টিপাইমুখ বাঁধ : দেশকে মরুকরণ বানাতে চাই না

মুহাম্মাদ রিয়াজ উদ্দিন, শাবি ॥ বর্তমানে দেশের যে কয়টি বিষয় নিয়ে আলোচনার ঝড় বইছে তার মধ্যে টিপাইমুখ বাঁধ প্রসঙ্গ অন্যতম। চায়ের দোকান থেকে শুরু করে সর্বত্রই চলছে নানান আলোচনা। আর গণমাধ্যমে ব্যাপক প্রচার হওয়ায় সাধারণ মানুষও খোঁজ নিচ্ছে সর্বশেষ পরিস্থিতি জানতে। গতমাসের ২২ তারিখে বরাক নদের ওপর টিপাইমুখ বাঁধ ও জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে একটি যৌথ বিনিয়োগ চুক্তি সই হয় ভারতের দিল্লিতে। মণিপুর সরকার এবং প্রকল্পের অন্যতম অংশীদারের মুখপাত্রের বরাত দিয়ে ১৮ নভেম্বর খবরটি সর্বপ্রথম প্রচার করে বিবিসি। সংবাদ মাধ্যমটি জানিয়েছে, দিল্লিতে গত ২২ অক্টোবর টিপাইমুখ বহুমুখী বাঁধ নির্মাণ হবেই বলে তাদের ঘোষণা; শুধু বিদ্যুতের জন্য নয়, আসামের কাছাড় জেলায় সেচ ও বন্যানিয়ন্ত্রণও হবে ওই প্রকল্পের। ২০১০ ও ২০১১ সালে ভারত ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর বৈঠক শেষে যৌথ ঘোষণায় মনমোহন সিং অঙ্গীকার করেছিলেন, টিপাইমুখে এমন কোনো পদক্ষেপ নেয়া হবে না, যাতে বাংলাদেশের ক্ষতি হয়। বাংলাদেশকে না জানিয়েও কিছু করা হবে না, এমনও আশ্বাস দিয়েছিলেন। দীর্ঘদিন ধরেই উভয় দেশের পরিবেশবাদীরা আশঙ্কা করছেন, টিপাইমুখে জলাধার ও বিদ্যুৎ প্রকল্প হলে বিরাট এলাকার পাহাড়-জঙ্গল পানিতে ডুবে যাবে এবং অনেক লুপ্তপ্রায় প্রাণিসম্পদ ধ্বংস হবে। ঘর বাড়িসহ জীবিকা হারিয়ে পথে বসবে বহু মানুষ। এছাড়া টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণের পরে সেটি ভূমিকম্পে ধসে পড়লে আসাম ও বাংলাদেশের বড় ধরনের ক্ষতি হয়ে যাবারও আশঙ্কা রয়েছে।

বাংলাদেশের পানি বিশেষজ্ঞরা প্রথম থেকেই বলে আসছেন ভারত সরকারের পক্ষ থেকে যে আশ্বাস রয়েছে অর্থাৎ বাঁধ নির্মাণ হলে বাংলাদেশের কোনো ক্ষতি হবে না এমন কথায় কোন বিশ্বাস করা যায় না। কারণ বাঁধটি নির্মিত হলে বাংলাদেশে এর কী প্রভাব পড়বে তার কোনো পরিবেশগত সমীক্ষা এখন পর্যন্ত হয়নি। খোদ ভারতের মণিপুরের অনেক বিজ্ঞানী ও পরিবেশবিদ টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণের কাজে দীর্ঘদিন ধরে বিরোধীতা করে আসছেন। এলাকটি ভূমিকম্পনপ্রবণ এলাকা হওয়ায় বাঁধ নির্মাণের ফলে এর ফলাফলও হবে ভয়াবহ এমনটিই জানিয়েছেন উভয় দেশের পরিবেশ বিষয়ক বিশেষজ্ঞরা। আন্তর্জাতিক পানি আইন অনুযায়ী যৌথ জরিপ এবং পরিবেশ প্রতিবেশের প্রভাব নিরুপণ জরিপ ছাড়া এরকম যৌথ নদীর ওপর বাঁধ নির্মাণ করা যায় না বলেও জানিয়েছে বিশেষজ্ঞরা। দেশের রাজনীতিতেও টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণ প্রসঙ্গ খুব জোড়ালো ভাবে আলোচিত হচ্ছে।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২৩ নভেম্বর সংসদে জানিয়েছেন, টিপাইমুখের বাস্তব অবস্থা জানতে শিগগিরই বিশেষ প্রতিনিধি পাঠানো হবে। টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে সরকার এরই মধ্যে ভারতের কাছে ব্যাখ্যা চেয়ে চিঠি লিখেছে জানিয়ে তিনি আরো বলেন, টিপাইমুখের বিষয় সার্ভে করতে হলে বাংলাদেশকে সঙ্গে নিয়ে করতে হবে। আমাদের স্বার্থ ক্ষুণ্ন করে কেউ এককভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না। তিনি সবাইকে আশ্বস্ত করে বলেন, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকতে তা হতে দেবে না। তিনি অভিযোগ করে বলেন, টিপাইমুখ নিয়ে আওয়ামী লীগই প্রথম আন্দোলন শুরু করে। আমরা বিরোধী দলে থাকতে আমাদের অর্থমন্ত্রী (এ এম এ মুহিত) এ আন্দোলন করেন। তিস্তা চুক্তি প্রসঙ্গে প্রশ্নোত্তরে প্রধানমন্ত্রী পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে বলেন, বিএনপি দু’বার ক্ষমতায় ছিল, তিস্তা চুক্তি করতে পারেনি কেন? খালেদা জিয়া কী তখন ঘুমিয়েছিলেন, নাকি ভারতের পদলেহন করেছেন? জনগণের কাছে এর জবাব তাদের দিতে হবে। বর্তমান সরকারের আমলেই তিস্তা চুক্তি হবে। সরকারের পাশাপাশি টিপাইমুখে যৌথ জরিপের দাবিতে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর কাছে বিরোধী দলের নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া চিঠি পাঠিয়েছেন। চিঠিতে দুদেশের মধ্যে আলোচনা করে এ বিষয়ে সমাধানে পৌঁছার কথা বলা হয়েছে। এব্যাপারে তিনি সরকারকেও যেকোন সহযোগিতা করার জন্য প্রস্তুত বলে জানিয়েছেন। বাঁধের প্রতিবাদ জানিয়েছে নানান পেশা শ্রেণীর মানুষ। বিরোধী দলের পাশাপাশি সরকারের পক্ষ থেকে কেউ কেউ এর প্রতিবাদ জানিয়েছেন। আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ওবায়েদুল কাদের টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণ চুক্তি স্থগিত করতে ভারতে প্রতি প্রকাশ্যেই আহবান জানিয়েছেন।

টিপাইমুখে বাঁধ হলে ছয়টি নদী হবে ধূ-ধূ বালুচর এমন আশঙ্কা বৃহত্তর সিলেটবাসীর। সিলেটের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া সুরমা, কুশিয়ারা, সুনাই, ধলাই, লোলা ও মনু নদী অস্বাভাবিকভাবে ভরাট হয়ে যাওয়ার কারণে অদূর ভবিষ্যতে এ অঞ্চলের পরিবেশ বিপর্যয় দেখা যাবে। সিলেটের সব প্রধান নদীরই উৎস হচ্ছে ভারতের বিস্তীর্ণ পাহাড়ি এলাকা। এসব নদ-নদীর উৎস এলাকায় বিভিন্ন সময়ে ভারত সরকার পরিকল্পিতভাবে তাদের মতো করে প্রজেক্ট তৈরি করায় এসব নদীর পানি প্রবাহের নিয়ন্ত্রণ চলে গেছে তাদেরই হাতে। ফলে নদীর স্বাভাবিক স্রোত ব্যাহত হচ্ছে। ফলে নদীকেন্দ্রিক মানুষের জীবনে দেখা দিয়েছে এক ধরনের বিপর্যয়। নদী দূষিত হওয়ার ফলে দ্রুত গতিতে মরুকরণের দিকে যাচ্ছে সিলেট। শুকিয়ে যাচ্ছে খাল-বিল, হাওড় ও জলাশয়। পানিও নিম্নস্তরে নেমে গেছে। ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে জীববৈচিত্র্যে ও প্রাকৃতিক ভারসাম্যে। এককালের খরস্রোতা সুরমা নদী এখন বিভিন্ন পয়েন্টে স্রোতহীন খালে পরিণত হয়েছে। টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণের ফলে এ অঞ্চলই বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হবে। শুকিয়ে যাবে নদীগুলো। আর প্রথম থেকেই বৃহত্তর সিলেটবাসীরা প্রতিবাদ জানিয়ে আসছে। বাঁধ নির্মাণের প্রতিবাদে বাংলাদেশে জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) সিলেট জেলা শাখা সিলেটে ১ ডিসেম্বর হরতাল আহবান করেছে। দেশ প্রেমিক সচেতন জনগণের দাবি যৌথ জরিপ ছাড়া এককভাবে যেন কোন সিদ্ধান্ত নেয়া না হয়। প্রতিবেশী বন্ধু রাষ্ট্রের প্রতি বাংলাদেশের জনগণ এরকম দাবি জানাতেই পারে। আমরা প্রধানমন্ত্রীর কথায় বিশ্বাস করতে চাই, তার কথায় আশ্বস্ত থাকতে চাই। প্রতিবেশী দেশ এককভাবে এমনভাবে সিদ্ধান্ত নিবে না যাতে বাংলাদেশের ক্ষতি হয়। দেশের কোনো অঞ্চলই যাতে মরুকরণ না হয় সে ব্যাপারে সরকারের পাশাপাশি বিরোধীদলও কার্যকর ভূমিকা রাখবে এমনটি প্রত্যাশা সবার।