শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত বেঁদে পল্লীর শিশুরা

কোন ব্যবস্থা, বিদ্যুতের আলো থেকে রয়েছি বঞ্চিত। নির্ধারিত কোন কবরস্থানের ব্যবস্থা না থাকায় এই পল্লীর কেউ মারা গেলে গ্রামের এ বাড়ি ওই বাড়ি ঘুইরা সাড়ে তিনহাত মাটি কিইন্না মরা মানুষটারে মাডি দ্যাওয়া লাগে। প্রায় এক কিলোমিটার দুরে স্কুল। যাতায়াত ব্যবস্থা অত্যন্ত খারাপ হওয়ায় এতোদুর হাইট্টা যাইয়া ছোট্ট ছোট্ট পোলাপাইনেরা পড়া ল্যাহা করতে চায়না। ভোট আইলেই খালি ন্যাতারা আহে মোগো ধারে ভোট চাইতে। ভোটের পর আর কেউর দ্যাহা মেলেনা। এই পল্লীতে দুই’শ ভোটার থাকা সত্বেও ১৫ বছরে সরকারি ভাবে মোরা কোন সাহায্য সহানুভুতি পাইনায়। আল্লায়ই মোগো ছোট জাতের মানুষ কইরা দুইন্নাতে পাঠাইছে। হেইয়ার লাই¹া সব খানেই মোরা অবহেলিত”।

আবেগ আপ্লুত হয়ে কথাগুলো বলছিলেন, আড়িয়াল খাঁ নদীর শাখা পালরদী নদীর তীরবর্তী বরিশালের গৌরনদী পৌরসভার ২ নং টরকীরচর ওয়ার্ডে দীর্ঘ ১৫ বছরের স্থায়ী বেঁদে পল্লীর সর্দার মোঃ নান্নু মিয়া। এ কথাশুধু সর্দার নান্নু মিয়ার একারই নয় একইভাবে জানালেন ওই পল্লীর বাসিন্দা লালন সরদার, জাহাঙ্গীর হোসেনসহ একাধিক বাসিন্দারা। বর্তমানে ওই পল্লীতে প্রায় ছয়’শ লোকের বসবাস।  

সরেজমিনে বেঁদে পল্লীর বাসিন্দাদের সাথে কথাবলে জানা গেছে, ওই পল্লীতে বসবাসরত বেঁদে পরিবারের সদস্যদের এক সময় কোনস্থায়ী ঠিকানা কিংবা বসবাস ছিলো না। তারা বাংলাদেশে বসবাস করেও কোন এলাকার ভোটার ছিলেন না। ভাসমান (নৌকার বসবাসরত) বেঁদে বহরের ৩৫টি পরিবার ১৫ বছর পূর্বে টরকীর চর এলাকার পালরদী নদীর তীরে জমি ক্রয় করে স্থায়ী বসবাস শুরু করেন। পালরদী নদীর জোয়ারের পানি থেকে রক্ষা পেতে মাটিতেই ছোট ছোট দ্বিতল খুঁপরি ঘরেই মাথা গুজতে হয় প্রতিটি পরিবারের ৭/৮ জনকে। এ পল্লীর পুরুষ ও মহিলাদের জীর্ণ শরীর। শিশুদের সারাদিন খেলাধুলা করারস্থান দেখলেই বোঝা যায় কতটা অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে তারা বেড়ে উঠছে। যেখানে আধুনিক সভ্যতার কোন ছোঁয়াই লাগেনি। সব বয়সী মেয়েদের জীর্ণ শরীর প্রমাণ করছে এখানে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ ও জন্ম নিয়ন্ত্রণের কোন বালাই নেই। কারন তাদের পরিবারগুলোতে রয়েছে অযতেœ বেড়ে ওঠা অধিক ছেলে-মেয়ে।

বেঁদে পল্লীর সর্দার নান্নু মিয়া জানান, সারাবছরে ভালোভাবে বসবাস করতে পারলেও বর্ষার সময়ে তাদের ভোগান্তির শেষ থাকে না। এ সময়ে বর্ষার পানিতে ভেজা স্যাঁতসেঁতে জায়গায় তাদের দুর্বিষহ জীবন কাটে। যাতায়াত ব্যবস্থার জন্য কোন রাস্তা না থাকায় তাদের দুর্ভোগ আরো বেরে যায়।

একাধিক বেঁদেরা জানায়, পূর্বে তাদের পরিবারের মেয়েরা বেশি অর্থ উপার্জন করতো। এখানে স্থায়ী বসবাসের পর মেয়েরা এখন আর রোজগারের জন্য গ্রাম ঘোরেন না।  এখন পুরুষরাই দূরের গ্রামগুলোতে বের হয় জীবিকার সন্ধানে। তাদের সঙ্গে থাকে সাপের ঝাঁপি ও বানর। সারাদিন সাপ ও বানরের খেলা দেখিয়ে মানুষকে আনন্দ দিয়ে পয়সা রোজগার করে সন্ধ্যায় তারা বাড়ি ফেরে। পুরুষদের মধ্যে আবার কেউ কেউ সাপ ধরে বিক্রি করে। এক এলাকাতে কিছুদিন পয়সা রোজগার করে আবার চলে যায় অন্য এলাকায়। এভাবে ২/১ সপ্তাহে কিছু পয়সা জমিয়ে আবার ফিরে আসে অপেক্ষাকৃত স্থায়ী ঠিকানায়। আধুনিক সমাজ ব্যবস্থায় মানুষের জীবন যাত্রার অনেকটাই পরিবর্তন হলেও এ বেঁদে পল্লীটি একেবারেই অন্ধকারে ডুবে রয়েছে বলে ওই পল্লীর বাসিন্দারা মনে করছেন। কারন এখানে বাল্য বিবাহ রোধ হয় না, বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষার ধার ধারে না। নেই জন্ম নিয়ন্ত্রণের জন্য যথেষ্ট ব্যবস্থা। এছাড়াও প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা থেকে তারা সম্পূর্ণ বঞ্চিত। শত কষ্টে দিন যাপন করলেও নিজেদের মধ্যে তাদের ছেলে-মেয়েদের বিয়ে দেন মহা ধুমধামের সাথে। একটি বিয়ের কথা পাকাপাকি হয়ে গেলে বেঁদে পল্লীতে আর আনন্দের সীমা থাকে না। নিজেদের মধ্যে কিংবা প্রতিবেশীদের সাথে কারো কোন সমস্যা দেখা দিলে বেঁদে সর্দার তার সমাধান করে দেন।

বেদে সর্দার নান্নু মিয়া আরো জানান, বেঁদেরা পূর্বে যেভাবে জীবনযাপন করতো তা থেকে এখন অনেকটাই পরিবর্তন হয়েছে। তারা এখন অনেকে তাদের ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়া শেখানোর প্রতি ঝুঁকে পড়ছেন। বর্তমানে ওই পল্লীর প্রায় বিশজন শিক্ষার্থী বিভিন্ন ক্লাশে অধ্যায়নরত রয়েছে। পূর্বে তারা গ্রামাঞ্চলে গেলে যেভাবে পয়সা পেতো এখন আর ততটা পাওয়া যায় না। তাই বেঁদেরাও তাদের পেশা পরিবর্তন করতে শুরু করেছে। ইতোমধ্যে ওই বেঁদে পল্লীর একাধিক যুবকেরা বিদেশেও পাড়ি জমিয়েছেন। 

বাংলাদেশের নাগরিক ওই বেঁদে পল্লীর বাসিন্দারা তাদের উল্লেখিত সমস্যা সমাধানের জন্য প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট উর্ধ্বতন কর্মকর্তা, বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ও এনজিও-গুলোর আশু হস্তক্ষেপ কামনা করছেন।