বড় ভূমিকম্পের পূর্বেই সচেতন হওয়া চাই সবার

মুহাম্মাদ রিয়াজ উদ্দিন, শাবিঃ প্রতিবছরই কমবেশি মৃদু ভুকম্পন অনুভূত হয় দেশের নানাপ্রান্তে। তবে সেগুলো ছিল রিখটার স্কেলে খুবই কম। কিন্তু দেশে প্রায় ৬১ বছর পরে বড় এবং দীর্ঘস্থায়ী ভূমিকম্প অনুভূত হয় ১৮ সেপ্টেম্বর। ওই দিন সন্ধ্যা ৬টা ৪২ মিনিট থেকে ৪৪ মিনিট পর্যন্ত ভূমিকম্পটি ২মিনিট স্থায়ী হয়। ঢাকা তথা দেশের ইতিহাসে প্রায় ৬১ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বড় ভূমিকম্প। ধ্বংসাত্মক ভূমিকম্পটির রিখটার স্কেলে মাত্রা ছিল ৬.৮। বাংলাদেশ ও উত্তর-পূর্ব ভারতে অনুভূত কম্পনটির উৎপত্তিস্থল ছিল ঢাকা থেকে ৪৯৫ কিলোমিটার দূরে ভারতের সিকিম রাজ্যের রাজধানী গ্যাংটক থেকে ৬৪ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলে। earth quakবাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি কম্পন অনুভূত হয় বৃহত্তর দিনাজপুর, পঞ্চগড়, জয়পুরহাট, রংপুর ও গাইবান্ধা এলাকায়। কম্পনের ফলে রাজধানী ঢাকার কয়েকটি ভবন হেলে পড়েছে এ সংবাদ পত্রিকা ও টিভির সংবাদে জানা গেছে। তবে এ যাত্রায় বড় ধরনের কোন ক্ষতি থেকে দেশ রক্ষা পেয়েছে এমনটি বলেছেন ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞরা। ২মিনিট স্থায়ী এ কম্পনের ফলে ঢাকার বড় ভবনগুলো হঠাৎ করে দুলে ওঠে। এ সময় বহুতল ভবনে থাকা মানুষ সিঁড়ি বেয়ে দৌঁড়ে নিচে নামে। কে কার আগে কত দ্রুত নামতে পারেÑপ্রাণ বাঁচানোর এই প্রতিযোগিতায় নামে সবাই। হুড়োহুড়ি করতে গিয়ে বহুতল ভবনে লিফটে থাকা মানুষ আতঙ্কে চিৎকার শুরু করেন। কোথাও কোথাও আহত হওয়ারও সংবাদ জানা গেছে। শুধু ঢাকায় নয় পুরো দেশজুড়ে সৃষ্টি হয় এক নজিরবিহীন ভীতিকর পরিস্থিতি। স্বজনরা খোঁজ নিতে থাকেন তাদের দূরের আত্মীয়দের। পরের দিন প্রত্যেকটি খবরের কাগজ প্রধান শিরোনামে ছেপেছে এ ভূমিকম্পের কথা। আমাদের দেশে কোন কিছুর ঘটনা ঘটে যাওয়ার পরেই হুলস্থূল লক্ষ করা যায়। হুঁশ হয় সবার। কিন্তু ঘটনার পূর্বে সবার করণীয় কী এমন প্রচারণা খুব কমই দেখা যায়।

ভূমিকম্প একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ। রিখটার স্কেলে ৬.৯ মাত্রার ভূমিকম্প হলে রাজধানী ঢাকার হাজার হাজার বহুতল ভবন ধ্বসে পড়বে। আর দুর্যোগ বিষয়ক বিশেষজ্ঞ মাকসুদ কামালের মতে, ৬.৯ মাত্রার ভূমিকম্প ৪৫০টি আণবিক বোমার সমান। ফলে এর ধ্বংসাত্মাক ক্ষতির পরিমাণও বেশি। মানুষের ঘনবসতি খোদ রাজধানী ঢাকা পরিণত হবে মৃত্যুপুরী এক নগরীতে। বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন যে, ভূমিকম্পের কারণে যে ক্ষয়ক্ষতি ঘটবে, তার প্রধানটিই হবে জীর্ণদশা ও অপরিকল্পিত ভবন নির্মাণের কারণে। অন্যদিকে ভূমিকম্পের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগে আহদের চিকিৎসার ব্যবস্থা না থাকায় বিনাচিকিৎসা বা উপযুক্ত চিকিৎসার অভাবে অসংখ্য মানুষের প্রাণ ও অঙ্গহানি ঘটবে বলে আশঙ্কা করেছেন বিশেষজ্ঞরা। ভূমিকম্প আঘাত হানলে পুরনো ঢাকা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হবে। ভূমিকম্প বিষয়ক বিশেষজ্ঞ প্রফেসর জামিলুর রেজা চৌধুরী ও প্রফেসর মেহেদী আহমদ আনসারী ওই এলাকা সমীক্ষা করে এরকম আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন তাদের লিখিত বিভিন্ন প্রতিবেদনে। কারণ পুরনো ঢাকায় ঘনবসতি এলাকা সবচেয়ে বেশি এবং ঘরবাড়ি বহ বছরের পুরনো। এখানে ৩০টিরও অধিক ঐতিহাসিক দালানকোঠা রয়েছে যা এমনিতেই ঝুঁকিপূর্ণ। পুরনো ঢাকায় রাস্তা এত সরু যে, দমকলের গাড়ি প্রবেশের কোনো সুযোগ নেই। ভূমিকম্পের সময় মানুষ কিভাবে নিজেকে রক্ষা করবে সে বিষয়ে ফায়ার সার্ভিস বেশ কিছু পরামর্শ দিয়েছে। ভূমিকম্পের স্থায়িত্বকাল ৩০-৪০ সেকেন্ড হলে বিচলিত না হয়ে মাথা স্থির রেখে নিজের মাথাকে সুরক্ষার জন্য হাতের কাছে যা পাওয়া যায়(যেমন-বালিশ, কম্বল, কাঁথা, বই-খাতা, মজবুত হাঁড়ি-পাতিল)ইত্যাদি দিয়ে মাথাটাকে ঢেকে রাখতে হবে। অথবা খাট ও টেবিলের নিচে, কক্ষের কর্নারে আশ্রয় নিতে হবে। সম্ভব হলে দ্রুত খোলা নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নিতে হবে। চুলা জ্বালানো থাকলে দ্রুত বেরিয়ে বাইরে আশ্রয় নিতে হবে। ভূমিকম্পের সময় কোন অবস্থাতেই জানালার পাশে যাওয়া যাবে না। লিফট ব্যবহার করা যাবে না। ঘরের বাইরে থাকলে বড় গাছ, বহুবতল ভবন বা বিদ্যুৎ খুঁটির থেকে দূরে থাকতে হবে। যানবাহন চলাচল অবস্থায় ভূমিকম্প হলে রাস্তার পাশে খোলা জায়গায় গাড়ির ইঞ্জিন বন্ধ করে গাড়ির মধ্যে সবাইকে অবস্থান করতে হবে। সম্ভব হলে টর্চ লাইট হাতের কাছে রাখতে হবে। ভূমিকম্পে ভাঙ্গা দেয়ালে চাপা পড়লে কোন প্রকার নড়াচড়া করা যাবে না এভং শ্বাসনালিতে যাতে ধূলাবালি ঢুকতে না পারে সেজন্য সম্ভব হলে নাক-মুখ হাত দিয়ে ঢেকে রাখতে হবে। ভূমিকম্পের সময় হুড়োহুড়ি বা ছোটাছুটি না করে নিরাপদ আশ্রয়ে গিয়ে আত্মরক্ষার পাশাপাশি উদ্ধারকর্মীদের খবর দেয়ার চেষ্টা করতে হবে।

ভূমিকম্পের সময় করণীয় কী সে সম্পর্কে প্রতিটি নাগরিকের জানা প্রয়োজন। শুধু টকশো কিংবা মানববন্ধন আর গোল টেবিলের ভেতর সীমাবদ্ধ রাখলে চলবে না। দেশের সবার কাছে ভূমিকম্পের ভয়াবহতা এবং ভূমিকম্পের সময় কী করণীয় এবং কী কাজ করলে মারাত্মক ক্ষতি থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে এমন তথ্য পৌঁছে দিতে হবে। এক্ষেত্রে প্রিন্ট ও ইলেট্রনিক মিডিয়া অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। টেলিভিশন ও বেতারের মাধ্যমে সংবাদের আগে ও পরে এ সম্পর্কিত বুলেটিন প্রচার কর যেতে পারে। যার মাধ্যমে সচেতন হবে প্রতিটি নাগরিক। সতর্ক থাকবে নতুন নতুন বহুতল ভবন নির্মাণে। একটু সতর্কতাই পারবে ভূমিকম্পের ক্ষতি থেকে বাঁচাতে। সতর্কতাই জীবন বাঁচানোর অস্ত্র হয়ে উঠতে পারে। আতঙ্কিত না হয়ে বরং সতর্ক ও করণীয় সম্পর্কে নিজে জানি এবং অপরকেও জানাই। তাতে দেশকে ধ্বংসাত্মক ক্ষতি থেকে যেমন মূল্যবান জীবন বাঁচানো যাবে তেমনি জীবন রক্ষাকারী সম্পদকেও রক্ষা করা যাবে।
 


সংবাদকর্মী ও শিক্ষার্থী(মাস্টার্স ১ম সেমিস্টার, ইংরেজি বিভাগ)
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযু্ক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট।