বখাটেদের ছুরিকাঘাতে স্কুল শিক্ষক খুন ॥ প্রতিবাদে উত্তাল বরিশাল ॥ সড়ক অবরোধ – মামলা দায়ের ॥ ছয়জন গ্রেফতার

নিজস্ব সংবাদদাতাঃ বরিশালে মেয়েকে উত্যক্তকারীর ছুরিকাঘাতে স্কুল শিক্ষক ও বীর মুক্তিযোদ্ধা জিন্নাত আলীর (৫৮) মৃত্যুর ঘটনায় রবিবার সকালে নিহতের Jinnat Aliনিজ কর্মস্থল নগরীর রুপাতলী এলাকার এ. ওয়াহেদ বালিকা বিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষিকা ও শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ মিছিল করেছে। একইসময় সাগরদী এলাকায় স্থানীয় বিক্ষব্ধুরা প্রায় ঘন্টাকালব্যাপী সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন। পরে স্থানীয় কাউন্সিলর ও পুলিশের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে আসে। এদিকে মেয়েকে উত্যক্ত করার ঘটনায় গত তিনমাস পূর্বে কাউনিয়া থানায় একটি সাধারন ডায়েরী করেছিলেন শিক্ষক জিন্নাত আলী। ডায়েরী করার পর থানা পুলিশ কোন ব্যবস্থা নেয়নি বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। তবে এ ঘটনা তদন্তে একজন সহকারী পুলিশ সুপারের নেতৃত্বে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। স্কুল শিক্ষক খুনের ঘটনায় পুলিশ এক ছাত্রদল কর্মীসহ ৬ যুবককে গ্রেফতার করেছে।

এ ব্যাপারে রবিবার বিকেলে নিহত জিন্নাত আলীর স্ত্রী কাজী শিরিন আক্তার বাদি হয়ে বখাটে রূপম ওরফে রূপা ও তার একান্ত সহযোগী গ্রেফতারকৃত আরিফুর রহমান মিঠুকে আসামি করে কোতয়ালী মডেল থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেছেন।

নিহতের পরিবারের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়, জিন্নাত আলীর মেয়ে বরিশাল মডেল স্কুল এন্ড কলেজের একাদশ শ্রেণীর ছাত্রী তাজরীন জিন্নাত সুপ্তিকে (১৭) উত্যক্ত করার প্রতিবাদ করার কারনেই বখাটেরা এ খুনের ঘটনা ঘটিয়েছে। এ ঘটনার পর ওই রাতেই (শুক্রবার) পুলিশ অভিযান চালিয়ে রূপমের বন্ধু নগরীর কাউনিয়া সেকশন এলাকার বজলুর রহমানের পুত্র আরিফুর রহমান মিঠু, রিফাত, ভাটিখানা এলাকার বিশ্বজিৎ কুমার রায়, রিমন, রাজন ও অক্সফোর্ট মিশন রোড এলাকার রিফতিকে গ্রেফতার করেছে।

নিহত শিক্ষকের পরিবারের অভিযোগে জানা গেছে, নগরীর বাজার রোড এলাকার সুলতানী বিড়ি ফ্যাক্টরীর পিছনের বাসিন্দা মৃত কৃষ্ণ চন্দ্র দে’র বখাটে পুত্র রূপম ওরফে রূপা (২৭) দীর্ঘদিন থেকে শিক্ষক জিন্নাত আলীর কন্যা কলেজ ছাত্রী সুপ্তিকে উত্যক্ত করে আসছিলো। শুক্রবার রাতে রূপম ও তার সহযোগী মিঠু মটরসাইকেলযোগে এসে জিন্নাত আলীর বাসার সম্মুখে বসে তাকে (জিন্নাত আলীকে) ছুরিকাঘাত করে। নিহত জিন্নাত আলী সাগরদীর চান্দুর মার্কেট এলাকায় ঠিকাদার ইউসুব আলীর ভবনে ভাড়া থাকতেন। তার গ্রামের বাড়ি ঝালকাঠী জেলার নবগ্রাম রোডের বাউকাঠী গ্রামে।

কলেজ ছাত্রী সুপ্তি বিলাপ করে সাংবাদিকদের জানায়, তাকে উত্যক্ত করায় তিনমাস আগে তার পিতা জিন্নাত আলী কাউনিয়া থানায় একটি সাধারন ডায়েরী করেছিলেন। এতে রূপম আরো ক্ষিপ্ত হয়ে মোবাইল ফোনে তাকে ও তার পরিবারকে বিভিন্ন ধরনের হুমকি দিয়ে আসছিলো। শুক্রবার রাতে জিন্নাত আলী সাগরদী থেকে বাজার করে বাসায় ফিরছিলেন। বাসার সামনে পৌঁছার পর পরই মটরসাইকেলে দু’যুবক এসে জিন্নাত আলীর পেটে ছুরি দিয়ে আঘাত করে আবার মটরসাইকেলযোগে পালিয়ে যায়।

সুপ্তি আরো জানায়, পিতার চিৎকার শুনে সে ঘর থেকে বেরিয়ে এসে তাকে রক্তাক্ত অবস্থায় দেখতে পায়। স্থানীয়দের সহযোগীতায় সুপ্তি জিন্নাত আলীকে মেডিকেলে নিয়ে যাওয়ার সময় সে (জিন্নাত আলী) বলেছে, রূপম তাকে ছুরি দিয়ে আঘাত করেছে। আর রূপমের সাথে থাকা যুবককে সে চিনতে পারেনি। সুপ্তির ভাষ্যমতে, তার পিতাকে ছুরি দিয়ে আঘাত করার সময় রূপমের সাথে ছিলো কাউনিয়া সেকশন এলাকার মিঠু নামের অপর এক যুবক। জিন্নাত আলীকে হাসপাতালে নেয়ার পর ওই রাতেই রূপম মোবাইল ফোনে সুপ্তির কাছে জানতে চেয়েছে “তার পিতার মৃত্যু হয়েছে কিনা”? আহত জিন্নাত আলীকে শুক্রবার রাতে শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপতালে ভর্তি করা হয়। উন্নত চিকিৎসার জন্য শনিবার (২৬ নবেম্বর) দুপুরে জিন্নাত আলীকে এ্যাম্বুলেন্সযোগে ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছিলো। পথিমধ্যে গৌরনদী উপজেলা অতিক্রম করার সময় বেলা তিনটার দিকে জিন্নাত আলী মৃত্যুর কোলে ঢলে পরেন।

জিন্নাত আলীর মৃত্যুর সংবাদ বরিশালে পৌঁছার পর পরই সাগরদী এলাকার শত শত জনতা সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করতে থাকে। পরে পুলিশের উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ঘটনাস্থলে পৌঁছে খুনিদের বিচারের আশ্বাস দিয়ে পরিস্থিতি শান্ত করেন।

সুপ্তির অভিযোগে আরো জানা গেছে, তিনমাস আগে রূপমের বিরুদ্ধে কাউনিয়া থানায় সাধারন ডায়েরী করা হলেও পুলিশ কোন আইনগত পদক্ষেপ নেয়নি। কাউনিয়া থানার অফিসার ইনচার্জ ওসি রফিকুল ইসলাম জানান, সাধারন ডায়েরীতে অভিযুক্ত রূপমের ঠিকানা কোতোয়ালী থানার আওতায় হওয়ায় তারা কোন আইনগত ব্যবস্থা নিতে পারেননি। কোতয়ালী মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ ওসি শাহিদুজ্জামান জানান, ওই জিডি কোতয়ালী থানায় করা উচিত ছিলো। কাউনিয়া থানা কর্তৃপক্ষের জিডি গ্রহণ করা উচিত হয়নি। মেট্রোপলিটন পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কমিশনার জিল্লুর রহমান জানান, শিক্ষকের পরিবার যদি থানায় অভিযোগ করেও কোন আইনগত সুবিধা না পেয়ে থাকে তা পুলিশের দায়িত্বে অবহেলার শামিল। বিষয়টি তদন্তের জন্য একজন সহকারী পুলিশ কমিশনারকে প্রধান করে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্ত রিপোর্টের ভিত্তিতে দায়ী অফিসারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। তিনি আরো বলেন, বিষয়টি স্পর্শ কাতর। ঘাতক দুই মটরসাইকেল আরোহী রূপম এবং গ্রেফতারকৃত মিঠু।

এ ব্যাপারে রবিবার বিকেলে নিহত জিন্নাত আলীর স্ত্রী কাজী শিরিন আক্তার বাদি হয়ে বখাটে রূপম ওরফে রূপা ও তার একান্ত সহযোগী গ্রেফতারকৃত আরিফুর রহমান মিঠুকে আসামি করে কোতয়ালী মডেল থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেছেন।

অপরদিকে শিক্ষক জিন্নাত আলীর মৃত্যুর সংবাদে তার নিজ কর্মস্থল নগরীর রুপাতলীর এ. ওয়াহেদ বালিকা বিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষিকা ও শিক্ষার্থীরা রবিবার সকালে বিক্ষোভ মিছিল করেছেন। তারা অনতিবিলম্বে ওই বিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের শিক্ষক জিন্নাত আলীর হত্যাকারী ঘাতকদের গ্রেফতার পূর্বক দৃষ্টান্ত মূলক শাস্তির দাবি করেন।