আপনার এই চাণক্য-সুলভ প্র্যাক্টিকাল বুদ্ধি তারিফ পেতে পারে। আপনার পিতার কথাই মনে করিয়ে দেয়। তিনিও সিনিয়র জিয়াঊর রহমানকে এড়িয়ে শফিউল্লাহকে প্রধান সেনাপতি নিযুক্ত করেছিলেন, নিজের প্রতি বেশি অনুগত ভেবে। শফিউল্লাহ সাহেব সম্প্রতি বলেছেন, এটা এক ভুল সিদ্ধান্ত ছিল। কিন্তু সেই সময়ে তাঁর কোন ভুল নিয়ে আলোচনা করার সাহস কারো ছিল না। তিনি সব রকম বিরোধিতা স্থায়ীভাবে অপসারণের উদ্দেশ্যে একদলীয় বাকশাল প্রবর্তন করেন রুশ-ভারত পন্থীদের পরামর্শে, এক স্বাক্ষীগোপাল সংসদকে দিয়ে দেশের সংবিধান পরিবর্তন করে। তিনি মিডিয়া নিয়ন্ত্রণের জন্য সব খবরের কাগজ বন্ধ করে দেন, শুধু চারটে সরকারী দৈনিক রেখে। সব সরকারী কর্মচারী, এমনকি সেনাবাহিনীকেও বাকশালে যোগদান করতে তিনি বাধ্য করেন। খুব কম জনই প্রতিবাদ করার সাহস পেয়েছিল। খন্দকার মোশতাকও করেন নি। কিন্তু বিদ্রোহের বীজ তিনি বপন করেছিলেন জিয়াউর রহমান, ফারুক রহমান এদেরকে অপমান করে, মোশতাককে অবজ্ঞা করে, যদিও আওয়ামী লীগের আদি যুগে এই ‘চাচা’ আপনার পিতার সিনিয়র ছিলেন।
আপনার পিতা যেমন গণতন্ত্রে বিশ্বাস করতেন না, আপনিও করেন না, তাই দলের সব গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত আপনি একাই নেন। যাঁরা সংস্কারের কথা বলেছিলেন, আপনার পরিবার তন্ত্রের তাঁরা শত্রু। আপনি তাঁদের আর কখনই ক্ষমতার কাছাকাছি আসতে দেবেন না বলে ঠিক করেছেন।আপনার কাজিন শেখ সেলিম সেনাবাহিনীর কাছে আপনার ঘুষ গ্রহণের ইতিহাস বলে দিলেও আপনি তাঁকে আমুর মত শত্রু মনে করেন না, কারণ সেলিম এক বুদ্ধিহীন ব্যক্তি, যাঁকে আপনি বিপদ মনে করেন না। বরং তাঁর নতুন কুটুম খাম্বা পার্টির টুকুকেও আপনি সব মামলা থেকে রেহাই দিয়েছেন, এবং শেষ খবর অনুসারে টুকুর পার্টনার কুখ্যাত গিয়াসুদ্দিন মামুনকেও জেল থেকে মুক্তির ব্যবস্থা করেছেন। ‘দেশের চাইতে দল বড়, দলের চাইতে, পরিবার’, আপনার পিতার এই নীতিতে আপনি গভীরভাবে বিশ্বাসী। অন্যদিকে আপনি বৃদ্ধ পন্ডিত কামাল হোসেনকে এখমো বিপজ্জনক মনে করেন, তাই তাঁর ‘দুর্নীতির’ প্রমাণ বার করার নির্দেশ দিয়েছেন।
আপনার পিতার মধ্যে একটা গুণ ছিল, তিনি কালক্রমে শত্রুতা ভুলে যেতেন। সাকা চৌধুরীর পিতা ফকা চৌধুরী যখন স্বাধীনতার পরে কারাগারে মারা গেলেন, তখন তিনি সাকার মত নচ্ছার রাজাকারদেরকেও অভয়বাণী দিয়েছেন – ‘মনে কর, আমিই এখন থেকে তোদের বাবা। কিন্তু আপনার কাছে শত্রুর সংজ্ঞা পারিবারিক এবং তা স্থায়ী। সাকা যখন ‘সোনা’ চোরাকারবারি নিয়ে আপনার মন্তব্যের জবাবে একটা বিশ্রী রসিকতা করেছিলেন, আপনার দলের অনেকে তার প্রতিবাদ করলেও আপনি মনে হয় ব্যাপারটা কিছুটা উপভোগ করেছিলেন। পরে সাকা আপনার বাড়িতে বিয়ের কার্ড দিতে এলে আপনি তাকে নিষ্টি খাইয়েছিলেন। সাকাকে আপনি কখনই তেমন শত্রু মনে করেন নি, তাঁর দুর্বিনীত অশ্লীল আচরণকে বরং প্রশয়ই দিয়েছেন। আসলে জামাতকেও আপনি তেমন অপছন্দ করেন না, যেমন করেন পৃথিবীতে একটি মানুষকে, যাঁকে আপনি সব সময়েই নিজের সংসারের জন্য এক বিপদ মনে করেছেন, এবং তা সংসারের ওপরে বিরাগ চলে আসার পরেও স্থায়ীভাবে বাসা বেঁধে আছে, এখনো।
আপনার সাথে আপনার স্বামীর সম্পর্ক নিয়ে আমি বেশি কিছু বলতে চাই না। তিনি ভালো ছাত্র ছিলেন বটে, কিন্তু তাঁর অনেক ত্রুটি ছিল। আপনাকে অভিনন্দন যে, এত গরমিল থাকা সত্ত্বেও আপনাদের ছাড়াছাড়ি হয় নি, যা হয়েছে আপনার ছোট বোনের ক্ষেত্রে। আপনার ধৈর্য প্রশংসনীয়। কিন্তু শুধু একটি ব্যাপার আপনি সহ্য করতে পারেন নি, যখন তিনি আপনার পরিবার মেধাহীন বলে খোঁটা দিতেন। এর জবাবে আপনি এক ডজন ডক্টরেট সংগ্রহ করেছেন, মখা আলমগীর ও দূতাবাসগুলির সাহায্যে। আপনার স্বামী যখন স্কয়ার হাস্পাতালে মৃত্যুশয্যায়, আমরা দেখলাম আপনি ঘরের বাইরে থেকে এক নজর তাঁকে ঘেরা যন্ত্রপাতি দেখে চলে গেলেন। তাঁর মৃত্যুতে আপনি দুঃখিত হয়েছেন নিশ্চয়ই, কিন্তু স্বস্তির নিঃশ্বাসও ফেলেছেন। আপনাদের ছেলে বিদেশ থেকে ফেরার আগেই তাড়াতাড়ি তাঁকে সমাহিত করা হয়।
১৯৯৬ সালে আপনি প্রথমবার প্রধান মন্ত্রী হলেন। আপনার পরিবারের হত্যাকারী/পরিকল্পনাকারীদের অনেকেই গ্রেফতার হলো । অনেকেই ভেবেছিলেন, পাঁচ বছর দীর্ঘ সময়, এর মধ্যেই বিচার ও শাস্তি চূড়ান্ত হয়ে যাওয়া সম্ভব। কিন্তু কোন অজ্ঞাত কারণে প্রক্রিয়াটা অত্যন্ত শ্লথ গতিতে চলতে লাগল। নতুন একটা কথা শোনা যেতে লাগল – জাতির কলঙ্ক। মনে হলো কতিপয় আওয়ামী নেতা ও হৃদয়হীন অমানুষ সেনা কর্মকর্তার দুষ্কৃতির, বা তাদের সমর্থক রাজনৈতিক দলের দায়ভার সমগ্র জাতির ওপর ন্যস্ত করা হয় সুকৌশলে, যাতে গিক্টি কন্সায়েন্স থেকে আপনার প্রতি জনগণের আনুগত্য বাড়ে। এ কৌশল অনেকটাই সফল হয়েছিল প্রথমে। কিন্তু আপনি আনাড়ির মতো কথা বলে বিচারকদের পর্যন্ত খেপিয়ে দিয়েছিলেন, যার ফলে আদালত দেশের প্রধান মন্ত্রীকেও ভর্ৎসনা করে এবং সতর্ক করে দেয়। আপনার পরিবারের ও দলের সীমাহীন দুর্নীতির কথা সংবাদে সব প্রকাশিত না হলেও লোকমুখে ঘুরতে থাকে। পরবর্তীকালে সামরিক সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় আপনার আত্মীয় সেলিম, আপনার সেক্রেটারী জলিল, সবাই গোপন কথা বের করে দেয়। আপনি যে সঙ্গত কারণেই জনপ্রিয়তা হারিয়ে নির্বাচনে পরাজিত হয়েছিলেন, তা প্রতিষ্ঠিত হয়। এর মধ্যে আপনার প্রতিপক্ষ দলের এবং কতিপয় সিভিল সার্ভেন্টের কিছু কারচুপি থাকতেও পারে, কিন্তু আপনার বিজয়ী হওয়ার কোন সম্ভাবনা ছিল না। আপনার প্রিয় প্রেসিডেন্টকেও পরাজয়ের জন্য আপনি গালাগালি করতে পেছপা হন নি।
বাংলাদেশের মানুষের স্মৃতি দীর্ঘমেয়াদী নয়। আপনার প্রতিপক্ষ দল দ্বিতীয় দফা সুযোগ পেয়ে দুর্নীতিতে আপনাদের আগের আমলের রেকর্ডকেও যখন ছাড়িয়ে গেল, তখন এক অনুকূল সরকার ও নির্বাচন কমিশন অলৌকিক পার্থক্যে আপনাদের ফিরিয়ে আনল। এবারেও আপনার অন্যতম ট্রাম্প কার্ড ছিল আপনার পরিবারের জঘন্য হত্যাকাণ্ডের বিচার ও শাস্তি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার ওয়াদা। আবার আপনারা বললেন, এটা নাকি জাতির কলঙ্ক। না, জনগণ আপনার দলকে সেজন্য নির্বাচিত করে নি, তারা করেছে আপনার বিপক্ষ দলের দুর্নীতির জন্য। মামলার এই নিষ্পত্তির ব্যাপারটা প্রয়োজন ছিল, কিন্তু তার দায়ভার জনগণের ছিল না, ছিল আপনার,আপনার দলের এবং আপনার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের।
পাঁচ জনের শাস্তি হয়েছে। এখন যদি আপনি দাবি করেন বাকি ছ জনের শাস্তি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা পর্যন্ত আপনাকে ক্ষমতায় রাখা জাতির দায়, তাহলে জাতি তা মানবে কেন? আপনারা দুই দলের নেতারা মিলে বা গুটি কয়েক ব্যক্তি মিলে যে অপকর্ম করবেন, জাতির সাথে তার কি সম্পর্ক? আমাদের কষ্টার্জিত সম্পদ দিয়ে কেন আমরা আপনাদের সমগ্র পরিবারের জন্য প্রাসাদ, গাড়ী, নিরাপত্তার ব্যবস্থা করব?
আমাদের কখনোই কোন দায় বা কলঙ্ক ছিল ন, এখনো নেই। আপনি যদি আপনার পরিবারের স্বার্থের জন্য দেশবাসীর স্বার্থ বিসর্জন দিতে চান, আপনার পিতার মত এক অসহনীয় স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চান, দেশবাসী তা প্রতিহত করবে। আপনি বা আপনার প্রতিপক্ষ এদেশের প্রধান মন্ত্রী হওয়ার যোগ্যতম ব্যক্তি নন– না শিক্ষায়, না মেধায়, না চরিত্রে, না গণতন্ত্রের প্রতি বিশ্বস্ততায়।
আপনার সোনার ডিম্ব প্রসবিনী হাঁস এখন মৃত। আমাদের নেতা আমরা খুঁজে নেব।