ইচ্ছেটা যখন শেষ ইচ্ছে

ফারজানা উর্মি : আমরা সারাজীবন অসংখ্য ইচ্ছে বুকে পুষে রাখি_জীবনের কোনো না কোনো সময় সেগুলো পূরণ হবে_ এই ভেবে। কিন্তু আপনি যদি জেনে যান আর মাত্র অল্প কিছুদিন আছে আপনার হাতে, তারপর এই পৃথিবীটা ছেড়ে চলে যেতে হবে আপনাকে। তাহলে কী হবে আপনার শেষ ইচ্ছে? অনেক স্বপ্নের মধ্যে কোনটাকে আপনি সবার ওপরে স্থান দেবেন? আদৌ কি পূরণ হবে সেই ইচ্ছে? এই পৃথিবী থেকে অকালে চলে যাওয়া খুব অল্পসংখ্যক মানুষ তাদের শেষ ইচ্ছেটা পূরণ করে যেতে পেরেছেন। সেসব ইচ্ছে পূরণের গল্প থেকে বেছে নেওয়া শ্রেষ্ঠ আটটি গল্প আজ আপনাদের জানাবে ফারজানা ঊর্মি।

মাত্র ছয় বছর বয়সী এলেনা ডেসেরিচের যখন মস্তিষ্কে ক্যান্সার ধরা পড়ল, তখন থেকে একটা অদ্ভুত কাজ শুরু করল সে। ঘরের আনাচে-কানাচে লুকিয়ে রাখা শুরু করল তার বাবা-মাকে উদ্দেশ করে লেখা অসংখ্য চিরকুট, চিঠি আর কার্ড। সিডি রাখার তাক থেকে শুরু করে কাপড়ের আলমারি, স্কুলের ব্যাগ থেকে শুরু করে বই রাখার তাক_ কোনো কিছুই বাদ যায়নি তার এই লুকোনোর জায়গা থেকে। তার শেষ ইচ্ছে ছিল_ সে চলে যাওয়ার পর তার বাবা-মা এই চিরকুটগুলো খুঁজে বের করবে। ডাক্তারের বেঁধে দেওয়া ১৩৫ দিন পার করে আরও ১২০ দিন বেঁচে ছিল সে। ২০০৭ সালে ডেসেরিচ চলে যাওয়ার পর তার বাবা-মা খুঁজে পেতে শুরু করেন ভালোবাসার বার্তাভরা প্রায় কয়েকশ চিরকুট। ডেসেরিচের বাবা-মা ব্রুক ও কিথের মতে, ‘একেকটা চিরকুট যেন ডেসেরিচের একেকটা ছোট ছোট আলিঙ্গন। যেন সে বলছে যে, সে আমাদের দেখছে।’ ব্রুক ও কিথ এই বার্তগুলো পরবর্তী সময়ে বই আকারে প্রকাশ করেন। বই বিক্রির পুরো অর্থ চলে যায় একটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠানে, যারা মস্তিষ্কে ক্যান্সারে আক্রান্ত শিশুদের নিয়ে কাজ করে।

২০০৫ সালে ওয়াশিংটনের ব্রেন্ডেন ফ্রস্ট যখন লিম্ফোব্লাস্টিক লিউকেমিয়ায় আক্রান্ত হয়, তখন তার বয়স মাত্র আট বছর। তার শেষ ইচ্ছে ছিল দেবদূত হয়ে সে গৃহহীনদের কাছে যাবে এবং তাদের খাওয়াবে। তার এই ইচ্ছে অনেকের মনে গভীর দাগ কাটে। স্থানীয় অনেক সংস্থার মনোযোগ আকর্ষণে সক্ষম হয় তার এই ইচ্ছে। এমনকি অনেক আন্তর্জাতিক সংস্থাও প্রভাবিত হয় তার এই ইচ্ছে দ্বারা।
ফ্রস্টের ইচ্ছের প্রতি সম্মান জানাতে সিয়াটলের একদল স্বেচ্ছাসেবক গৃহহীনদের মধ্যে ২০০ স্যান্ডউইচ বিতরণ করে। অনুপ্রাণিত একদল মানুষ সাত ট্রাক ভর্তি খাবার এবং নগদ ৯৫ হাজার ডলার বিতরণ করে গৃহহীনদের মধ্যে। শুধু ওয়াশিংটনে নয়, লস অ্যাঞ্জেলেস, ওহিও, ফ্লোরিডায়ও খাবার বিতরণ করা হয় ফ্রস্টের ইচ্ছে পূরণের লক্ষ্যে। লস অ্যাঞ্জেলেসের ইউনিয়ন রেসকিউ মিশন ফ্রস্টের পক্ষ থেকে গৃহহীনদের মধ্যে ২৫০০ জনকে খাবার বিতরণ করে।
প্রায় তিন বছর অসুস্থতার সঙ্গে যুদ্ধ করে ২০০৮ সালে মারা যায় ফ্রস্ট। সিয়াটলের একটি সংস্থা ঘঋখ তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার পুরো খরচ বহন করে।

শিক্ষায় সম্মান ডিগ্রি অর্জন করা ছিল হেরিয়েট এমেসের আজীবনের স্বপ্ন। শততম জন্মদিন পালনের তিন সপ্তাহ পর পূরণ হলো তার সেই স্বপ্ন।
কিন্তু মৃত্যুপথযাত্রী এমেসের শেষ ইচ্ছে ছিল মৃত্যুর আগে সনদটা হাতে পাওয়া। আর তাই তিনি নরমাল স্কুুল (বর্তমানে কিনি স্টেট কলেজ) থেকে শিক্ষায় স্নাতক ডিগ্রি অর্জনের সেই কাঙ্ক্ষিত সনদটা নিজের শিয়রে রাখার ঠিক পরদিনই অত্যন্ত আনন্দিত এমেস শান্তিতে চোখ বুজেছিলেন।

ডিজনি চ্যানেলে দেখানো ডিজনি-পিকচারের নতুন ছবি ‘আপ’-এর বিজ্ঞাপন অনেকেই দেখেছেন। ক্যান্সারে আক্রান্ত কলবি কার্টিনের শেষ ইচ্ছে ছিল এই ছবিটা দেখা। কিন্তু থিয়েটারে গিয়ে ছবিটা দেখার মতো শারীরিক সুস্থতা তার ছিল না। কার্টিনের পারিবারিক বন্ধু সাহায্য চেয়ে ডিজনি-পিকচারের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তার পরদিনই ডিজনি-পিকচারের এক কর্মী ‘আপ’ ছবির ডিভিডি ভার্সন নিয়ে হাজির হয় কার্টিনের কাছে। পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে বসে সেই ছবি উপভোগ করার মাত্র ৭ ঘণ্টা পর কার্টিন মারা যায়।
ছবিটির একটি বিশেষ দৃশ্যে দেখা যায়, অসংখ্য বেলুনের একটা ঝাঁক আকাশে উড়ে যাচ্ছে। কার্টিনের শেষ ইচ্ছেকে সম্মান জানিয়ে ডিজনি-পিকচার শুধু কার্টিনের জন্য তৈরি এই ছবির বিশেষ ডিভিডিটি একঝাঁক বেলুন দিয়ে উড়িয়ে দেয়।

ছুটি শেষে স্কুলে প্রত্যাবর্তন উপলক্ষে যে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয় সেখানে নাচার ইচ্ছে যখন প্রকাশ করে ব্রেট মেরি ক্রিশ্চিয়ান, তখন সে লিউকেমিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে। কিন্তু নাচার জন্য যে শারীরিক শক্তি দরকার সেটা তার ছিল না। ক্রিশ্চিয়ানের শেষ ইচ্ছে পূরণের জন্য হাত বাড়িয়ে দেয় তার বন্ধু ট্রেটন কার্টার। শুধু ক্রিশ্চিয়ানের জন্য সেই বছর অনুষ্ঠানটা অনুষ্ঠিত হয় সময়ের বেশ আগেই। সেই অনুষ্ঠানে পরার জন্য ক্রিশ্চিয়ানকে একটা নেকলেস উপহার দেয় ট্রেটন। চুলগুলো কার্ল করে গোলাপি একটা গাউন পরে অনুষ্ঠানে হাজির হয়েছিল ক্রিশ্চিয়ান। পার্টি সাজে সজ্জিত পঞ্চাশেরও বেশি অতিথির সামনে সেদিন নাচে ট্রেটন ও ক্রিশ্চিয়ান। সেই শনিবার রাতের পার্টিকুইন ক্রিশ্চিয়ান মারা যায় তার শেষ ইচ্ছে পূরণের ঠিক তিন দিন পর।

গ্যাস্ট্রিক ক্যান্সারে আক্রান্ত মেরি টাওমিয়াকে ডাক্তাররা যখন বলেন যে, তাদের আর করার কিছু নেই, তখন বাবার কাছে শেষ ইচ্ছেটা প্রকাশ করে টাওমিয়া। বিয়ে করতে চেয়ে বাবার আশীর্বাদ চায় টাওমিয়া। মারওনা টুনুইয়ের সঙ্গে টাওমিয়ার প্রায় দুই বছরের সম্পর্ক এবং ডেট্রয়েট নামের এক বছর বয়সী একটা সন্তানও আছে তাদের। ২০০৯ সালের নভেম্বরে টওমিয়ার ক্যান্সার ধরা পড়ার পর থেকে তার সঙ্গে ক্রিশচার্চ হাসপাতালে থাকতে শুরু করে তার প্রেমিক মারওনা টুনুই। ডাক্তাররা হাল ছেড়ে দেওয়ার পর তাকেই বিয়ে করার ইচ্ছে পোষণ করে টাওমিয়া। টাওমিয়ার বাবা রঙ্গো বলেন, ‘আমার অন্তরটা সারাক্ষণ কাঁদছে, কিন্তু আমি আমার মেয়েকে সুখী দেখতে চাই। আমি হাসি দেখতে চাই তার মুখে।’ টাওমিয়ার শেষ ইচ্ছে পূরণ হয় ২০১১ সালের জানুয়ারিতে। বিয়ের দিন টাওমিয়াকে অনেক সুন্দর আর সবল দেখাচ্ছিল। বিয়ের কেক, পোশাক, ফটোগ্রাফার, লিমোজিন এবং হানিমুনের পুরো খরচ বহন করে নিউজিল্যান্ডের একটা ক্যান্সার সোসাইটি।

মাত্র ৫ বছর বয়সী বেথানি ফেন্টন ব্রেন টিউমারে আক্রান্ত হয়ে সিমন কোয়েলের সামনে গান গাওয়ার শেষ ইচ্ছে প্রকাশ করে। ব্রিটেন গট ট্যালেন্টের স্টুডিওতে এই ইচ্ছে পূরণ হয় ফেন্টনের। সিমনের সামনে দাঁড়িয়ে ‘টুইংকেল টুইংকেল লিটল স্টার’ গানটি গায় ফেন্টন। ‘সিমন আমাকে ওর সামনে গাইতে দিয়েছে। ও অনেক ভালো এবং আমি ওকে অনেক ভালোবাসি’, শেষ ইচ্ছে পূরণের পর আনন্দিত ফেন্টন বলে। শেষ ইচ্ছে পূরণের ঠিক তিন দিন পর এক অনাথশালায় মারা যায় ফেন্টন। সিমন বলেন, ‘ফেন্টন সত্যিই অনেক মিষ্টি একটা মেয়ে। তার জন্য খুব খারাপ লাগছে আমার।’

স্ত্রীর গায়ে হাত তোলার দায়ে ১২ মাসের জন্য জেলে যায় জেরেমি ডেভিস। কিন্তু মাত্র তিন মাস পরেই আদালতে আবেদন করে স্বামীকে ছাড়িয়ে আনেন স্ত্রী চার ডেভিস। টারমিনাল ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে আদালতে স্বামীকে মুক্তি দেওয়ার অনুরোধ করেন চার। অসুস্থতার সত্যতা যাচাই করে তারপর তার অনুরোধটি রাখেন আদালত। তবে মুক্তির বিনিময়ে প্রতি সপ্তাহে জেরেমিকে পারিবারিক অপরাধ বিষয়ক ক্লাসে যোগ দেওয়ার শর্ত রাখেন আদালত। শেষ ইচ্ছে পূরণ হতে দেখে আদালত প্রাঙ্গণেই কেঁদে ফেলেন চার।

সমকালের সৌজন্যে