নিজস্ব সংবাদদাতাঃ ১৯৭১ সনের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে ৩০ লক্ষ শহীদদের আত্মত্যাগ ও মা-বোনদের ইজ্জতের বিনিময়ে বাংলার দামাল ছেলে মুক্তিযোদ্ধারা জীবনবাজি রেখে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ করেছিলো। একপর্যায়ে পাক সেনারা পরাস্ত হয়ে মুক্তিযোদ্ধা ও মিত্র বাহিনীর কাছে ওই বছরের ১৬ ডিসেম্বর আত্মসমর্পন করে। যে কারনে ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীনতা যুদ্ধের বিজয় ঘোষিত হলেও দেশের সর্বশেষ পাকহানাদার মুক্ত হয়েছিলো বরিশালের গৌরনদী। দীর্ঘ ২৮ দিন মুক্তিবাহিনী ও মুজিব বাহিনীর যৌথ আক্রমনের পর ২২ ডিসেম্বর গৌরনদী কলেজে অবস্থানরত শতাধিক পাক সেনা মিত্র বাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেছিলো।
স্বাধীন বাংলাদেশের সর্বশেষ হানাদার মুক্ত গৌরনদীতে ১৯৭৫ সনের ৭ মে তৎকালীন মন্ত্রী আব্দুর রব সেরনিয়াবাত শহীদ মুক্তিযোদ্ধা স্মৃতি সৌধ নির্মানের জন্য ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেছেন। পরবর্তীতে তিনি ওই বছরের ১৫ আগস্ট ভয়ালকালো রাতে শহীদ হন। ফলে থমকে যায় স্মৃতি সৌধ নির্মানের উদ্যোগ। স্বাধীনতা যুদ্ধের দীর্ঘ ৪০ বছরেও সাবেক মন্ত্রী শহীদ আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের সেই স্বপ্ন আজও বাস্তবায়িত হয়নি। গৌরনদীতে আজও নির্মিত হয়নি শহীদ মুক্তিযোদ্ধা স্মৃতি সৌধ। স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা গৌরনদীতে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতি সংরক্ষনে জরুরি ভিত্তিতে স্মৃতি সৌধ নির্মানের জন্য প্রধানমন্ত্রী ও সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।
সেই দিনের স্বাক্ষী বীর মুক্তিযোদ্ধাদের বর্ননায় জানা গেছে, পাক সেনারা অত্র এলাকায় নির্মম হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে পাঁচ সহস্রাধিক নিরীহ জনসাধারনকে হত্যা ও তিন শতাধিক মা-বোনের ইজ্জত হরন করে। ’৭১ সনের ২৫ এপ্রিল পাক সেনারা ঢাকা-বরিশাল মহাসড়ক দিয়ে এ জনপদে প্রবেশের মাধ্যমে হত্যাযজ্ঞ শুরু করে। তাদের প্রবেশের খবর শুনে গৌরনদীর স্বেচ্ছাসেবক দলের কর্মীরা গৌরনদীর সাউদেরখালপাড় নামকস্থানে পাক সেনাদের প্রতিহত করার জন্য অবস্থান নেয়। হানাদাররা সেখানে পৌঁছলে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধের মুখে পরে। সেইদিন (২৫ এপ্রিল) পাক সেনাদের সাথে সম্মুখ যুদ্ধে প্রথম শহীদ হন গৌরনদীর নাঠৈ গ্রামের সৈয়দ হাসেম আলী, চাঁদশীর পরিমল মন্ডল, গৈলার আলাউদ্দিন ওরফে আলা বক্স ও বাটাজোরের মোক্তার হোসেন। মুক্তিযোদ্ধাদের গুলিতে ওইদিন ৮ জন পাক সেনা নিহত হয়। এটাই ছিলো বরিশালসহ গোটা দক্ষিণাঞ্চলে স্থলপথে প্রথম যুদ্ধ এবং এরাই হচ্ছেন প্রথম শহীদ। পাক সেনারা গৌরনদীতে প্রবেশের দ্বার মুখ খাঞ্জাপুর নামস্থানে মোস্তান নামক এক পাগলকে গুলি করে হত্যা করে।
সেইদিনের প্রত্যক্ষদর্শী মুক্তিযোদ্ধা সংগঠক, যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার সৈয়দ মনিরুল ইসলাম বুলেট ছিন্টু, যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযাদ্ধা আব্দুর রব মিয়াসহ অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধাদের দেয়া তথ্যে জানা গেছে, ২৫ এপ্রিল মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে ৮ জন পাকসেনা নিহত হবার পর তারা ক্ষিপ্ত হয়ে এলোপাথাড়ি গুলি ছুঁড়তে থাকে। ওই নরপশুদের গুলিতে সেইদিন দু’শতাধিক নিরীহ গ্রামবাসী মারা যায়। হানাদাররা গৌরনদী বন্দরসহ পাশ্ববর্তী এলাকার শত শত ঘর বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করেছিলো। মে মাসের প্রথম দিকে পাকবাহিনী গৌরনদী কলেজে স্থায়ী ক্যাম্প স্থাপন করে। ক্যাম্পে ছিল আড়াই শতাধিক সৈন্য ও স্থানীয় অর্ধশত রাজাকার-আলবদর।
গৌরনদীর বাটাজোর, ভুরঘাটা, মাহিলাড়া, আশোকাঠী, কসবাসহ প্রতিটি ব্রীজে পাক মিলিটারীদের ব্যাংকার ছিলো। উত্তরে ভুরঘাটা, দক্ষিণে উজিরপুরের শিকারপুর, পশ্চিমে আগৈলঝাড়ার পয়সারহাট, পূর্বে মুলাদী পর্যন্ত গৌরনদী কলেজ ক্যাম্পের পাক সেনাদের নিয়ন্ত্রনে ছিলো। তাদের দোসর ছিলো এলাকার রাজাকার, আলবদর ও পিচ কমিটির সদস্যরা। হত্যাকান্ড, লুটতরাজ, নারী ধর্ষণসহ নানা কাজে এরা পাকসেনাদের সহযোগীতা করে। পাক সেনারা গৌরনদী কলেজের উত্তর পার্শ্বে একটি কূপ তৈরি করে সেখানে লাশ ফেলতো। কলেজের উত্তর পার্শ্বে হাতেম পিয়নের বাড়ির খালপাড়ের ঘাটলায় মানুষ জবাই করে খালের পানিতে শত শত লাশ ভাসিয়ে দেয়া হয়। গার্লস হাইস্কুলের পার্শ্ববর্তী পুল ও গয়নাঘাটা ব্রীজের ওপর বসে শত শত লোক ধরে এনে হত্যা করে লাশগুলো খালে ফেলতো পাক সেনারা।
প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ননায় আরো জানা গেছে, গৌরনদী ও আগৈলঝাড়ার ইতিহাসে সবচেয়ে লোমহর্ষক ঘটনা ঘটেছিলো ’৭১ সনের ১৫ মে। ১৪ মে দোনারকান্দিতে চিত্ত বল্লভের নেতৃত্বে স্থানীয় লোকজন ঢাল শুড়কী নিয়ে পাক হানাদারদের মুখোমুখী ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং ৪ জন পাক সেনাকে কুপিয়ে হত্যা করে। এ ঘটনায় পাকসেনারা ক্ষিপ্ত হয়ে কসবার হযরত মল্লিক দূত কুমার পীর সাহেবের মাজার সংলগ্ন রাস্তা দিয়ে চাঁদশী হয়ে পশ্চিম দিকে শতাধিক পাকসেনা অগ্রসর হয়ে জনতার ওপর এলএমজির ব্রাশ মারে এবং গুলি করে পাখির মতো মানুষ মারতে থাকে। পাক সেনাদের ভয়ে আশে পাশের ৭/৮টি গ্রামের ৪/৫ হাজার মানুষ সেদিন এদিক সেদিক ছোটাছুটি করতে থাকে। রাংতার উত্তর পাশের সু-বিশাল ক্যাতনার বিলের ধান ও পাট ক্ষেতের মধ্যে আশ্রয় নিতে এসে পাক বাহিনীর গুলিতে ওইদিন ৫ শতাধিক নিরীহ গ্রামবাসী প্রান হারায়। নরপশুদের কবল থেকে সেদিন পশুরাও রেহাই পায়নি। শত শত ঘর বাড়িতে অগ্নিসংযোগের ফলে বহু গরু-ছাগল ও হাঁস মুরগী মারা যায় সেদিন। ওইবছরের ২ আষাঢ় আগৈলঝাড়ার কোদালধোঁয়া নামকস্থানে দি রয়েল বেঙ্গল সার্কাসের মালিক লক্ষণ দাস ও তার একটি পোষা হাতিকে পাকসেনারা এক সঙ্গে গুলি করে হত্যা করে।
জুলাই মাসে ৯ নং সেক্টরের গ্রুপ কমান্ডার নিজাম উদ্দিন আকন ও তার বাহিনীর নেতৃত্বে গৌরনদীর বাটাজোরে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে ১০ জন পাকসেনা মারা যায় এবং ৪ জন ধরা পড়ে। পাকসেনাদের গতিরোধ করার জন্য গ্র“প কমান্ডার নিজামের নেতৃত্বে ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কের আশোকাঠী বাসষ্ট্যান্ডের ব্রীজটি মুক্তিযোদ্ধারা ভেঙ্গে দিয়েছিলো অক্টোবর মাসের শেষের দিকে। এর কিছুদিন পর নিজামের নেতৃত্বে হোসনাবাদে পাক বাহিনীর অস্ত্র ও মালবাহী বোটে হামলা চালিয়ে প্রচুর অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধার করেছিল মুক্তিবাহিনীরা। ওইদিন যুদ্ধে প্রায় ২৫ জন পাকসেনা মারা যায়। ৯ নং সেক্টরের গ্রুপ কমান্ডার নিজাম উদ্দিনের নেতৃত্বে গঠিত নিজাম বাহিনীর গ্রুপ কমান্ডের দায়িত্বে ছিলেন বাদশা হাওলাদার, কুতুব উদ্দিন, তাহের কমান্ডার, হামেদ কমান্ডার ও আলাউদ্দিন মিয়া। নিজাম উদ্দিন কৃতিত্বের সাথে স্বাধীনতা যুদ্ধে ৯ নং সেক্টরের গ্র“প কমান্ডার হিসেবে দ্বায়িত্ব পালন করেন। গৌরনদীর কসবায় আল্লাহর মসজিদের নিকট ২৭ নবেম্বর পাক বাহিনীর সাথে বন্দুক যুদ্ধে মোঃ ছাত্তার কমান্ডার গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন। পরেরদিন একইস্থানে দক্ষিণ চাঁদশীর আলতাফ হোসেন শহীদ হন।
গৌরনদী-আগৈলঝাড়া এলাকার কৃষক শ্রমিক নেতা আব্দুর রব সেরনিয়াবাত (সাবেক মন্ত্রী) ও আঃ করিম সরদার (সাবেক এমএলএ) সর্বপ্রথম স্বেচ্ছাসেবক দল গঠন করেন। ওইদলের প্রধান ছিলেন গৈলার মতি তালুকদার, তার সহযোগী ছিলেন পতিহারের নুরু গোমস্তা। কোটালীপাড়ার মুক্তিযোদ্ধা হেমায়েত উদ্দিনের নেতৃত্বে গঠিত হয় হেমায়েত বাহিনী। ওই বাহিনীর নেতৃত্বে আগৈলঝাড়ার শিকির বাজার, রামশীল ও পয়সারহাটে পাক সেনাদের সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মুখে যুদ্ধ হয়।
সবশেষে মুজিব বাহিনীর একটি দল ভারত থেকে প্রশিক্ষণ শেষে দেশে ফিরে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহন করেন। ওই দলের নেতৃত্বে ছিলেন কৃষক নেতা আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের জেষ্ঠপুত্র জাতীয় সংসদের সাবেক চীফ হুইপ আলহাজ্ব আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহ। তার চাচাতো ভাই আঃ রকিব সেরনিয়াবাত, কসবার ফজলুর রহমান হাওলাদার, বিল্লগ্রামের মেজর শাহ আলম তালুকদার ছিলেন তার সহযোগী। গৌরনদী কলেজে পাক সেনাদের ক্যাম্পে মুজিব বাহিনী ও নিজাম বাহিনী যৌথ আক্রমন চালিয়েছিলো। কলেজের পশ্চিম দিক দিয়ে মুজিব বাহিনী ও পূর্বদিক দিয়ে নিজাম বাহিনী আক্রমন করে। দীর্ঘ ২৮ দিন যুদ্ধের পর পাক সেনারা পরাস্ত হয়। একপর্যায়ে ১৯৭১ সনের ২২ ডিসেম্বর গৌরনদী কলেজে অবস্থানরত পাক সেনারা মিত্র বাহিনীর মেজর ডিসি দাসের মাধ্যমে মুক্তিবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পন করে।
রনাঙ্গনের কলম সৈনিক গৌরনদীর সুন্দরদী গ্রামের জন বোস জানান, ২২ ডিসেম্বর গৌরনদীকে পাক হানাদার মুক্ত করার পর স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা আনন্দে আত্মহারা হয়ে পরেন। ওইদিন মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধের সময়ে নিহত রাজাকার, আলবদর ও পাক সেনাদের মাথার খুলী দিয়ে গৌরনদীর বাটাজোরে একটি খুলীর মালা তৈরি করেছিলেন।