সড়ক দূর্ঘটনা ও ট্রাফিক জ্যাম, প্রেক্ষাপট বাংলাদেশ

মোঃ জাহাঙ্গীর হোসেন ॥ প্রতিবছর সারা পৃথিবীতে সড়ক দূর্ঘটনায় প্রায় ১.৩ মিলিয়ন লোক মারা যায়, আর ২০ থেকে ৫০ মিলিয়ন লোক গুরুত্বর আহত হয়। শোকের যে মাতম বা ক্ষতি তা তো কোনভাবেই লাঘব করা সম্ভব নয়, যে ব্যক্তি বা যার পরিবারের উপর দিয়ে এই দূর্ঘটনাটি সংগঠিত হয় তিনিই শুধু এর প্রকৃত ক্ষতি নিরূপণ করতে পারবেন।

বাংলাদেশে প্রায় ১৫ কোটি লোকের বসবাস। প্রতিদিন এ দেশে প্রায় ৮ জন করে লোক রোড এক্সিডেন্টে মারা যায়, কত কত বড় ভয়াবহ একটি ডাটা। এত দরিদ্র একটি দেশে যদি প্রতিদিন ৮ জন অর্থাৎ মাসে ২৪০, আর বছরে ২৮৮০ জন এটাতো গেলো নিহতের কথা, কিন্তু কত হাজার, কত লক্ষ লোক যে আজ এ ভয়াবহ অভিশাপের স্বীকার হচ্ছে তার কি প্রকৃত হিসাব আমাদের কাছে আছে? হয়ত নেই। কিন্তু আজ এই বিজ্ঞানের যুগে, বিজ্ঞানের সুফলগুলো কাজে লাগাতে হবে। প্রথমেই আমাদের দৃষ্টিপাত দিতে হবে সড়ক দূর্ঘটনার কারণগুলোর দিকে-
১.    চালকের দক্ষতার অভাব।
২.    যানবাহনের যান্ত্রিক ক্রুটি।
৩.    জনসাধারণের ও চালকের ট্রাফিক আইন না মানা।
৪.    রাস্তাঘাটের পর্যাপ্ত পরিচর্যার অভাব।
৫.    চালকের গতিসীমা না মানা।
৬.    যত্রতত্র গাড়ি পার্কিং করা।
৭.    জনসাধারণের যত্রতত্র রাস্তা পার হওয়া, ফুটওভার ব্রীজ ব্যবহার না করা।
৮.    অপরিকল্পিত নগরায়ন।
৯.    ডেসা, ওয়াসা, টেলিফোন লাইন স্থাপন।
১০.    অপর্যাপ্ত, অপরিকল্পিত ও নিন্মমানের সামগ্রী দিয়ে রাস্তা নির্মাণ।
১১.    রাস্তায় ডিভাইডারের অভাব।

সড়ক দূর্ঘটনার জন্য হাজারো কারণ রয়েছে যা আমরা অনেকেই উপলব্ধি করতে পারি। সড়ক দূর্ঘটনার কারণ পর্যালোচনা ও এর প্রতিকারের জন্য সরকার ২০০১ সালে রোড সেলটি সেল (জঝঈ) স্থাপন করে, আর ২০০২ সালে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থাপন করা হয় অ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ সেন্টার (অজঈ)। উপরোক্ত সংগঠনগুলো মূলত: অ্যাক্সিডেন্ট রোধকল্পে বিভিন্ন ধরনের গবেষণা, প্রতিকার ও সচেতনতামূলক কাজ ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে থাকে।

গত ৮ই জুলাই, ২০১০ ইং তারিখে দৈনিক ইত্তেফাকের এক রিপোর্টে দেখলাম, ৪,৫০,০০০ চালকের ড্রাইভিং লাইসেন্স-ই ভুয়া। কত বড় উদ্যোগের কথা, এই অদক্ষ ড্রাইভার দ্বারা লক্ষ লক্ষ লোকের যে অপূরণীয় ক্ষতি হচ্ছে বা হবে তার দায়ভারতো সংশ্লিষ্ট প্রশাসন কোনোভাবেই এড়াতে পারবেন না। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহণ সংস্থার এক হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশে রেজিষ্ট্রার্ড যানবাহনের সংখ্যা হল ১৪ লাখ, রেজিষ্ট্রেশনবিহীন যানবাহন রয়েছে আরও প্রায় ৬০,০০০। এছাড়া করিমন, নছিমন, ভটভটি কিংবা মহুরীর সংখ্যাতো অগণিত যা অবৈধভাবে গ্রাম-ঞ্জ ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে চলাচল করছে। এই দেশীয় ভটভটি, করিমন, নছিমনদের দিকে এবার সরকারকে দৃষ্টি দিতে হবে, যেহেতু এটা স্বল্প খরচে ও গ্রামের ব্যক্তি পর্যায়ে যানবাহনটি অতি জনপ্রিয় সেহেতু এটিকে আরও জনপ্রিয় করার পাশাপাশি এর সঠিক প্রযুক্তিগত সহযোগিতা প্রদান ও রেজিষ্ট্রেশনের আওতায় এনে দূর্ঘটনা হ্রাস ও দেশীয় শিল্প বিকাশ ও বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় করতে হবে। এখানে একটি ব্যাপারের দিকে প্রশাসনকে অধিক কঠোর হতে হবে তা হলো- গতিসীমা নির্ধারণের ক্ষেত্রে। আমরা জানি ১৯৮৩ সালের মোটরযান অধ্যাদেশ অনুযায়ী গাড়ি, মাইক্রোবাস, মোটর সাইকেলের সর্বোচ্চ ৭০ মাইল, মধ্যম আকারের কোষ্টার ৩৫ মাইল, মালবাহী যানের ১০-৩৫ মাইল গতিসীমা নির্ধারণ করা হয়েছে, কিন্তু এই নির্দেশনা বেশিভাগ ড্রাইভার জানেন না ও মানেন না ফলে প্রতিনিয়তই তাদের সড়ক দূর্ঘটনার সম্মুক্ষীণ হতে হচ্ছে।

গতিসীমা নিরূপণ ও এ সকল দ্রুতগতিসম্পন্ন ড্রাইভারদের নিয়ন্ত্রণ করতে হলে রাস্তায় তাদের গতিসীমা পরিমাপ করা উচিত। বাংলাদেশের ১৪ হাজার কিলোমিটার দীর্ঘ রাস্তায় মোটর যান গতি নির্ধারন যন্ত্র রয়েছে মাত্র ৩৮টি। এ যন্ত্রের সংখ্যা আরো বাড়াতে হবে এবং প্রতিটি ড্রাইভারকে এ ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। সড়ক দূর্ঘটনার আসামীদের কঠোর আইনের আওতায় আনা প্রয়োজন। ঢাকা মুখ্য মহানগার আদালত সূত্রে জানা যায়, ২০০৯ সালে রাজধানী ঢাকাসহ এর আশেপাশের এলাকায় সড়ক দূর্ঘটনায় ৬১৭টি মামলা দায়ের করা হইলেও কেহ সাজাপ্রাপ্ত হন নাই, অভিযোগ পত্রই তৈরি হয়েছে মাত্র ২৪১টি। ২০০৮ সালে সড়ক দূর্ঘটনা সংক্রান্ত ৪ হাজার ৪২৬টি মামলায় আসামী ছিল ৪৪৩ জন, এর মধ্যে পুলিশ গ্রেফতার করেন মাত্র ৭৬১ জনকে। সাধারণত দেখা যায় সড়ক দূর্ঘটনার পর আসামী ও ক্ষতিগ্রস্থ ব্যক্তি মামলা না করে বরং সমঝোতাই বেশী করেন। আবার এ সংক্রান্ত মামলায় আসামী আগাম জামিনও নিয়ে নেন সেই সাথে নানা তদবির এর মাধ্যরে গাড়িটিও অতি সহজে থানা থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে যান। ফলে দেখা যায় ড্রাইভাররা দূর্ঘটনা করেও তেমন বিচলিত হন না কিংবা দূর্ঘটনার পূর্বেও ততটা সতর্কতার সাথে গাড়ি চালান না।

জনসংখ্যার দিক থেকে ঢাকা বিশ্বের অষ্টম স্থানে রয়েছে। একটি উন্নত দেশে, প্রতিটি শহরের প্রায় ৩৮ ভাগ রাস্তা থাকা উচিত, অথচ আমাদের ঢাকাতে রয়েছে মাত্র ৭ থেকে ৮ ভাগ, ফলে যানজট ও সড়ক দূর্ঘটনা ঘটছে অহরহ।

এই স্বল্প পরিসর রাস্তায় নগরবাসির যাতায়াতের জন্য মাত্র ১০,০০০ বাস ও মিনিবাস রয়েছে যা পর্যাপ্ত নয়। সরকার ইদানিং ১০০ নতুন বাস সংযোজনের মাধ্যমে এই সমস্যা সমাধানের পরিকল্পনা হাতে নিয়েছেন। তাছাড়া ঢাকার আশেপাশে নদীপথে ওয়াটার বাস পরিচালনা করছে যা সড়ক দূর্ঘটনা ও ট্রাফিক জ্যামের কিছুটা হলেও সমাধান করবে। তাছাড়া ঢাকার আশেপাশে গাজীপুর, টঙ্গী, নারায়ণগঞ্জ, কুমিল্লাসহ আশেপাশে ট্রেনের ব্যবস্থা নিশ্চিত করে সড়ক ব্যবস্থার উপর চাপ কিছুটা কমানোর পরিকল্পনা চলছে। এছাড়াও নতুন নতুন ফ্লাইওভার, পাতাল রেল, এলিভেটেট এক্সপ্রেস, হাইওয়ে, সাবওয়ে ইত্যাদি পর্যায়ক্রমে হলে সড়ক দূর্ঘটনা ও ট্রাফিক জ্যাম বহুলাংশে কমে যাবে।

লেখক: শিল্পগোষ্ঠীর কর্মকর্তা

সাবেক সেনা অফিসার