খুনী কালুর বিচারের দাবি করেছে তার মা অজুফা

নিজস্ব সংবাদদাতাঃ গর্ভজাত সন্তান আজ খুনের অপরাধে পুলিশের খাঁচায় বন্দি। খুনের আলামত ছুরি উদ্ধারের জন্য পুলিশ তাকে নিয়ে এসেছে ঘটনাস্থলে। হাজার-হাজার গ্রামবাসীর সম্মুখে খুনের কথা অকপটে স্বীকার করে নিজেই হত্যাকান্ডের স্থান ও ছুরি ফালানোর ডোবা দেখিয়ে দেয় খুনী কালু। এ সময় ঘটনাস্থলে কালুকে দেখার জন্য তার মা অজুফা বেগম (৫৫) ছুঁটে আসেন। তিনি পুলিশ ও জনতার সম্মুখে বলেন, কালু একাই এ হত্যাকান্ড ঘটিয়েছে। এ ঘটনার সাথে অন্যকেউ জড়িত নেই। আমি ওর বিচার চাই। প্রতিবেশী এক প্রবাসীর স্ত্রীর সাথে তার (কালুর) আড়াই বছর যাবৎ অবৈধ সম্পর্ক ছিলো। এর জের ধরেই কালু এ হত্যাকান্ড ঘটিয়েছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন। এসময় ঘটনাস্থলে উপস্থিত হাজার-হাজার গ্রামবাসী ঠান্ডা মাথার খুনী কালুকে ধিক্কার জানিয়ে তার ফাঁসির দাবি করেন। এমনই এক দৃশ্যের অবতারনা হয়েছিলো আজ শুক্রবার দুপুরে। ঘটনাটি বরিশালের গৌরনদীর চাঞ্চল্যকর প্রাইমারি শিক্ষক ফরিদ জমাদ্দার হত্যা মামলার।  

চাঞ্চল্যকর এ হত্যা মামলার মূল খুনী কালু সরদারকে বৃহস্পতিবার দু’দিনের রিমান্ডে আনা হয়। রিমান্ডের দু’দিনেই বৃহস্পতি ও গতকাল শুক্রবার পুলিশের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে খুনী কালুকে নিয়ে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করা হয়। এ সময় ঘটনাস্থল (দক্ষিণ পিঙ্গলাকাঠী) এলাকার হাজার-হাজার গ্রামবাসী খুনী কালুকে ধিক্কার জানিয়ে অনতিবিলম্বে খুনী কালুর ফাঁসির দাবি জানিয়েছেন। দু’দিনের আপ্রান চেষ্ঠার পর গতকাল শুক্রবার দুপুরে পুলিশ গ্রামবাসীদের সহায়তায় পরিত্যক্ত একটি ডোবা থেকে হত্যার কাজে ব্যবহৃত ছুরিটি উদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছে। অপরদিকে পুলিশ পিঙ্গলাকাঠী মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আমিনুল ইসলাম কাননকে বৃহস্পতিবার রাতে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে ছেড়ে দিয়েছেন।

গৌরনদী থানার অফিসার ইনচার্জ ওসি মোঃ নুরুল ইসলাম-পিপিএম জানান, খুনী কালুকে মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলের গোদাবাজার এলাকা থেকে গ্রেফতারের পর সে (খুনী কালু) পুলিশ, সাংবাদিক ও আদালতে ম্যাজিষ্ট্রেটের কাছে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দিতে উল্লেখ করে, খুনের পরিকল্পনার সাথে স্কুলের প্রধান শিক্ষক আমিনুল ইসলাম কানন ও স্কুল ম্যানেজিং কমিটির এক সদস্য জড়িত রয়েছে। আর শিক্ষক ফরিদ জমাদ্দারকে কালু একাই ছুরিকাঘাত করে খুন করেছে বলেও সে উল্লেখ করে। সেমতে খুনের প্রধান আলামত ধারালো ছুরি উদ্ধার ও ঘটনার সাথে অন্য কেউ জড়িত রয়েছে কিনা সে জন্য আরো জিজ্ঞাসাবাদের লক্ষ্যে পুলিশ খুনী কালুর সাতদিনের রিমান্ড চেয়ে আদালতে আবেদন করে। আবেদনের প্রেক্ষিতে আদালত দু’দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করে।

বৃহস্পতিবার খুনী কালুকে রিমান্ডে এনে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ শেষে ওইদিন বিকেলে খুনের কাজে ব্যবহৃত ছুরিটি উদ্ধারের জন্য গৌরনদী সার্কেলের সহকারি পুলিশ সুপার (এএসপি) মোঃ সাইদুল ইসলাম-পিপিএম, গৌরনদী থানার অফিসার ইনচার্জ ওসি মোঃ নুরুল ইসলাম-পিপিএম, মামলার তদন্তকারী অফিসার মোঃ মিজানুর রহমানের নেতৃত্বে একদল পুলিশ খুনী কালুকে নিয়ে ঘটনাস্থল (দক্ষিণ পিঙ্গলাকাঠী) এলাকা পরিদর্শন করেন। ঘটনাস্থলে গিয়ে খুনী কালু নিজেই হত্যাকান্ডের স্থান দেখায়। এছাড়াও হত্যাকান্ডের স্থান থেকে ৫০ গজ দুরত্বের একটি ডোবার মধ্যে খুনের ব্যবহৃত ছুরিটি ফেলা হয়েছে বলেও কালু জানায়। পুলিশ দু’দিন ধরে গ্রামবাসীদের সহায়তায় ডোবার মধ্যে ব্যাপক তল্লাশী চালিয়ে গতকাল শুক্রবার দুপুরে হত্যার কাজে ব্যবহৃত ছুরিটি উদ্ধার করতে সক্ষম হন। এসময় ওই এলাকার হাজার-হাজার গ্রামবাসী খুনী কালুকে ধিক্কার জানিয়ে অনতিবিলম্বে তার (খুনী কালুর) ফাঁসি দাবি করেন।     

কেন এই খুন:
পুলিশ ও স্থানীয় একাধিক সূত্রে জানা গেছে, পিঙ্গলাকাঠী গ্রামের জনৈক সৌদি প্রবাসীর স্ত্রীর সাথে আবুল কালাম ওরফে কালু সরদার দীর্ঘদিন ধরে পরকীয়ায় জড়িয়ে পরে। বিষয়টি এলাকায় জানাজানি হলে প্রবাসীর পরিবারের চাপের মুখে তাদের সম্পর্কের ফাঁটল ধরে। প্রবাসীর শিশু পুত্র পিঙ্গলাকাঠী মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রথম শ্রেনীতে পড়াশুনা করতো। শিশু পুত্রকে নিয়ে প্রবাসীর স্ত্রী স্কুলে যাতায়াতের সুবাধে তার সাথে শিক্ষক ফরিদ জমাদ্দারের পরিচয় হয়। একপর্যায়ে প্রবাসীর বাড়িতে শিক্ষক ফরিদ জমাদ্দার যাতায়াতের সুবাধে তাদের সাথে সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এতে কালুর সন্দেহ হয়। তাই সে শিক্ষক ফরিদ জমাদ্দারকে প্রবাসীর স্ত্রীর সাথে কথা না বলা ও তার সাথে কোন সর্ম্পক না রাখার জন্য বিভিন্ন সময় হুমকি দিয়ে আসছিলো। তার হুমকিতে কোন কাজ না হওয়া শিক্ষক ফরিদ জমাদ্দারকে সে হত্যার পরিকল্পনা করে। তারই ধারাবাহিকতায় গত ২২ সেপ্টেম্বর সকাল সাড়ে নয়টার দিকে শিক্ষক ফরিদ জমাদ্দার (২৮) স্কুলে যাওয়ার পথিমধ্যে পিঙ্গলাকাঠীর কর্মকার বাড়ির নির্জনস্থানে পৌঁছলে সন্ত্রাসী কালু সরদার ঠান্ডা মাথায় একাই ছুরিকাঘাত করে ফরিদকে হত্যা করে। হত্যাকান্ডের পর পরই খুনী কালু সরদার এলাকা থেকে আত্মগোপন করে।

এদিকে হত্যার ঘটনাটি ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার জন্য একটি বিশেষ রাজনৈতিক মহলের পরোক্ষ ইঙ্গিতে নিহতের ভাই স্কুল শিক্ষক শাহ জালাল জমাদ্দার বাদি হয়ে গৌরনদী থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন। ওই মামলার প্রধান আসামি করা হয় উপজেলা ছাত্রলীগের সাধারন সম্পাদক মোঃ নয়ন শরীফ ও সরকারি গৌরনদী কলেজ ছাত্রলীগের সহসভাপতি মোঃ কাজল হাওলাদারসহ ৫জনকে। অথচ ঘটনারদিন (২২ সেপ্টেম্বর) সকাল আটটা থেকে দশটা পর্যন্ত ছাত্রলীগ নেতা নয়ন ও কাজলসহ পিঙ্গলাকাঠী এলাকার নির্বাচিত দু’জন জনপ্রতিনিধি এবং ওই এলাকার প্রায় ১৫/২০ জন গন্যমান্য ব্যক্তিরা গৌরনদী পৌরসভার মেয়রের দিয়াশুর মহল্লার বাসায় এক জরুরি বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন। বৈঠক চলাকালীন মোবাইল ফোনের মাধ্যমে তারা শিক্ষক ফরিদ জমাদ্দারকে ছুরিকাঘাত করার খবর পেয়ে ঘটনাস্থলের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়। পথিমধ্যে গৌরনদী থানার এক এস.আই-এর মটরসাইকেলযোগে ছাত্রলীগ নেতা নয়ন শরীফ ঘটনাস্থলে যায়।

পুলিশের কঠোর ভূমিকা:
রহস্যাবৃত্ত চাঞ্চল্যকর এ মামলা দায়েরের পর দীর্ঘ তদন্ত শেষে পুলিশ নিহত শিক্ষক ফরিদ জমাদ্দার ও প্রবাসীর স্ত্রীর ফোন কললিষ্টের সূত্র ধরে তাদের সম্পর্কের বিষয়টি নিশ্চিত হন। পরবর্তীতে হত্যার মূলরহস্য উদ্ঘাটন করে পুলিশ আত্মগোপনে থাকা চাঞ্চল্যকর এ মামলার একমাত্র খুনী কালুকে মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল থানার গোদাবাজার এলাকা থেকে গত ২৬ অক্টোবর রাতে গ্রেফতার করে। গতকাল শুক্রবারই দু’দিনের রিমান্ড শেষে খুনী কালুকে আদালতে সোর্পদ করা হয়।

সত্যের জয়:
পুলিশের কঠোর ভূমিকার কারনে খুনের প্রকৃত রহস্য উদ্ঘাটন হওয়ার বিষয়টি যেন এক সত্যেরই জয়। পুলিশের এ কঠোর ভূমিকার কারনে মিথ্যে মামলা থেকে রেহাই পেয়েছে পিঙ্গলাকাঠী গ্রামের একাধিক নিরিহ যুবকেরা। যারা এলাকার নম্র-ভদ্র, নিরিহ ও মেধাবী ছাত্র হিসেবে পরিচিত সেইসব যুবকদেরই জড়িয়ে দেয়া হয়েছিলো শিক্ষক ফরিদ হত্যা মামলায়। কিন্তু পুলিশের সঠিক তথ্য উদ্ঘাটনে মিথ্যে মামলা থেকে রেহাই পেয়েছে ওইসব যুবকেরা। সঠিক তথ্য উদঘাটনের মাধ্যমে প্রকৃত খুনীকে গ্রেফতার পূর্বক খুনের কাজে ব্যবহৃত ধারালো চাক্কু উদ্ধার হওয়ায় এবং এলাকার নিরিহ যুবকেরা মামলা থেকে রেহাই পাওয়ায় গতকাল শুক্রবার বাদ জুম্মা এলাকাবাসির উদ্যোগে এ মামলার সাথে সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তাদের দীর্ঘায়ু কামনায় পিঙ্গলাকাঠীর বিভিন্ন জামে মসজিদে বিশেষ দোয়া-মোনাজাত করা হয়।

মামলার বাদির দাবি:
চাঞ্চল্যকর এ মামলার বাদি ও নিহত শিক্ষক ফরিদের বড় ভাই নাঠৈ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক মোঃ শাহজালাল জমাদ্দার বলেন, পুলিশের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের হস্তক্ষেপে হত্যাকান্ডের প্রকৃত রহস্য উদঘাটনসহ একমাত্র খুনীকে গ্রেফতার ও ছুরি উদ্ধার হওয়ায়ই প্রমান মেলে আমার ভাইকে কালু একাই খুন করেছে। আমি এ ঠান্ডা মাথার খুনী কালুর ফাঁসির দাবি করছি। এ জন্য তিনি প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ প্রশাসনের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের আশু হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন। একই সাথে প্রকৃত ঘটনা উদঘাটনের জন্য তিনি পুলিশ প্রশাসনের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন।