১৬১ বছরের পুরনো-দেশের সর্ববৃহৎ দূর্গা মন্দির নতুন রূপে সজ্জিত হচ্ছে জমিদার মোহনলাল সাহার বাড়ির প্রাচীণ দূর্গা মন্দির

খোকন আহম্মেদ হীরা, গৌরনদী ॥ হিন্দু ধর্মাবোলম্বীদের সর্ব বৃহৎ উৎসব দূর্গা পূজাকে সামনে রেখে নববধূ রূপে সাজানো হচ্ছে দেশের প্রাচীনতম সর্ববৃহৎ দূর্গা মন্দির ও প্রতিমাখ্যাত বরিশালের গৌরনদীর খ্যাতিমান জমিদার প্রয়াত মোহন লাল সাহার বাড়ির ঐতিহ্যবাহী দূর্গা মন্দিরটি। দেবী দূর্গাকে বরন করে নেয়ার জন্য ইতোমধ্যে সকল ধরনের প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হয়েছে। একশত একষট্টি বছরের পুরনো এ দূর্গা মন্দিরটি দেশের মধ্যে সর্ববৃহৎ দূর্গা মন্দির বলে জনশ্রুতি রয়েছে। কারুকার্য ও সিংহমুর্তি খচিত দূর্গা মন্দিরটিতে শেষ সময়ে চলছে চুন কাম ও সাজানোর কাজ। জমিদার বাড়ির প্রবেশ দ্বারে প্রচীন সু-বৃহৎ দূর্গা মন্দিরে প্রতিবছর দূর্গা পূজাকে ঘিরে দেশের দূর দূরান্তের হাজার-হাজার পর্যবেক্ষক ও ভক্তবৃন্দের সমাগম ঘটে। দেশের মধ্যে এ দূর্গা মন্দিরটি সর্ববৃহৎ হওয়ায় প্রতিবছরই মহাধুমধামের সাথে এ মন্দিরে দূর্গা পূজা উদ্যাপিত হয়ে আসছে। এ বছরও দূর্গা পূজা উপলক্ষে আয়োজনের কোন কমতি নেই।

জানা গেছে, গৌরনদী উপজেলা সদর থেকে প্রায় ১ হাজার ফুট দূরত্বে (দক্ষিণ পার্শ্বে) আড়িয়াল খাঁ নদীর প্রশাখা গৌরনদী-মীরেরহাট নদীর তীরে আশোকাঠী গ্রামে (বর্তমান পৌর এলাকা) জমিদার মোহন লাল সাহার বাড়ি। বাড়ির সামনেই রয়েছে সান বাঁধানো সু-বিশাল একটি দীঘি। জমিদার থাকতেন প্রসন্ন ভবনে। বর্তমানে জমিদার বাড়ি ও প্রাচীনতম মন্দিরটি কালের স্বাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে।

স্থানীয়রা জানান, তৎকালীন সময়ে ভারতীয় উপমহাদেশের মধ্যে সর্ববৃহৎ মন্দির হিসেবে এ মন্দিরটিতে ভক্ত দর্শনার্থীরা পূজা অর্চনা করতে ভীড় করতেন। ৪০গজ দৈর্ঘ্য ৩০ গজ প্রস্থ মন্দিরটিতে রয়েছে ৪৫টি স্তম্ভ^। ১৮৫০ সনের দিকে জমিদার মোহন লাল সাহার পিতা জমিদার প্রসন্ন কুমার সাহা কারুকার্য খচিত এ প্রাচীণ মন্দিরটি নির্মান করেছেন।

জমিদার বাড়ির উত্তরসূরী রাজা রাম সাহা জানান, ১৯৭১ সনে পাক হানাদার ও তাদের স্থানীয় সহযোগী রাজাকাররা এ বাড়িতে হামলা চালিয়ে ব্যাপক লুটপাট করে। আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয় পাইক পেয়াদাদের ঘরবাড়ি। গুড়িয়ে দেয় দূর্গা মন্দিরের ছাদের ওপরের চারপাশের সিংহ মূর্তিগুলো। ওই বছরেই জমিদার মোহন লাল সাহা পরলোকগমন করেন।

জমিদার মোহন লাল সাহার পুত্র স্বর্গীয় মানিক লাল সাহার স্ত্রী ও স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পী অরুনা সাহা জানান, তিনি কিশোরী বয়সে এ বাড়িতে বউ হয়ে এসেছিলেন। তৎকালীন সময়ে তার শশুর মোহন লাল সাহার প্রভাব প্রতিপত্তি সবই ছিলো। ছিলো অসংখ্য পাইক পেয়াদা। সে সময় এ বাড়িতে প্রায় বারো মাসই অত্র অঞ্চলের মানুষের বিনোদনের জন্য যাত্রা, জারি, সারী ও পালা গানের আয়োজন করা হতো। হাজার-হাজার মানুষের পদচারনায় মুখরীত ছিলো এ বাড়িটি।

প্রয়াত মোহন লাল সাহা শুধু জমিদারই নয় তিনি নির্বাচিত প্রেসিডেন্টও ছিলেন। তার কাছে সাহাষ্য নিতে এসে কেউ কোনদিন খালি হাতে ফিরে যাননি। প্রজাদের কাছ থেকে ট্র্যাক্স মওকুব, অসহায়দের সহায়তা, ভূমিহীনদের সম্পত্তি দান, ব্যবসায়ীদের সুবিধার্থে খাল খননসহ তিনি অসংখ্য জনকল্যানমূলক কাজ করেছেন। এছাড়াও সমাজের অবহেলিত, গরিব, মেহনতি ও সর্বস্তরের মানুষের মাঝে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে তিনি ১৯৩৫ সনে বাড়ির পাশ্ববর্তী আশোকাঠী নামক স্থানে প্রতিষ্ঠিত করেন পালরদী মাধ্যমিক বিদ্যালয়। ওই স্কুলের শিক্ষক ও দরিদ্র পরিবারের শিক্ষার্থীদের জমিদার মোহন লাল সাহা তার নিজবাড়িতে রেখে ভরন পোষনসহ সু-শিক্ষার ব্যবস্থা করেছেন। ১৯৮৮ সনে খুলনা বিভাগের মধ্যে শ্রেষ্ঠ মাধ্যমিক বিদ্যালয় হিসেবে মোহন লাল সাহার প্রতিষ্ঠিত বিদ্যাপিঠটি জাতীয় পুরস্কার লাভ করে। বর্তমানেও এ বিদ্যাপিঠটি বরিশাল শিক্ষা বোর্ডের মধ্যে একটি অন্যতম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। জমিদারের মৃত্যুর পর তার রেখে যাওয়া প্রায় সব সম্পত্তিই বেহাত হয়ে গেছে। বর্তমানে শুধু জমিদার বাড়িটিই কালের স্বাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে।

এলাকাবাসি ও জমিদারের উত্তরসূরীরা সরকারি উদ্যোগে ঐতিহ্যবাহী এ জমিদার বাড়িটি রক্ষনাবেক্ষন করার দাবি জানিয়েছেন। রক্ষানা বেক্ষনের মাধ্যমে এ বাড়িটি হতে পারে একটি পর্যটন কেন্দ্র।