাবে অথবা পুরুষের ওপর কর্তৃত্ব করবে আমি তা সহ্য করব না।’ চীনা দার্শনিক কনফুসিয়াস নারীকে দেখেছেন দেহসর্বস্ব এক প্রাণীরূপে। তার মতে : ‘নারী কেবলই এক দেহমাত্র।’ আর গ্রিক দার্শনিক প্লেটো তুষ্ট থেকেছেন এই বলে : ‘ঈশ্বরকে ধন্যবাদ তিনি আমাকে এথেন্সবাসী করেছেন, বর্বর করেননি; ক্রীতদাস বা স্ত্রীলোক করেননি।’

বিশ্বের অধিকাংশ স্থানে দাসপ্রথা অবসানের দীর্ঘকাল পরও অনেক সমাজ মেয়েদের প্রতি এখনও এমন আচরণ করে যেন তারা ব্যক্তিগত অস্থাবর সম্পত্তি। তাদের বেড়ি হচ্ছে নগণ্য শিক্ষা, অর্থনৈতিক নির্ভরশীলতা, সীমিত রাজনৈতিক ক্ষমতা, প্রজনন ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণের সীমিত সুযোগ, কঠোর সামাজিক প্রথা ও আইনের চোখে অসমতা। আর নারীদের হাতে-পায়ে এসব বেড়ি পরিয়ে রাখার জন্য সহিংসতাকে মূল হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়। বিশ্বের নারী জাতির বিরুদ্ধে সহিংসতার দ্বার অর্গলমুক্ত রাখার ব্যাপারটি যেন এমন একটি বিশাল কালো প্রকোষ্ঠের চৌকাঠে দাঁড়ানো, যার ভেতরটা সম্মিলিত যন্ত্রণায় প্রকম্পিত হচ্ছে। এ যন্ত্রণা যে কতটা প্রকট তা উপলব্ধি করা যাবে এই পরিসংখ্যানের দিকে চোখ ফেরালে যেখানে বিশ্বে প্রতি ছয় মিনিটে একজন নারী ধর্ষিত হয়, প্রতি আট সেকেন্ডে একজন নারী শারীরিকভাবে নির্যাতিত হয়।

উন্নয়নশীল দেশগুলোতে নারীর প্রতি সহিংস আচরণের বেশির ভাগই সামাজিক বিন্যাসের ধারা হিসেবে স্বীকৃত ও সমর্থিত। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, অনেক দেশেই বউ পেটানোকে একটি স্বাভাবিক নিয়ম হিসেবে বিবেচনা করা হয় যা পুরুষোচিত বিশেষ অধিকার হিসেবে গান, প্রবাদ ও বিবাহ অনুষ্ঠানে সোল্লাসে বর্ণিত হয়। যুক্তরাষ্ট্রের মতো শিল্পোন্নত সমাজে, যেখানে এর আগে নারী নির্যাতনের বিষয়টির প্রতি ভ্রুকুটি করা হয়েছে, সেখানে নারী নির্যাতনের সত্যিকার চিত্র সরকারি ঘোষণাকে ভ্রান্ত প্রতিপন্ন করেছে। এই দেশে প্রতি ছয় মিনিটে একজন নারী ধর্ষিত হয়, যাদের প্রতি পাঁচজন পূর্ণ বয়স্ক নারীদের একজন। এ ছাড়া এখানে প্রতি ১৫ সেকেন্ডে একজন নারী শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়। মধ্যপ্রাচ্য ও লাতিন আমেরিকার কোন কোন দেশের আদালতে ‘ইজ্জত রক্ষা’র বিষয়টি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পরিগ্রহ করেছে, যাতে কোন মেয়েকে খুন করার পর পিতা বা স্বামীকে সেই খুনের শাস্তি থেকে অনায়াসে রেহাই পাওয়ার সুযোগ দেয়া হয়েছে। লাতিন আমেরিকার ১২টি দেশে ধর্ষিতাকে বিয়ের প্রস্তাব দিলে এবং সে তাতে সম্মত হলে ধর্ষণকারীকে অভিযোগ থেকে রেহাই দেয়া হয়। নারীর চেহারা বিকৃত করার জন্য বাংলাদেশে এসিড নিক্ষেপ এমন সচরাচর ঘটনা যে, দণ্ডবিধিতে একটি স্বতন্ত্র ধারা হিসেবে এটিকে সংযোজন করার প্রয়োজন হয়ে পড়ে। বেশির ভাগ নারী নির্যাতনই শুধু যে শাস্তি এড়িয়ে যায় তা নয়, বরং তা নীরবে সহ্যও করা হয়। আর এই নীরবতা সমাজের, এই নীরবতা নির্যাতিতার।

আজকের লাখ লাখ নারীর জন্য ঘর হচ্ছে একটি ত্রাসের কেন্দ্র। নারীরা অপরিচিতজনের হামলাকে যতটা না ভয় পায় তার চেয়ে বেশি ভয় পায় আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব ও প্রেমিকের প্রতিদিনকার নৃশংসতাকে। বাড়িতে শারীরিক নির্যাতন নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতার সবচেয়ে সর্বজনীন একটি ধরন এবং প্রজনন-বয়সী নারীর জখম হওয়ার তা প্রধান কারণ। অপরাধসংক্রান্ত পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, বেশির ভাগ ধর্ষিত নারী অপরাধীদের চেনেন, যেমন খুন হওয়া ৪০ ভাগ নারী তাদের চেনা-জানা লোকের হাতে নিহত হন। বস্তুতপক্ষে পারিবারিক সহিংসতা বেদনাদায়কভাবে একটি সাধারণ ব্যাপার। এই সহিংসতার ক্ষেত্রে শিক্ষা, শ্রেণী, আয় ও জাতিগত সীমানা কোন বাধা হয় না। শিল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল দেশে পরিচালিত একটি জরিপ বিশ্লেষণ করে বিশ্বব্যাংক দেখিয়েছে, সব নারীর এক-চতুর্থাংশ থেকে অর্ধেকই অন্তরঙ্গ সঙ্গীর হাতে দৈহিক নির্যাতন ভোগ করেছে। দেশে দেশে সঠিক তুলনামূলক বিচার করার মতো যথেষ্ট উপাত্ত এখন পর্যন্ত না পাওয়া গেলেও পারিবারিক সহিংসতার বিদ্যমানতা এবং তার ধরন এক সংস্কৃতি থেকে আরেক সংস্কৃতিতে উল্লেখযোগ্যভাবে সাদৃশ্যপূর্ণ। শিল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল সমাজে ধর্ষণসংক্রান্ত প্রাপ্ত উপাত্তের মধ্যে আশ্চর্য সাদৃশ্য পরিলক্ষিত হয়। অনেক মানদণ্ডের বিচারে ভিন্ন এই দুই সমাজের নারী এ ধরনের নিয়তির মুখোমুখি হয়। যৌন ও দৈহিক হামলাকে ঘরের বাইরের অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হলেও বেশির ভাগ দেশের আইনই পারিবারিক গণ্ডির ভেতরের হামলা সম্পর্কে নীরব।

ইতিহাসজুড়ে দাসত্ব থেকে শুরু করে নারীকে শৃংখলিত করা পর্যন্ত ঘৃণ্য অনেক প্রথার যথার্থতা প্রতিপন্ন করার জন্য সংস্কৃতির আশ্রয় নেয়া হয়েছে। সব সমাজে দারিদ্র্য, বৈষম্য, অজ্ঞতা আর সামাজিক অস্থিরতা নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতার সাধারণ পূর্বাভাস। নারীর মর্যাদা ও নিরাপত্তার ঘোরতর শত্র“ হল পূত-পবিত্র ঐতিহ্যের নামে সাংস্কৃতিক শক্তিগুলো। বছরে প্রায় ২০ লাখ মেয়ের যৌনাঙ্গচ্ছেদের ঘটনাটিকে এই প্রথার সমর্থকরা, যাদের অনেকেই নারী, একটা ঐতিহ্যগত সাংস্কৃতিক রেওয়াজ হিসেবে দেখে থাকেন, যাতে বাইরের লোকের মাথা ঘামানোর কিছু নেই। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এটি মানবাধিকারের গুরুতর লংঘন এবং জনস্বাস্থ্যের জন্য একটি অভিশাপ, যা সব সাংস্কৃতিক সীমা অতিক্রম করে।

আমাদের সমাজে নারীর অবস্থান সম্পর্কে এক সরকারি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে নারী নির্যাতন ক্রমবর্ধমান নিত্যদিনকার ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। দৈহিক ও মানসিক নির্যাতন, ধর্ষণ, যৌতুকের জন্য নারী হত্যা, নারী ও মেয়েশিশুর প্রতি এসিড নিক্ষেপ, বলপূর্বক অসামাজিক কার্যকলাপে লিপ্ত করা এবং অন্যান্য নারী নির্যাতনমূলক অপরাধ প্রতিনিয়ত ঘটছে। জনগণ নিজ নিজ পরিবারের মেয়েদের নিয়ে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। ঘরে বা ঘরের বাইরে নারী নির্যাতন, ভীতি ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে যথাসময়ে যথোপযুক্ত বিচার না হওয়ায় মহিলাদের জীবন অত্যন্ত ভীতিপদ ও অনিশ্চিত হয়ে উঠেছে এবং এই ভীতি নারী-পুরুষের সমতা অর্জনের পথে বাধা হিসেবে কাজ করছে। পরিণতিতে জাতীয় উন্নয়নের প্রচেষ্টাও সামগ্রিকভাবে বিলম্বিত হচ্ছে। নির্যাতন ও হয়রানির ভয় নারীর সামগ্রিক গতিশীলতার পথে একটি স্থায়ী বাধা। এ বাধা উন্নয়ন ও মূল কর্মধারার সঙ্গে তাদের সম্পৃক্ত হওয়ার ক্ষেত্রকে সংকুচিত করে তোলে।

বাংলাদেশে নারী উন্নয়নের ধারণাকে সামনে রেখে নারী ও শিশুবিষয়ক একটি পৃথক মন্ত্রণালয় সৃষ্টি করা হয়েছে। পাশাপাশি মহিলাবিষয়ক অধিদফতর এবং বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা সংস্থা নারী উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছে। শুধু রাষ্ট্রীয় পর্যায়েই নয়, আন্তর্জাতিক পর্যায়েও নারী অধিকার ও উন্নয়ন আন্দোলনের অংশীদার হিসেবে বাংলাদেশ জাতিসংঘ ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সম্মেলন এবং কনভেনশনে অংশগ্রহণ ও সমর্থন প্রদান করেছে।

নারীর ওপর সহিংস নিপীড়নের বিষয়টি যে পরিবর্তনের অতীত, তা নয়। জাতিগত বিদ্বেষের মতোই এটি ক্ষমতার একটি নির্মাণ, যা পরিবর্তন করা সম্ভব। কিন্তু এটি যেহেতু এতকাল ধরে পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি সংস্কৃতিতে গভীরভাবে প্রোথিত হয়ে আছে তাই এসব সামাজিক কাঠামো ভেঙে ফেলতে সৃজনশীলতা, ধৈর্য এবং নানা দিক থেকে ব্যবস্থা গ্রহণ প্রয়োজন। নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা বন্ধ করতে হলে শুধু আলাদাভাবে সহিংস কাজের জন্য শাস্তির বিধান করলেই চলবে না, বরং এই ধারণাটির পরিবর্তন করতে হবে যে, নারীর মূল্য মৌলিকভাবে পুরুষের চেয়ে কম। নারী যখন পুরুষের মতো একইরকম শক্তিশালী ও সমমর্যাদাসম্পন্ন সদস্য হিসেবে সমাজে জোরালো অবস্থান লাভ করবে তখনই তাদের বিরুদ্ধে সহিংসতাকে একটি অদৃশ্য রীতির পরিবর্তে একটি দুঃখজনক বিচ্যুতি হিসেবে গণ্য করা হবে। একটি পদক্ষেপের মধ্য দিয়ে দীর্ঘতম যাত্রাটির সূচনা হয় বলে প্রাচীন যে প্রবাদটি রয়েছে এখানে তা প্রযোজ্য। নারীর অধিকার রক্ষা এবং তার বিরুদ্ধে সহিংসতার রূপটি তুলে ধরার প্রণালীবদ্ধ প্রয়াসে প্রতিটি সমাজের প্রতিটি খাত যেমন বিচারব্যবস্থা, সংবাদমাধ্যম, শিক্ষাবিদ, গবেষক, সমাজকর্মী, স্বাস্থ্যসেবা কর্তৃপক্ষ, রাজনীতিবিদ, ধর্মীয় নেতা, সরকারি ও বেসরকারি সংস্থা এবং অবশ্যই ব্যক্তি নারী ও পুরুষকে অন্তর্ভুক্ত থাকতে হবে। এটি আজ ব্যাপকভাবে স্বীকৃত যে, নারী উন্নয়নে বিনিয়োগ অবশেষে পুরো দেশের জন্য উচ্চ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, উন্নততর স্বাস্থ্য এবং উচ্চশিক্ষার প্রসারের দিকেই চালিত হয়। তাই নারীকে পশ্চাতে রেখে, নারীকে অন্ধকারে রেখে কোন জাতির পক্ষেই কাক্সিক্ষত উন্নয়নচূড়ায় আরোহণ করা সম্ভব নয়।

নারীকে নারী হিসেবে নয়, একজন মানুষ হিসেবে উন্নয়ন সহযোগীর ভূমিকায় তার অংশগ্রহণকে নিশ্চিত করার মাধ্যমে এই সত্য প্রতিষ্ঠিত করতে হবে প্রথমত এবং প্রধানত নারী একজন মানুষ যেমন মানুষ একজন পুরুষ। কেবল এই সত্য, এই বাস্তবতা অনুধাবনের মধ্য দিয়েই এমন এক আদর্শ সমাজব্যবস্থার বিনির্মাণ সম্ভব, যার স্বপ্ন দেখে এই দেশের, এই বিশ্বের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ।