ঢাকা চল কর্মসূচি ব্যাপক প্রস্তুতি, নানা কৌশল

খোন্দকার কাওছার হোসেন ॥ আগামী ১২ মার্চ খালেদা জিয়া ঘোষিত চল চল ঢাকা চল কর্মসূচি ও ঢাকায় মহাসমাবেশ সফল করতে ব্যাপক প্রস্তুতির পাশাপাশি নানা কৌশল অবলম্বন করছে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ৪ দলীয় জোট ও সমমনা দলগুলো।

ঢাকাসহ সারাদেশ থেকে অন্তত ২০ লাখ লোক এ সমাবেশে জড়ো করার পরিকল্পনা রয়েছে আয়োজকদের। সে লক্ষ্যে বিএনপির স্থায়ী কমিটি, ভাইস চেয়ারম্যান, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা কাউন্সিলের সদস্য ও যুগ্ম মহাসচিবদের নেতৃত্বে বিএনপির ৪৫টি কমিটি, জামাতের মহানগর সেক্রেটারির নেতৃত্বে ১১ সদস্যের ১টি কমিটিসহ অভ্যর্থনা, শৃঙ্খলা, পার্কিং, স্বাস্থ্য, প্রচার, আবাসন মিলিয়ে কয়েকটি উপ-কমিটিও গঠন করেছে দলটি। অন্যান্য দলগুলোও এ জাতীয় বেশ কয়েকটি কমিটি গঠন করেছে।   

বিএনপির ৪৫টি কমিটিকে দলের ৮১টি রাজনৈতিক জেলার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। তারা গত ২০ দিন যাবত দেশের জেলাগুলোতে সফর করে কর্মসূচি সফলের জন্য জেলা, উপজেলা, পৌর ও ইউনিয়ন কমিটির তৎপরতা তদারকি করছেন। আগামী ১২ মার্চের পূর্ব পর্যন্ত তারা এসব কর্মকান্ড পর্যবেক্ষনের জন্য জেলা উপজেলা সফরে থাকবেন বলে দলের দপ্তর সূত্রে জানা গেছে।

সূত্র জানায়, এবারে এ কর্মসূচি শতভাগ সফল করতে মরণ কামড় দিবে বিরোধী জোট। এ কারণে বিএনপি ও জোট নেত্রী খালেদা জিয়া প্রতিদিন এ কর্মসূচির অগ্রগতি অবহিত হওয়ার জন্য দল জোট ও সমমনা দলসহ বিভিন্ন সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করছেন। প্রয়োজনীয় দিক নির্দেশনা ও তার কাছ থেকে নেতাকর্মীরা পাচ্ছেন বলে জানা গেছে।

এলাকা থেকে ঢাকায় আসা, ঢাকায় অবস্থান এবং মহাসমাবেশে যোগদানের বিষয়ে দলীয় ও জোটগত ভাবে কিছু কৌশল অবলম্বন করা হচ্ছে বলে মাঠ পর্যায়ের নেতাদের নিকট থেকে জানা গেছে।

কৌশলগুলোর মধ্যে রয়েছে, মহাসমাবেশে ঢাকা আসতে সরকারী দলের নেতাকর্মী ও পুলিশ নানা ধরণের বিঘ্ন সৃষ্টি করতে পারে এ আশংকা থেকে মহাসমাবেশের দু একদিন আগেই ঢাকায় আসার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। ঢাকায় এসে কোন আবাসিক হোটেলে অবস্থান না করে আত্বীয় স্বজনের বাসা, কোনো মেসবাড়ী কিংবা মসজিদে রাত্রীকালীন অবস্থান নিতে পরামর্শ দেয়া হয়েছে। যারা আগে আসতে পারবেন না তাদেরকে রিজার্ভ বাস পরিত্যাগ করে কাটা লাইনে (লোকাল গাড়ীতে ভেঙ্গে ভেঙ্গে) কিংবা পাবলিক লঞ্চে, ট্রেনে আসার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। এরপরও যদি সরকার কোথাও বাধা দেয় নেতাকর্মীদের সেখানেই রাস্তায় বসে পড়ে অবস্থান কর্মসূচি পালনের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তবে কর্মসূচি শান্তিপূর্ণভাবে পালনের নির্দেশ রয়েছে সর্বত্র। এর বাইরে সরকারি দলের নেতাকর্মী কিংবা পুলিশ কোথাও কোনো হামলা বা বাধার সৃষ্টি করলে অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নেয়ার মৌখিক নির্দেশ ও রয়েছে কেন্দ্র থেকে।

জানা গেছে, ২০ লাখ লোকের ৩/৪ দিন ঢাকায় থাকা ও খাবারের প্রস্তুতি রয়েছে। ইতিমধ্যেই খালেদা জিয়া এ ব্যাপারে নির্দেশনা দিয়ে রেখেছেন। সে মোতাবেক প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি ও সম্পন্ন রয়েছে।

কর্মসূচিতে কারা থাকছেন
ইসিতে নিবন্ধিত ৩৮টি রাজনৈতিক দলের মধ্যে ১৬টি দল রয়েছে এ কর্মসূচির সঙ্গে। ৪ দলীয় জোটের ব্যানারে রয়েছে ৬টি দল, সমমনা ৯টি ও এলডিপি। এরা হলো, বিএনপি, জামাতে ইসলামী, বিজেপি, ইসলামী ঐক্যজোট, খেলাফত মজলিস ও জমিয়তে ওলামায়ে ইসলাম, কল্যাণ পার্টি, জাগপা, এনপিপি, এনডিপি, লেবার পার্টি, বাংলাদেশ ন্যাপ, ন্যাপ ভাসানী, ইসলামিক পার্টি, মুসলিম লীগ ও  এলডিপি।

এছাড়া জোটের কলেবর বৃদ্ধির প্রক্রিয়ায় রয়েছে আরো কয়েকটি দল এগুলো হলো, বিকল্প ধারা বাংলাদেশ, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি), কাদের সিদ্দিকির কৃষক শ্রমিক জনতা পার্টি, জাতীয় পার্টির (এরশাদ) একটি অংশ। এরা এ মহাসমাবেশে যোগ দিতে পারে বলে জোটের নেতারা আশা করছেন।

তাদের দাবি, বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বৃহত্তম সমাবেশ হবে এটি। এ সমাবেশে ঢাকার বাইরে থেকে যেমন লাখ লাখ লোক ঢাকায় আসবে তেমনি ঢাকায় অবস্থানরত দলীয় নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষও যোগ দেবে।

মহাসমাবেশ যেখানে হবে
বিএনপির পক্ষ থেকে ৩টি স্থানে এই মহাসমাবেশ করার অনুমতি চাওয়া হলেও শেষ পর্যন্ত নয়াপল্টনে দলীয় কার্যালয়ের সামনের সড়কেই হতে পারে এ সমাবেশ। ক্রিড়া সংক্রান্ত বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ করায় পল্টন ময়দানে এখন আর সমাবেশ করার মতো অবস্থায় নেই। পল্টন ময়দান ব্যবহার করার অনুমতি চেয়ে ক্রীড়া পরিষদের কাছে চিঠি দিলেও বৃহস্পতিবার পর্যন্ত সাড়া পায়নি বিএনপি। সংসদ ভবনের সামনে হওয়ায় মানিক মিয়া এভিনিউয়েও সমাবেশ করতে দেবে না সরকার।

বাধা এলে যা করবে
পাল্টা কর্মসূচি বা সরকারি দলের পক্ষ থেকে কোনো প্রকার বাধা এলে, তা মোকাবিলা করার প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে। তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে কোনো সংঘর্ষে জড়াতে চায় না দলটি। তাই পাল্টাপাল্টি কর্মসূচির অজুহাতে ১২ মার্চ ঢাকায় কর্মসূচির ওপর পুলিশ নিষেধাজ্ঞা জারি করলে, বিএনপি পরদিন মহাসমাবেশ করবে। পরদিনও পুলিশ নিষেধাজ্ঞা দিলে, বিএনপি তার পরদিন কর্মসূচি পালন করবে। অবশ্য পুলিশের উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে পুলিশ কোনো বাধা দেবে না। তবে কর্মসূচির নামে নাশকতা করলে পুলিশ কঠোর অবস্থানে যাবে।

জেলার দায়িত্বে যারা
কেন্দ্রীয় নেতাদের মধ্যে স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন পেয়েছেন সিলেট জেলার দায়িত্বে, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ ঢাকা, এম কে আনোয়ার চট্টগ্রামের, লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান রাজশাহীর, তরিকুল ইসলাম খুলনার, মির্জা আব্বাস বরিশালের, জমির উদ্দিন সরকার নোয়াখালীর, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আ স ম হান্নান শাহ রংপুর ও কুড়িগ্রামের, ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া ফরিদপুরের, গয়েশ্বর চন্দ্র রায় যশোর ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার, ড. আবদুল মঈন খান ময়মনসিংহ ও শেরপুর।

কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান এম  মোরশেদ খান বান্দরবান ও রাঙামাটি, আবদুল্লাহ আল নোমান টাঙ্গাইল ও দিনাজপুর, মেজর (অব.) হাফিজউদ্দিন আহমদ কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা ও মাদারীপুর, এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) আলতাফ হোসেন চৌধুরী ভোলা ও জামালপুর, সেলিমা রহমান ঝালকাঠি ও পটুয়াখালী, শমসের মবিন চৌধুরী মৌলভীবাজার, রাজিয়া ফয়েজ নড়াইল।

চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা কাউন্সিলের সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী মাগুরা, ড. এম ওসমান ফারুক মেহেরপুর, ইনাম আহমেদ চৌধুরী সৈয়দপুর ও নীলফামারী, আবদুল আউয়াল মিন্টু ফেনী, ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বগুড়া ও পাবনা, শামসুজ্জামান দুদু নাটোর ও ঝিনাইদহ, ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন সুনামগঞ্জ, মেজর জেনারেল অব. রুহুল আলম চৌধুরী খাগড়াছড়ি, ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমর বীর উত্তম কিশোরগঞ্জ, আবদুল মান্নান নেত্রকোনা, ফজলুর রহমান পটল সিরাজগঞ্জ ও নওগাঁ, অধ্যাপক আবদুল মান্নান মুন্সিগঞ্জ।

যুগ্ম মহাসচিব আমান উল্লাহ আমান নরসিংদী ও মানিকগঞ্জ, বরকত উল্লাহ বুলু চাঁদপুর, মোহাম্মদ শাহজাহান কুমিল্লার, সালাহউদ্দিন আহমেদ রাজবাড়ী ও নারায়ণগঞ্জ জেলার দায়িত্বে রয়েছেন।

বাধ্যতামূলক যা
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জানান, মহাসমাবেশের আগে সব সাংগঠনিক জেলায় কর্মিসভা করতে জেলা কমিটিগুলোকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
শান্তিপূর্ণভাবে এ কর্মসূচি পালনের জন্য নেতাকর্মীদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আমাদের শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে বাধা দিলে তার সব দায় দায়িত্ব সরকারকে নিতে হবে। সরকার যদি শান্তিপূর্ণভাবে সমাবেশ করতে না দেয় তাহলে সরকার পতনের একদফা কর্মসূচির ডাক দেয়া হবে।

মহানগরীতে যা হচ্ছে
ঢাকা মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব আবদুস সালাম জানান, মহাসমাবেশকে সামনে রেখে মহানগর বিএনপি ঢাকার থানা ও ওয়ার্ডে কর্মী সমাবেশ ও জনসংযোগ করছে। ইতোমধ্যে ঢাকার সব থানায় কর্মী সমাবেশ সম্পন্ন হয়েছে। আজ বৃহস্পতিবার থেকে প্রতিটি ওয়ার্ডে কর্মী সভা শুরু হয়েছে। ওয়ার্ডে কর্মিসভা ও জনসংযোগ করার জন্য ১০০টি টিম করা হয়েছে। এছাড়া প্রচারের জন্য ৪৩টি কমিটি করা হয়েছে। তিনি আরো জানান, মহাসমাবেশের সব প্রস্তুতি প্রায় শেষ। বাকি কাজ ১০ মার্চের মধ্যে সম্পন্ন হবে।

প্রচার প্রচারণা
মহাসমাবেশকে সফল করতে সারাদেশে ব্যাপক প্রচারণা চালানো হচ্ছে। কেন্দ্রীয় পোস্টার ও  লিফলেটের পাশাপাশি স্থানীয় নেতারা নিজেদের ছবি সম্বলিত বিভিন্ন পোস্টার, ডিজিটাল ব্যাণার ও লিফলেটে ছেয়ে ফেলেছে পুরো দেশ। রাস্তাঘাট, দোকান পাট, গাড়ী, রিক্সা, ট্রেন, ফেরি, লঞ্চ সহ বিভিন্ন স্থাপনায় টানানো হয়েছে এসব নানা রঙের পোস্টার ও ব্যানার। বিলি করা হচ্ছে লিফলেট। সবাইকে এ মহাসমাবেশে যোগদানের জন্য মৌখিকভাবে আমন্ত্রনও জানানো হচ্ছে। নারিদের আমন্ত্রন জানানোর জন্য যাওয়া হচ্ছে দল বেধে বিভিন্ন বাসা বাড়িতে।

জামাত ও অন্যান্যরা যা করছে
জামাতের পক্ষ থেকে মহাসমাবেশে ব্যাপক লোক সমাগমের প্রস্তুতি চলছে। তবে দলের নেতারা গ্রেপ্তারের আতঙ্কে অনেক কিছু বলতে রাজি হচ্ছেন না।
কল্যাণ পার্টির সাংগঠনিক সম্পাদক সাহিদুর রহমান তামান্না বলেন, মহাসমাবেশ সফল করতে ইতোমধ্যে দলীয় ফোরামে কয়েকটি বৈঠক করা হয়েছে। গত বুধবার পল্টনের মহানগর কার্যালয়ে সারাদেশের নেতৃবৃন্দকে নিয়ে বৈঠক করা হয়েছে। দেশের প্রতিটি থানার নেতাকর্মীকে ১২ মার্চ ঢাকায় আসার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

বাংলাদেশ লেবার পার্টির চেয়ারম্যান ডা. মোস্তাফিজুর রহমান ইরান বলেন, ১২ মার্চের মহাসমাবেশে লোক হাজির করতে দলের সর্বোচ্চ শক্তি নিয়োগ করা হবে।

খালেদা জিয়ার তৎপরতা
মহাসমাবেশ সফল করতে পেশাজীবী ও দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে প্রায় প্রতিদিনই বৈঠক করছেন দলীয় চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। গুলশান কার্যালয়ে ধারাবাহিকাভাবে বিভিন্ন শ্রেণী পেশার প্রতিনিধিদের সঙ্গে তিনি বৈঠক করছেন।

সর্বশেষ তথ্য
বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী জানান, মহাসমাবেশের জন্য তিনটি জায়গার অনুমতি চাওয়া হলেও বৃহস্পতিবার দুপুর বারোটা পর্যন্ত সরকারের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে কোনো সারা পাওয়া যায়নি।

পুলিশের সঙ্গে দলের নেতাদের কোনো বৈঠক হয়েছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, এখনো হয়নি। তবে দু একদিনের মধ্যে বিএনপির একটি প্রতিনিধি দল পুলিশের উদ্ধতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করবেন। রিজভী আরো বলেন, কেন্দ্রীয় নেতাদের সমন্বয়ে করা কমিটির নেতারা বর্তমানে সারাদেশের মাঠ পর্যায়ে কর্মী সভায় ব্যস্ত রয়েছেন। প্রতিটি কমিটির নেতারা ঢাকার বাইরে জেলা পর্যায়ে কর্মিসভা করছেন।