নিজস্ব সংবাদদাতা ॥ ১৯৭১ সনের ১৬ ডিসেম্বর দেশের বিজয় ঘোষিত হলেও বরিশালের গৌরনদী পাকহানাদার মুক্ত হয়েছে ২২ ডিসেম্বর। বাংলাদেশের মধ্যে সর্বশেষ পাকহানাদার মুক্ত হয় গৌরনদী। দীর্ঘ ২৮ দিন মুক্তিবাহিনী ও মুজিব বাহিনীর সদস্যদের যৌথ আক্রমণের পর ওইদিন (২২ ডিসেম্বর) গৌরনদী কলেজের স্থায়ী ক্যাম্পে অবস্থানরত শতাধিক পাক সেনারা মিত্র বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেছিল।
১৯৭১ সনে যুদ্ধ শুরুর পর পরই দক্ষিণাঞ্চলের কৃষক শ্রমিক নেতা আব্দুর রব সেরনিয়াবাত (সাবেক মন্ত্রী), আঃ করিম সরদার (সাবেক এমএলএ) সর্বপ্রথম স্বেচ্ছাসেবক দল গঠন করেন। ওই দলের প্রধান ছিলেন গৈলার মতি তালুকদার, তার সহযোগী ছিলেন পতিহারের নুরু গোমস্তা। ওই বছরের ২৫ এপ্রিল পাক সেনারা ঢাকা-বরিশাল মহাসড়ক দিয়ে এ জনপদে প্রবেশের মাধ্যমে হত্যাযজ্ঞ শুরু করে। তাদের প্রবেশের খবর শুনে গৌরনদীর স্বেচ্ছাসেবক দলের কর্মীরা গৌরনদীর সাউদের খালপাড় নামকস্থানে পাক সেনাদের প্রতিহত করার জন্য অবস্থান নেয়। পাক সেনারা সেখানে পৌঁছলে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধের মুখে পরে। ওইদিন পাক মিলিটারীদের সাথে সম্মুখ যুদ্ধে প্রথম শহীদ হন গৌরনদীর নাঠৈ গ্রামের সৈয়দ আবুল হাসেম, চাঁদশীর পরিমল মন্ডল, গৈলার আলাউদ্দিন ওরফে আলা বক্স, বাটাজোরের মোক্তার হোসেন হাওলাদার। মুক্তিযোদ্ধাদের গুলিতে ওইদিন ৮ জন পাকসেনা নিহত হয়েছিলো। বরিশালসহ গোটা দক্ষিণাঞ্চলে স্থলে পথে এটাই ছিল প্রথম যুদ্ধ আর উল্লেখিত চারজনই হচ্ছেন প্রথম শহীদ।
যুদ্ধ শুরুর পর পরই গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ার মুক্তিযোদ্ধা হেমায়েত উদ্দিনের নেতৃত্বে গঠিত হয় হেমায়েত বাহিনী। তিনি সর্বপ্রথম অত্র অঞ্চলে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেন। তার নেতৃত্বে শিকির বাজার, রামশীল ও পয়সারহাটে পাক সেনাদের সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মুখ যুদ্ধ হয়। পরবর্তীতে গৌরনদীর হোসনাবাদ গ্রামের নিজাম উদ্দিন আকনের নেতৃত্বে ৬০/৭০ জন মুক্তিবাহিনীর একটি দল ভারত থেকে প্রশিক্ষণ শেষে গৌরনদী ও আগৈলঝাড়ায় আসেন। নিজাম উদ্দিন কৃতিত্বের সাথে স্বাধীনতা যুদ্ধে ৯ নং সেক্টরের সাব সেক্টর কমান্ডার হিসেবে দ্বায়িত্ব পালন করেন। সর্বশেষে মুজিব বাহিনীর একটি দল ভারত থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশে ফিরে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। ওই দলের নেতৃত্বে ছিলেন আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ (সাবেক চীফ হুইপ), তার চাচাতো ভাই আব্দুর রকিব সেরনিয়াবাত, কসবার ফজলুর রহমান হাওলাদার, বিল্লগ্রামের মেজর (অবঃ) শাহ আলম তালুকদার ছিলেন তার সহযোগী।
পাক সেনারা অত্র এলাকায় নির্মম হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে পাঁচ সহস্রাধিক নিরীহ জনসাধারণকে হত্যা করে। পাকবাহিনী এসব এলাকার তিন শতাধিক মা-বোনের ইজ্জত হরণ করছিল। ২৫ এপ্রিল এ জনপদে প্রবেশের সময় পাক সেনারা গৌরনদীর প্রবেশ দ্বার মুখ খাঞ্জাপুরে মোস্তান নামের এক পাগলকে গুলি করে হত্যা করেছিলো। ওইদিন মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে ৮ জন পাক সেনা নিহত হবার পর তারা (পাক সেনারা) ক্ষিপ্ত হয়ে এলোপাথাড়ি গুলি ছুঁড়তে থাকে। তাদের গুলিতে ওইদিন দু’শতাধিক লোক মারা যায়। হানাদাররা গৌরনদী বন্দরসহ শত শত ঘর বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করেছিল। মে মাসের প্রথম দিকে পাকবাহিনী গৌরনদী কলেজে স্থায়ী ক্যাম্প স্থাপন করে। ক্যাম্পে ছিলো আড়াই শতাধিক সৈন্য ও ৫০ জনের মত রাজাকার, আলবদর। বাটাজোর, ভুরঘাটা, মাহিলাড়া, আশোকাঠী, কসবাসহ প্রতিটি ব্রীজে পাক মিলিটারীদের বাংকার ছিল। উত্তরে ভুরঘাটা, দক্ষিণে উজিরপুরের শিকারপুর, পশ্চিমে আগৈলঝাড়ার পয়সারহাট, পূর্বে মুলাদী পর্যন্ত গৌরনদী কলেজ ক্যাম্পের পাকসেনাদের নিয়ন্ত্রণে ছিল। এদের দোসর ছিলো এলাকার রাজাকার, আলবদর ও পিচ কমিটির সদস্যরা। হত্যাকান্ড, লুটতরাজ, নারী ধর্ষণসহ নানা কাজে এরা পাকসেনাদের সহযোগীতা করতো। পাক সেনারা গৌরনদী কলেজের উত্তর পার্শ্বে একটি কূপ তৈরি করে সেখানে লাশ ফেলতো। কলেজের উত্তর পার্শ্বে হাতেম পিয়নের বাড়ির খালপাড়ের ঘাটলায় মানুষ জবাই করে খালের পানিতে ভাসিয়ে দেয়া হতো। গৌরনদী গালর্স হাইস্কুলের পার্শ্ববর্তী পুল ও গয়নাঘাটা ব্রীজের ওপর বসে মানুষ খুন করে খালে ফেলতো পাক সেনারা।
প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ননায় জানা গেছে, শত শত লোক ধরে এনে ওইসবস্থানে হত্যা করা হতো। গৌরনদী ও আগৈলঝাড়ার ইতিহাসে সবচেয়ে লোমহর্ষক ঘটনা ঘটেছিল ১৯৭১ সনের ১৫ মে। ১৪ মে দোনারকান্দিতে চিত্ত বল্লভের নেতৃত্বে স্থানীয় লোকজন ঢাল শুড়কি নিয়ে পাক হানাদারদের মুখোমুখী ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং ৪ জন সেনাকে কুপিয়ে হত্যা করে। এ ঘটনায় পাকসেনারা ক্ষিপ্ত হয়ে কসবার হযরত মল্লিক দূত কুমার পীর সাহেবের মাজার সংলগ্ন রাস্তা দিয়ে চাঁদশী হয়ে পশ্চিম দিকে শতাধিক পাকসেনা অগ্রসর হয়ে জনতার ওপর এলএমজির ব্রাশ মারে এবং গুলি করে পাখির মতো মানুষ মারতে থাকে। পাক সেনাদের ভয়ে সেদিন আশ পাশের ৭/৮টি গ্রামের ৪/৫ হাজার মানুষ এদিক সেদিক ছুটাছুটি করতে থাকে। রাংতার উত্তর পাশের সু-বিশাল কেতনার বিলে ধান ও পাট ক্ষেতের মধ্যে আশ্রয় নিতে এসে পাক বাহিনীর গুলিতে ওইদিন ৫ শতাধিক লোক প্রাণ হারায়। নর পশুদের কবল থেকে সেদিন পশুরাও রেহাই পায়নি। ওইদিন শত শত ঘর-বাড়িতে অগ্নিসংযোগের ফলে বহু গরু-ছাগল ও হাঁস মুরগী মারা যায়। ২ আষাঢ় কোদালধোঁয়া নামকস্থানে দি রয়েল বেঙ্গল সার্কাসের মালিক লক্ষণ দাস ও তার ১টি পোষা হাতিকে পাকসেনারা এক সাথে গুলি করে হত্যা করে। জুলাই মাসে বাটাজোরে নিজাম বাহিনীর নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীর সাথে সম্মুখ যুদ্ধে ১০ জন পাকসেনা মারা যায় এবং ৪ জন ধরা পরে।
পাকসেনাদের গতিরোধ করার জন্য ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কের আশোকাঠী বাসষ্ট্যান্ডের ব্রীজটি মুক্তিযোদ্ধারা ভেঙ্গে দিয়েছিল অক্টোবর মাসের শেষের দিকে। মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার নিজামের নেতৃত্বে ব্রীজটি সম্পূর্ণরূপে উড়িয়ে দেয়া হয়েছিল। কিছুদিন পর নিজামের নেতৃত্বে হোসনাবাদে পাক বাহিনীর অস্ত্র ও মালবাহী বোটে হামলা চালিয়ে মুক্তিবাহিনীরা প্রচুর অস্ত্র উদ্ধার করেছিল। ওইদিন যুদ্ধে প্রায় ২৫ জন পাকসেনা মারা যায়। মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার নিজামউদ্দিনের সাথে অংশ গ্রহণকারী অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধারা হলেন গ্র“প কমান্ডার বাদশা হাওলাদার, কুতুব উদ্দিন, তাহের কমান্ডার, হামেদ কমান্ডার, আলাউদ্দিন মিয়া। গৌরনদীর কসবায় আল্লাহর মসজিদের নিকট ২৭ নবেম্বর পাক বাহিনীর সাথে বন্দুক যুদ্ধে মোঃ ছাত্তার কমান্ডার গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন। পরের দিন একইস্থানে দক্ষিণ চাঁদশীর আলতাফ হোসেন শহীদ হয়েছেন।
সারাদেশে ১৬ ডিসেম্বর হানাদার মুক্ত হওয়ার পর স্বাধীনতার বিজয় ঘোষিত হলেও ওই সময় গৌরনদী ছিলো পাক সেনাদের দখলে। সবশেষে গৌরনদী কলেজে নিজাম বাহিনী ও মুজিব বাহনীর যৌথ প্রচেষ্টায় আক্রমণ চালানো হয়। পশ্চিম দিক থেকে মুজিব বাহিনী ও পূর্বদিক থেকে নিজাম বাহিনী আক্রমণ করে। একটানা ২৮দিন যুদ্ধের পর পাক সেনারা পরাস্ত হয়। এক পর্যায়ে ১৯৭১ সনের ২২ ডিসেম্বর মিত্র বাহিনীর মেজর ডিসি দাসের মাধ্যমে মুক্তিবাহিনীর কাছে গৌরনদী কলেজের পাক সেনাদের স্থায়ী ক্যাম্পের সৈন্যরা আত্মসমর্পণ করে।
স্বাধীন বাংলাদেশে সর্বশেষ হানাদার মুক্ত গৌরনদীতে ১৯৭৫ সনের ৭ মে তৎকালীন মন্ত্রী আব্দুর রব সেরনিয়াবাত শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতি সংরক্ষণে “স্মৃতি সৌধ” নির্মানের জন্য ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেছিলেন। স্বাধীনতার ৪০ বছর পার হয়ে গেলেও গৌরনদীতে আজও নির্মিত হয়নি কোন স্মৃতি সৌধ। স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা গৌরনদীতে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতি সংরক্ষনে জরুরি ভিত্তিতে স্মৃতি সৌধ নির্মানের জন্য প্রধানমন্ত্রীর আশু হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন। ২২ ডিসেম্বর গৌরনদী পাকহানাদার মুক্ত দিবস পালন উপলক্ষে সরকারি ভাবে কোন কর্মসূচীর আয়োজন করা না হলেও নিজস্ব উদ্যোগে গৌরনদী উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডের উদ্যোগে র্যালী ও আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছে।
সংবাদ: খোকন আহম্মেদ হীরা।