৬ই ডিসেম্বর কলাপাড়া যেভাবে মুক্ত হয়েছিল

বিশ্বাস শিহাব পারভেজ মিঠু, কলাপাড়াঃ আজ ৬ই ডিসেম্বর কলাপাড়া মুক্ত দিবস। বিজয়ের এ মাসে তৎকালীণ ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে কলাপাড়া আক্রমানকারী যুদ্ধকালীণ একাংশের পরিচালনাকারী জাতীয় সাংবাদিক মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কলাপাড়া উপজেলা কমান্ডের ডেপুটি কমান্ডার হাবিবুল্লাহ রানা দৈনিক বাংলার বনে পত্রিকার সাথে একান্ত সাক্ষাৎকারে কলাপাড়া যেভাবে মুক্ত হয়েছিল তার স্মৃতিচারণ করেন এভাবেই- মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা আমাদের সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন। পাকিস্তান হানাদার বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসর মুসলিম লীগ-জামায়াতে ইসলামী ইত্যাদি স্বাধীনতাবিরোধী দলের সৃষ্টি রাজাকার, আলবদর, আল-শামস, তথাকথিত শান্তি কিমিটি ১৯৭১-এ বাংলাদেশে হিংস্র হায়েনার ভূমিকা পালন করেছিলো। এদের বিরুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধারা দূর্বার সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তোলে এবং ১৬ ডিসেম্বর চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হয়। এই বিজয়ের পেছনে রয়েছে ৩০ লাখ বাঙালীর আত্মদান ও ২ লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমহানি।

মুক্তিযুদ্ধে কলাপাড়া মুক্ত হয়েছিলো ৬ ডিসেম্বর। এর আগে ৩রা ডিসেম্বর আমরা গলাচিপা থানা আক্রমণ ও বিজয় অর্জনের পর সতর্কাবস্থায় থাকাকালীণ ৪ঠা ডিসেম্বর পড়ন্ত বিকেলে আরেক প্রায়-যুদ্ধাবস্থার মুখোমুখি হই। পটুয়াখালীর দিক থেকে গানবোট-সাদৃশ্য একটি জাহাজ পাকিস্তানী পতাকা উড়িয়ে গলাচিপার দিকে আসতে থাকে। নদীর পাড়ের ব্যাংক্যারগুলোয় আমরা কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা অবস্থান নিই। জাহাজটি কাছাকাছি এসেও যখন কোন রকম ফায়ার করছে না, তখন লক্ষ করি, জাহাজে পাকিস্তানী পতাকা ছাড়াও ইউএনও লেখা নীল রংয়ের জাতিসংঘের পতাকাও রয়েছে। জাহাজটির নাম ‘ভাট্টি’। ব্যাংকারের একেবারে কাছে নদীর কুলঘেঁষে এসে জাহাজের গতি একেবারেই কমিয়ে দেয়া হয়। আমরা কোন গুলী না ছুঁড়ে দরাজকন্ঠে জানতে চাই “তোমরা কারা”? নোয়াখালীর বৃদ্ধ নাবিক বলে ওঠে, “আমরা জাতিসংঘের এবং এতে নিরস্ত্র ৮/১০ জন থাইল্যান্ডের নাগরিক রয়েছেন। তারা পর্যবেক্ষণে এসেছেন। ওদেরকে সারেন্ডার করিয়ে গলাচিপা থানার সিও (ডেভ.)-এর কাছে সোপর্দ করে ‘ভাট্টি’-কে ক্যাপচার করে নিই। ৪ তারিখ রাতে মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার নূরুল হুদা ও ডেপুটি কমান্ডার হাবিবুর রহমান শওকত সিদ্ধান্ত নেন যে, এই জাহাজে চড়েই পটুয়াখালী আক্রমণে যাওয়া হবে। বেঁকে বসি আমরা, ভারতের উত্তর প্রদেশে গেরিলা ট্রেনিংপ্রাপ্ত কলাপাড়ার ৬ জন বাংলাদেশ লিবারেশন ফ্রন্টের (বিএলএফ) মুক্তিযোদ্ধা আমি জোরালোভাবে যুক্তি দেখাই যে, পেছনে অর্থাৎ কলাপাড়ায় শত্রু রেখে সম্মুখে এগোনো গেরিলা যুদ্ধের পরিপন্থী। এতে মোক্ষম কাজ হয়। অনেক দেন-দরবারের পর সিদ্ধান্ত হয়, ৫ই ডিসেম্বর রোববার সন্ধ্যায় কলাপাড়া থানা আক্রমন করা হবে। আক্রমন পরিচালনাকারী নিযুক্ত করা হয় আমাকে। ‘ভাট্টি’ ও আরেকটি ড্রেজার বাহন নিয়ে ৫১ জন মুক্তিযোদ্ধা কলাপাড়ার উদ্দেশ্যে গলাচিপা ত্যাগ করি। সন্ধ্যানাগাদ আমি জাহাজ দু’টি আমার বাড়ী ইটবাড়ীয়ায় ভেড়াই। উদ্দেশ্য, কলাপাড়ার পরিস্থিতি ও শত্র“-অবস্থান সম্পর্কে জ্ঞাত হওয়া। এর আগে অবশ্য  আমারই সহযোদ্ধা এস,এম নজমুল হুদা সালেককে কলাপাড়ায় রেকি করতে পাঠানো  হয়।  কুদ্দুস  নামের  এক  সাহসী  মুক্তিযোদ্ধাকে সাথে  নিয়ে  সশস্ত্র  অবস্থায়  আমার  বাড়ী  যাই। গিয়ে শুনতে পাই, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে চরমপত্র কেবল শুরু হয়েছে। এক আত্মীয় বলে যে, সেনাবাহিনীতে কর্মরত আমার দুই সহোদর ভাই বাড়ীতে অবস্থান করছেন। যুদ্ধের ট্যাকটিস আমি তৎক্ষণাৎ পরিবর্তন করে ফেলি। দুই ভাইকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পোশাক পরিহিত অবস্থায় মেশিনগানসহ ‘ভাট্টি’-তে পাকিস্তানী পতাকা উড্ডীন করে উঠিয়ে দিই। মুক্তিযোদ্ধাদের দু’টি ভাগে  বিভক্ত  করে  এক  দলে  আমি  হাবিবুল্লাহ  রানা, নূরুল হুদা, ভারতের উত্তর প্রদেশ (ইউ,পি) ট্রেন্ড রেজাউল করিম বিশ্বাস, এস,এম, নজমুল হুদা সালেক ও কামাল পারভেজসহ ২৩ জন, যারা থানার পিছন থেকে সরাসরি আক্রমন  করবো  এবং  অন্য  দলে  ইউপি  ট্রেন্ড  শাহ আলম তালুকদার, হাবিবুর রহমান শওকত, ইউপি ট্রেন্ড সাজ্জাদ হোসেন বিশ্বাস ও আরিফুর রহমান মুকুল খানসহ বাকীরা ওয়াপদার কর্ণার থেকে কোণাকোনি আক্রমণ করবে। আমরা সকলেই পদব্রজে গিয়ে কলাপাড়ার কবরস্থানের  উত্তর-পশ্চিম  পাশে  প্রথমে  অবস্থান  নেবো এবং ওখান থেকে দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে যার যার অবস্থানে চলে  যাবো। ওপেনিং ফায়ার করবো আমি। সেদিনের পাস ওয়ার্ড ছিলে ‘কলাপাতা’। পাস ওয়ার্ড হচ্ছে যুদ্ধাবস্থায় নিজেদের যোদ্ধাকে ওই শব্দ উচ্চারণে চেনা এবং ফায়ার উইথড্রল সাইন’। কমান্ডার বা নিযুক্ত যোদ্ধা সজোরে পাসওয়ার্ড উচ্চারণ করলে নিজেদের নির্ধারিত আস্তানায় ফিরে যাওয়া। সেটি ছিলো আমারই দায়িত্ব। ওদিকে ‘ভাট্টি’র  প্রতি  নির্দেশ  ছিলো,  আমাদের  মার্চ করার আধা ঘন্টা পর ইটবাড়িয়া থেকে কলাপাড়ার উদ্দেশ্যে রওনা দেবে। থানার পেছনের খাল পাড় হয়ে পজিশনে যাবার প্রাক্কালে আমার দলটি বিপাকে পড়ে। কথা ছিলো কাঠের পুলটির  ওপর  দিয়ে আমরা আমাদের পজিশনে যাবো এবং  যেহেতু  তখন  ভাটা  ছিলো, শাহ  আলমের  দলটি খাল পাড় হয়ে তারা ওয়াপদার পজিশনে যাবে।

এখানে একটি কথা বলে রাখা দরকার যে, আমরা ৬ জন যেহেতু কলাপাড়াবাসী, সেহেতু দুই দলে আমরা ভাগাভাগি হয়েই ছিলাম।  কাঠের  পুলের  দিকে  যেতে যেই না রাস্তার ওপর  আমি  ও  রেজাউল  উঠে  গেছি,  অমনি  রমিজ উদ্দিন বেপারীর বাসার ওখানটা থেকে দু’জন রাজাকার আমাদের দিকে টর্চ জ্বালিয়ে একটি থ্রি নট থ্রি রাইফেল তাক করে ‘কারা’, ‘পেট্রোল’ বলে চেঁচিয়ে ওঠে? টর্চের স্পষ্ট  আলোয়  আমাদেরকে  তৎক্ষনাৎ  রাজাকাররা যেমনি  দেখতে পাচ্ছিল, আমরাও রাইফেলের নল দেখতে পাচ্ছিলাম। ঐ রাইফেলের ট্রিগারে চাপ পড়লে আমি অথবা রেজাউল বিশ্বাস নির্ঘাৎ গুলীবিদ্ধ হতাম। কিন্তু না, কামাল পারভেজ ত্বরিত গতিতে ওদের প্রতি ফায়ার করে দেন এবং রাজাকাররা ‘ও মাগো’ বলে লুটিয়ে পড়ে। ততক্ষণে আমরা লাইং পজিশনে চলে গেছি। নিয়ম অনুযায়ী কামাল পারভেজের (পরবর্তীতে চলচ্চিত্র নায়ক ও প্রযোজক) ফায়ার করাটা যুদ্ধের নিয়ম অনুযায়ী সিদ্ধ ছিলো না। সে যাই হোক, ওয়াপদার ওখান থেকে শুরু হয়ে যায় গুলীবর্ষণ। আমার গ্র“প থেকে দু’তিন মিনিট পর শুরু হয় প্রচন্ড গুলীবর্ষণ। থানার ছাদ থেকে ও নিচে ব্যাংকার থেকে পাল্টা গুলী শুরু হয় মিনিট পনেরো পর থেকে। এ সময় পূর্বাকাশে চন্দ্রের দেখা মেলে। ঘড়িতে চোখ ফেলে দেখি রাত পৌনে ৮টা। সার্চ লাইটের প্রচন্ড আলো বিকিরণ করে ‘ভাট্টি’ যখন থানার দক্ষিণ পাশে নদীতে অবস্থান নেয়, তখন রাত ৯টা। ভাটার কারণে ওটি আটকা পড়ে গিয়েছিলো। জোয়ার আসার পর তা ইটবাড়ীয়া থেকে অবমুক্ত হয়।

এই জাহাজে আমার দুই আর্মি সৈনিক ভাইকে দিয়ে যে প্লান করেছিলাম, সেটিও ভেস্তে যায়। আমরা আক্রমণ করার কিছুক্ষণ আগে ‘ভাট্টি’ আসবে এবং সার্চ লাইটের আলোর সামনে সেনা পোশাক পরিহিত অবস্থায় দাঁড়িয়ে আমর দু’ভাই নায়েক আহম্মদ আলী ও নায়েক আশরাফ আলী উর্দুতে চিৎকার করে সিদ্দিক বিহারীকে এক মালাই নৌকাগুলোতে চড়ে রাজাকার ও শান্তি কমিটির সদস্যদের নিয়ে জাহাজে উঠতে বলবেন। জাহাজটি তখন নদীর মাঝ বরাবর অবস্থান নেবে। সিদ্দিক বিহারীর প্রতি তাদের ওই নির্দেশের পরপরই আমি ফায়ার স্টার্ট করবো। এতে ভয় পেয়ে ওরা জাহাজমুখো হবে এবং এলএমজি’র ব্রাশ ফায়ারে আন্ধারমানিক নদীর পানিতেই পাক হানাদার বাহিনীর দোসরদের কবর রচিত হবে। কিন্তু প্রচন্ড গোলাগুলীর মধ্যে সে পরিকল্পনা ব্যর্থ হলে জাহাজ থেকে থানার ওপর সরাসরি আক্রমণ চালানো হয়। শুরু হয় কলাপাড়া থানার দোতলা লাল বিল্ডিং-এর দিকে মুক্তিযোদ্ধাদের ত্রিমুখী আক্রমণ। এক সময় লক্ষ্য করলাম, থানার ছাদ থেকে যেসব গুলী আমাদের দিকে আসছে, তা অনেক ওপর দিয়ে চলে যাচ্ছে। আমার গ্র“পের ফায়ার স্টপ করে আমি রাজাকার কমান্ডার সেরাজের না ধরে নিজের পরিচয় দিয়ে  ‘জয় বাংলা’ বলে সারেন্ডারের আহ্বান জানাই। থানার ব্যাংকার থেকে সেরাজ বলে ওঠে, ‘হাবিব ভাই, আমরা বিপদে আছি, ছাদের ওপর থেকে গুলী থামানোর ব্যবস্থা করেন। জীবনের প্রতি আরেকটি রিস্ক নিলাম। দু’টি থার্টি সিক্স এইচই হ্যান্ড গ্রেনেড নিয়ে থানার সংগে সংযোগকারী সরু রাস্তাটিকে আড় করে ক্রলিং দিয়ে থানার পেছনের টয়লেটে গিয়ে হাজির হই। শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে একটি গ্রেনেড ছুঁড়ে মারি থানার ছাদকে উদ্দেশ্য করে। দূর্ভাগ্য সেটি ছাদে না গিয়ে নিচে রাজাকারের একটি ব্যাংকারে পড়ে। বিকট শব্দে ব্লাস্ট হয়। ওখানে মনা নামে এক রাজাকারের মৃত্যু ঘটে ও অন্য দু’জন গুরুতর আহত হয়। অন্য গ্রেনেডটি পায়খানার মধ্যে রেখেছিলাম। খুঁজে সেটি আর পাইনি। বিষ্টার মধ্যে ডুবে গেছে। মল পরিবেষ্টিত হয়ে পজিশনে ফিরে এসে আবার গ্রুপের মুক্তিযোদ্ধাদের ফায়ারের নির্দেশ দেই। এভাবে রাত আড়াইটা পর্যন্ত চলে গোলাগুলী। অতঃপর কমান্ডার নূরুল হুদার নির্দেশে পৌনে তিনটার দিকে ফায়ার উইথড্রলের ঘোষণা দিয়ে সকলে সেই ইটবাড়িয়ার নদীর পাড়ে চলে যাই।

‘ভাট্টি’-কে সংকেত দেয়ার পর সেটিও যথাসময়ে ফিরে আসে। আমরা গলাচিপার উদ্দেশ্যে পাড়ি জমাই। ৬ই ডিসেম্বর ভোরবেলা পুলিশ ও রাজাকাররা তৎকালীণ আওয়ামীলীগ নেতা ডাঃ আবুল কাসেম ও মোশাররফ হোসেন বিশ্বাসের কাছে অস্ত্রশস্ত্র হস্তান্তর  করে পালিয়ে যায়। ছালাউদ্দিন ভাই ও মেসবাহ উদ্দিন ভাই সোমবার বিকেলে গলাচিপা গিয়ে আমার কাছে ওই চাবি উঠিয়ে দেন। ৭ই ডিসেম্বর মঙ্গলবার আমরা ‘ভাট্টি’ জাহাজযোগে কলাপাড়া এসে ৯১টি রাইফেল, দু’টি চাইনীজ এলএমজি, দু’টি রিভলবার তিনটি পিস্তল এবং প্রচুর গুলী উদ্ধার করে সিদ্দিক বিহারী, আতাউল্লাহ বিহারী, নূরুল ইসলাম খলিফা, মেহেরুদ্দীন মাষ্টার, কেরামত আলী হাওলাদার এই ৫জন পাকিস্তানী দালালসহ পটুয়াখালীর উদ্দেশ্যে রওনা দিই।

স্বরণযোগ্য যে, জাহাজে উঠানোর সময় একটি রাইফেল আন্ধার মানিক নদীতে পড়ে যায়, যেটি এখন পর্যন্ত উদ্ধার হয় নি। মঙ্গলবার বিকেলে আমরা শত্রুর অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে কলাপাড়া ত্যাগ করার পর সন্ধ্যায় মোয়াজ্জেম হোসেনের নেতৃত্বে অন্য একদল মুক্তিযোদ্ধা কলাপাড়া এসে ‘হাতেম আলী হাতেম আলী’ নামে খালি মাঠে শ্লোগান দিয়োছিলো।