শেখ হাসিনার মুখে যে কথাগুলো মানায় না

জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির আন্দোলন বিরাট সহায়ক হয়েছিল। স্বাভাবিকভাবে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ শক্তি আশা করেছিল সরকার ঘাতকদের বিচার করবে। কিন্তু হাসিনা সরকার বিচার করেননি। অধিকন্তু যারা বিচারের দাবী নিয়ে ধর্না দিয়েছেন তাদেরকে অপমানিত করা হয়েছে। সংখ্যালঘুদের প্রত্যাশা ছিল অর্পিত সম্পত্তি আইনের একটা সুরাহা হবে। কিন্তু না, আজও শেখ হাসিনা সংখ্যালঘুদের মুখে অর্পিত সম্পত্তি আইনের মুলা ঝুলিয়ে রেখেছেন। চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি করে ডক্টরেট ডিগ্রি পাওয়ার অনেক চেষ্টা তদবির হয়েছে, কিন্তু শান্তি চুক্তি আজও বাস্তবায়িত হয়নি। উপরন্তু সুবিধাভোগীদের পরোক্ষভাবে আসকারার পধ সুগম করে দেওয়া হয়েছে।

২০০১ সালে শেখ হাসিনা তথা আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে। সংখ্যালঘুরা আওয়ামী লীগকে ভোট দেওয়ার কারণে তাদের ওপর নেমে আসে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী  শক্তির নারকীয় তান্ডব। হত্যা, ধর্ষণ, লুণ্টন, উচ্ছেদ, নির্যাতন, দেশত্যগে বাধ্য করা এবং অগ্নিসংযোগসহ এমন কোনো হীন কাজ নেই যা ঘটেনি। এসব পশুসুলভ আক্রোশ ও হিংস্রতায় সেদিন সংখ্যালঘুরা অসহায় চিৎকার করে বলেছিল, এই কি আমাদের মাতৃভূমি। এজন্যই কি একাত্তরে আমরা রক্ত দিয়েছিলাম।

এসব ঘটনা তদন্তে অবসরপ্রাপ্ত জেলা জজ মোহাম্মদ শাহাবুদ্দিন চুন্নুকে প্রধান করে তিন সদস্যের একটি কমিশন গঠন করা হয়। তদন্ত কমিশনের মর্মস্পর্শী তদন্ত রিপোর্টে বহু চাঞ্চল্যকর লোমহর্ষক ঘটনার বর্ণনা তুলে ধরে সম্প্রতি তাদের তদন্ত রিপোর্ট যথাযথ মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েছেন। রিপোর্ট জমা দেওয়ার মাস দেড়েক অতিবাহিত হয়ে গেছে। এব্যাপারে সরকারের রহস্যজনক নীরবতা নিয়ে ইতিমধ্যে জনমনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।

২০০১ সালের পর থেকে চারদলীয় জোটের অত্যাচারে দেশের মানুষ পরিত্রাণের পথ খুঁজছিলেন। ২০০৮-এর সাধারণ নির্বাচনে মানুষ সে সুযোগ গ্রহণ করে। জনগণ আওয়ামী লীগকে দুই তৃতীয়াংশ ভোট দিয়ে জয়যুক্ত করে। নির্বাচনে আওয়ামী লীগের কাছে জনগণের কতকগুলো মৌলিক দাবী ছিল। যেমন বঙ্গবন্ধুর খুনীদের বিচারের রায় কার্যকর করা, যুুদ্ধাপরাধীদের বিচার, ৭২-এর সংবিধানে দেশকে ফিরিয়ে আনা, হত্যা নির্যাতন, সন্ত্রাস ও সকল বোমা হামলার বিচার ইত্যাদি। আওয়ামী লীগ তথা মহাজোট জনগণের এই দাবি গুলো পূরণের ওয়াদা করেই ক্ষমতায় আসে।

ক্ষমতায় এসে সরকার বঙ্গবন্ধুর খুনীদের আংশিক বিচার করেছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকার্য শুরু করলেও নীতি নির্ধারকদের বিভিন্ন কথাবার্তা এবং কালক্ষেপণ জনমণে চরম অনিশ্চয়তা ও সন্দেহ দেখা দিয়েছে।

অপরদিকে ক্ষমতায় এসে প্রধানমন্ত্রী ও আইনমন্ত্রী ৭২-এর সংবিধানে ফিরে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি বার বার পুনঃব্যক্ত করেছেন। শুধু অপেক্ষা ছিল কোর্টের রায়ের। রায়ের পর উভয়েই বলেছেন, এখন থেকে দেশের যেখানে যত ধর্মীয় সংগঠন, সমিতি আছে তারা তাদের অধিকার হারিয়েছে। অর্থাৎ কার্যতঃ তারা নিষিদ্ধ হয়ে গেছে। এমনি অবস্থায় এরশাদ আমিনী গোষ্ঠী হুমকী দিলেন, কোরআন সুন্নার পরিপন্থী কোনো আইন করা যাবে না। ধর্ম ভিত্তিক রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করা যাবে না। আর তখনই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেদের অবস্থান নিরপাদ রাখতে বললেন- কোরআন সুন্নার পরিপন্থী কোনো আইন হবে না। রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম ও বিসমিল্লাহ সবই যথারীতি থাকবে। এ যেন সাঈদী-আমিনী-এরশাদের কণ্ঠের প্রতিধ্বনি। তাহলে ইসলামী ঐক্যজোটের আমিনী ও স্বৈরশাসক এরশাদের মাঝে আওয়ামী লীগের ভিন্নতা কোথায়? এই যদি শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের ইচ্ছা ছিল তাহলে বাহাত্তরের সংবিধানে ফিরে যাওয়ার ওয়াদা কেন করা হয়েছিল? কোর্টের রায়ের পর কেন বলা হয়েছিল এখন থেকে দেশ বাহাত্তরের সংবিধান ফিরে গেলে?

আজকে অর্পিত সম্পত্তি আইন, শান্তি চুক্তি সুকৌশলে চাপ দেওয়া হয়েছে। আদিবাসীদের স্বীকৃতি অস্বীকার করে কার্যতঃ গণতান্ত্রিক অধিকারকেই অস্বীকার করা হলো। এগুলো বস্ততঃ শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ওয়াদারই বরখেলাপ। দেশ ও জনগণের প্রতি চরম মোনাফেকী। ৩০ লক্ষ শহীদের প্রতি চরম বিশ্বাসঘাতকতা। অবশ্য শেখ হাসিনার পক্ষে সবই সম্ভব। সম্ভব বলেই অতীতে গোলাম আযমের কদমবুচি নিতে দ্বিধা করেননি। খেলাফত মজলিসের সাথে চুক্তি করতে বিবেকে বাধেনি। কেবলমাত্র সংকীণ ক্ষমতার লোভে স্বৈরশাসক এরশাদ ও তার অপকর্মের সাথে গাটছাড়া বেধে থাকতে আপত্তি নেই। বস্ততঃ আওয়ামী লীগ, বিএনপি আর মুসলীম লীগে এখন কোন তফাৎ নেই। খালেদা জিয়া ও বিএনপির মিথ্যাচারিতা আর শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের মোনাফেকী একই টাকার এপিট ওপিট। শেখ হাসিনা এখন কেবল আওয়ামী লীগের গায়ে জন্মলগ্নের ’মুসলিম’ তগ্মাটি সেটে দিলেই ষোলকলা পূর্ণ হয়ে যায়।

শেখ হাসিনা স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির সাথে আপোষ করে, গাটছাড়া বেঁধে সাময়িক হয়তো ক্ষমতায় থাকতে পারেন, সুদূর ভবিষ্যতের জন্য নয়। আপোষ করে, ছাড় দিয়ে বঙ্গবন্ধু তাদের ক্ষমা করে দিয়েছিলেন, কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে তারা ক্ষমা করেনি। সুতরাং শেখ হাসিনাকেও ছাড় দেওয়ার অবকাশ নেই। এই বাস্তবতা উপলব্দির গোয়ারতুমির খেসারত শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগকে অবশ্যই দিতে হবে।