অপহৃত সেই নেপালী কন্যাকে অতঃপর বাংলাদেশী রাষ্ট্রীয় দূতাবাসে হস্তান্তর – নেপালী ও বাংলাদেশী কন্যার অপহরণের কাহন

শাহীন হাসান, বরিশালঃ পালিয়ে আসা নেপালী কন্যা পবিত্রাকে অবশেষে পটুয়াখালী কারাগার থেকে মুক্ত করে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় দূতাবাসে হস্তান্তর করার জন্য ঢাকায় নিয়েছে মহিলা আইনজীবী সমিতি। গতকাল বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির বরিশাল বিভাগীয় প্রধান এ্যাডভোকেট কাজী মঞ্জুয়ারা বেগম পবিত্রাকে নিয়ে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। আজ তাকে ঢাকার প্রধঅন সমন্বয়কারী এ্যাডভোকেট সালমা আলীর মাধ্যমে বাংলাদেশের নেপাল রাষ্ট্রদূতে হস্তান্তর করা হবে। সেখান থেকে শীঘ্রই পবিত্রাকে নেপাল পৌঁছানো হবে বলে জানিয়েছে সূত্র।

গত ৩০ নভেম্বর পটুয়াখালী কলাপাড়া সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে নেপালী মেয়ে পবিত্রার জামিন চেয়ে জিম্মাদার হিসেবে আবেদন করে আইনজীবী সমিতি। আবেদনের প্রেক্ষিতে আদালতের বিচারক পবিত্রাকে জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির বরিশাল বিভাগীয় প্রধান এ্যাড. কাজী মঞ্জুয়ারা বেগমের নিকট নেপালে পৌঁছে দেয়ার শর্তে জিম্মা প্রদান করেন। পটুয়াখালী কারাগারে ওই আদেশের কপি জমা দিয়ে গতকাল পবিত্রাকে কারামুক্ত করে বরিশালে নিয়ে আসা হয়। পরে রাতেই ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয় তারা।

জানা গেছে, কলাপাড়া ধুলসারা এলাকার চেয়ারম্যানের সহায়তায় গত ২২ নভেম্বর বিকালে পালিয়ে আসা মেয়ে নেপালী কন্যা পবিত্রা ও বাংলাদেশী মাফিয়াকে কলাপাড়া থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। ঘটনায় একটি সাধারণ ডায়েরি করে তাদেরকে কেন্দ্রীয় পটুয়াখালী কারাগারে পাঠানো হয়। তারা দু’জন পাচারকারী চক্রের হাত থেকে পালিয়ে এসে মাফিয়ার গ্রামের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিল। পবিত্রার বাড়ি নেপালের দানজিল্লার এলাকার মল্লার বজপুর গ্রামে। পবিত্রার স্বামী মানসিং দৌদী প্রবাসী। সূত্র জানায়, প্রায় ৪ মাস পূর্বে নেপাল থেকে পবিত্রার স্বামীর নিকট সৌদী আরবে যাওয়ার জন্য নেপাল বিমান বন্দরে যায়। সেখান থেকে পাচারকারী চক্রের হাতে বন্দি হয় তারা। পাচারকারী চক্রের খপ্পরে পড়ে পবিত্রা, মাফিয়া সহ ২ ভারতী কন্যাকে বিক্রি করা হয় একটি পতিতালয়ে। সেখানে প্রায় দেড় মাস একটি বদ্ধ ঘরে আটকে রেখে জোর পূর্বক দেহ ব্যবসা করানো হয় তাদেরকে। বাংলাদেশের মাফিয়া, নেপালের পবিত্রা ও ভারতের দুই যুবতী মিলে জোট বেধে পতিতালয় থেকে কৌশলে পালিয়ে যায়। সেখান থেকে দু’জন ভারত আর দু’জন বাংলাদেশে চলে আসে।

জানা যায়, নেপালী ওই কন্যা পবিত্রার বছর তিন আগে বিয়ে হয় সেখানকার মানসিং এর সাথে। মানসিং জীবিকা নির্বাহের জন্য সৌদি আরবে চাকুরী করেন। স্ত্রীকে সৌদি নেয়ার জন্য পাসপোর্ট করাতে বললে সে মোতাবেক পবিত্রা পাসপোর্ট করেন এবং ভিসা লাগান সৌদী স্বামীর কাছে যাওয়ার জন্য। কিন্তু নিয়তির নিষ্ঠুর আচরণ তাকে নিয়ে যায় পতিতালয়ে। নেপালের পবিত্রার সাথে হিন্দি ভাষায় কথা বললে তিনি এই প্রতিবেদককে জানায়, মা-বাব, চার ভাই ও ১ বোনকে নিয়ে সংসার তাদের। বড় ভাই পুলিশে চাকুরী করেন, আরেকজন শিক্ষক, অপর দুই জন পড়াশুনা করেন। পবিত্রা যখন ক্লাস সপ্তম শ্রেণীতে পড়েন তখন তার বিয়ে হয়। বিয়ের পর আর পড়াশুনা করেনি পবিত্রা। শ্বশুর বাড়িতে থাকা অবস্থায় পবিত্রা মাঠে কৃষি কাজ এবং ঝিলে মাছ ধরতেন। প্রতিদিন পবিত্রাকে ফলো করতো নেপালী এক পতিতা ব্যবসায়ী। পবিত্রা যেদিন সৌদির উদ্দেশে রওয়ানা হয় এয়ারপোর্টের ভিতর ঢোকা মাত্রই তাকে দুই পুরুষ ও দুই মহিলা অপহরণ করে। পবিত্রা আরো জানায়, প্রথমে তাকে ধরে মুখ বেধে ফেলে অচেতন করে নিয়ে যাওয়া হয়। সে সময় চারজনের মধ্যে থেকে একজনকে চিনে ফেলেন পবিত্রা। পবিত্রা জ্ঞান ফিরে দেখতে পায় পাহাড়ের নিচে ঝর্নার সামনে বিবস্ত্র অবস্থায় পড়ে আছে। তার পাশে ৪ জন দাঁড়ানো। পরে তাকে বোম্বের এক দালালের কাছে বিক্রি করা হয়। নেপাল থেকে তাকে যখন বোম্বে আনা হয় তখনও তার কোন জ্ঞান ছিল না। বোম্বে দেড় মাস তাকে আটকে রেখে নিষ্ঠুর নির্যাতন করে তাকে পতিতা ব্যবসা করতে বাধ্য করা হয়েছিল। সেখানে বসে পরিচয় হয় বাংলাদেশী মাফিয়া সহ দুই জন ভারতীয় নারীর সাথে। তারা ৪ জন এক হয়ে চাবি চুরি করে গভীর রাতে দরজা খুলে পালায়। এক পর্যায়ে তারা ভয়ে ম্যানহলের ভিতরে আশ্রয় নিয়ে দুই রাত, দু’দিন কাটিয়ে দেয়। পরে বের হয়ে একটি গাছের উপরে উঠে একটা বাসার ছাদে যায়। সে বাসার কর্মকর্তা একজন পুলিশ অফিসার। তাকে সব কথা খুলে বললে তিনি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলে তার সহযোগিতায় ওরা ভারতে আসে। ভারতে আসার পরে ভারতী দু’জন চলে যায় তাদের বাসায়। নিরুপায় হয়ে নেপালী পবিত্রা ও বাংলাদেশী মাফিয়া প্রায় দু’দিন ভারতে অবস্থানের পরে বাংলাদেশ ও ভারত সীমান্তে চলে আসে ভারতীয় দুই কন্যার সাহায্যে। সেখানে এসে পড়তে হয় নতুন সমস্যায়। বাংলাদেশী মাফিয়ার সাথে পবিত্রা আসতে চাইলে সীমান্ত পুলিশ তাদের আটকে দেয়। শেষে ৪ হাজার রূপীয়া ঘুষ দিয়ে পবিত্রা ও মাফিয়া বাংলাদেশে পৌঁছে লঞ্চযোগে মাফিয়ার বাড়ি বরিশাল পটুয়াখালী জেলার কলাপাড়া চলে যায়। সেখানকর চেয়ারম্যানকে বিষয়টি জানালে পুলিশের সহায়তায় পরে বিষয়টি মহিলা আইনজীবী সমিতিতে জানানো হয়।

বাংলা না জানা হিন্দী ভাষী নেপালী মেয়ে পবিত্রা বরিশাল মহিলা আইনজীবী সমিতির কার্যালয়ে সাংবাদিকদের সামনে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে আর কিছু বলতে পারেনি। পবিত্রা জানায়, তার মনে এখন একটাই ভয়, তার স্বামী কি তাকে গ্রহণ করবে?