১২ মার্চ থেকে ১৪ মার্চ: কী জানি কী হয়!

মহিত-উল-আলম ॥ ১২ মার্চের বিএনপি আহ্বায়িত মহাসমাবেশের পরপরই ১৪ মার্চের আওয়ামী লীগ আয়োজিত মহাসমাবেশের আহ্বানের ফলে মনে হচ্ছে, ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের মতোই স্মরণীয় হতে যাচ্ছে ২০১২ সালের মার্চ মাস। তবে তখনকার রাজনৈতিক পরিস্থিতির প্রেক্ষাপট ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ শুরু হওয়ার সূচনাকাল। আর এখনকার আন্দোলন হচ্ছে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত একটি ক্ষমতাসীন দলের বিরুদ্ধে নির্বাচিত বিরোধী দল কর্তৃক সংসদের বাইরে এসে রাস্তায় মহড়া দেওয়া। সেটা হচ্ছে ১২ তারিখ। আর ১৪ তারিখ স্বয়ং ক্ষমতাসীন দলটিও রাস্তায় মহড়া দেবে, তাই বলা যায় জাতীয়ভাবে প্রতিষ্ঠিত দুটি বড় দল সরকার চালাতে পারুক আর না পারুক, কিংবা বিরোধী দল হিসেবে সংসদে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারুক আর না পারুক, দুই দলই সিদ্ধহস্ত রাস্তায় লোক জড়ো করে বাহুশক্তি প্রদর্শনে। সক্রিয় রাজনীতিতে নৈতিকতার অবস্থান সবচেয়ে পেছনে, সে জন্য সেটার কথা আর বললাম না। মেধার চেয়ে বাহু শক্তিশালী, যুক্তির চেয়ে আবেগ শক্তিশালী, নিয়মনীতি মানার চেয়ে নিয়ম ভাঙাই শক্তিশালী—এ কথাগুলো বারবার প্রমাণিত হচ্ছে আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির ধারাবাহিকতায়। ব্যাপারটা এ রকম যে নির্বাচন থাকুক, সংসদ থাকুক, সরকারি দল থাকুক, বিরোধী দলও থাকুক, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে থাকুক রাস্তা। রাস্তাই যদি রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের হাতিয়ার হয়, তা হলে ঠাট্টার ছলে এ প্রশ্নও করা যায় যে এত কোটি টাকা খরচ করে আর নির্বাচন অনুষ্ঠানের দরকার কী! যখন ইচ্ছা তখন রাস্তায় লোক নামিয়ে সরকার পতন করিয়ে দিলেই হয়!

নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে বিজয়লাভ বাংলাদেশের ইতিহাসে কখনো ক্ষমতাসীন দলের জন্য ফলদায়ক হয়নি। ১৯৭৩ সালের নিরঙ্কুশভাবে বিজয়ী বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ সরকার ১৯৭৫ সালের মধ্যেই ক্ষমতা হারিয়ে বসে, ২০০১ সালের নিরঙ্কুশভাবে ক্ষমতায় আসা বিএনপি ক্ষমতায় শেষ পর্যন্ত থাকলেও, সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে প্রধান বিচারপতির বয়সসীমা দুই বছর বাড়িয়ে নিয়ে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি করল যে শেষ পর্যন্ত ঘটনা পরম্পরায় ১/১১-এর সৃষ্টি হলো। এবারও আওয়ামী লীগ সরকার সংসদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার সুযোগ নিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার আইনটি উচ্ছেদ করে দিয়ে নির্বাচিত সরকারের অধীনে গঠিত নির্বাচনকালে অন্তর্বর্তী সরকারের বিধি পাস করিয়ে, জেনে শুনে খাল কেটে কুমির আনার ব্যবস্থা করেছে মনে হয়। কারণ, এ ইস্যুটি হাতে ধরিয়ে না দেওয়ার আগে পর্যন্ত বিএনপি নানা ইস্যুতে আন্দোলনে নামতে গিয়ে হালে পানি পাচ্ছিল না আর এখন সরকারি দলকে চাপা দীর্ঘশ্বাসের সঙ্গে অবলোকন করতে হচ্ছে যে ১২ মার্চ বিএনপি রাজধানীতে লাখ লাখ লোকের সমাবেশ ঘটাতে যাচ্ছে।

এ অবস্থা সৃষ্টি হওয়ার জন্য আর কাউকে দোষ দেওয়ার আগে সরকারি দল নিজেদের অবিবেচনাকে দুষতে পারে। আমি ব্যক্তিগতভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিরোধী, এটা আমার এ সম্পর্কিত সব লেখায় যুক্তিসহকারে বলেছি যে এটি অনিয়মতান্ত্রিক সরকার আনার জন্য একটি খোলা দরজাসম্পন্ন ব্যবস্থা, যেটি যেকোনো সময় দীর্ঘমেয়াদি অগণতান্ত্রিক পরিবেশের সৃষ্টি করতে পারে। কিন্তু আমি তো রাজনীতি করি না, যাঁরা করেন তাঁরা তো এটার বিসর্জনে পরিণতি কী হবে, সেটা ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত দেবেন। তার পরও এ ইস্যুতেও বিরোধী দল এতটা জোয়ার আনতে পারত না, যদি না সরকার দেশটা ঠিকমতো শাসন করতে পারত। দ্রব্যমূল্যসহ অর্থনীতির নিয়ন্ত্রণ, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ও বিদেশনীতিতে সরকারি দলের ব্যর্থতা এতটা স্পষ্ট হয়েছে যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধি পুনঃপ্রচলনের জন্য যতটা নয়, তারচেয়েও বেশি মানুষ খেপেছে ওই তিনটে ক্ষেত্রে সরকারের কাজের পরিবর্তে আস্ফাালন দেখে। আপাত দলনিরপেক্ষ লোকও বিএনপির আহ্বানে সাড়া দেবে যদি তারা মনে করে যে সরকার দেশ চালাতে পারছে না।

যখন কোনো মন্ত্রণালয় ভালো চলে না, তখন কী করতে হয়, সরকারপ্রধান সেটা জানেন এবং এ ব্যাপারে তাঁর সবল কিংবা দুর্বল হস্তক্ষেপ দেশের জন্য মঙ্গল কিংবা অমঙ্গল বয়ে আনবে। এ পর্যন্ত ওপরে কথিত তিনটি মন্ত্রণালয় কার্যকর ব্যবস্থার পরিবর্তে যে কথাগুচ্ছ দিয়ে চলছে, সেটি জাতি লক্ষ করছে। এ জন্যই সরকারি দল দ্রুত জনসমর্থন হারাচ্ছে।

১২ মার্চের লোক সমাবেশের স্থানে সরকার কর্তৃক নাশকতামূলক কাজ করার আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব। কিন্তু নিরপেক্ষভাবে দেখলে প্রশ্নটি তাঁর দিকেও ফিরিয়ে দেওয়া যায় এ জন্য যে নাশকতামূলক কাজ করার জন্য পরিকল্পনা হয়তো বৃহৎ লাগে কিন্তু এটি কার্যকর করতে লাগে এক বা একাধিক ছোড়া বোমা বা সে জাতীয় কিছু। এটির জন্য সরকারি দলও যেমন লোক নিয়োগ করতে পারে, পারে বিরোধী দলও, পারে অন্য যেকোনো মহলও। যত নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড হয়ে থাকে, তার মধ্যে সবচেয়ে বিপজ্জনক হলো জনতার সমাবেশে বোমা ছোড়া। এটা কোন দিকে গিয়ে কাকে আঘাত করে, কাকে জীবনের জন্য পঙ্গু করে ফেলে, কার মৃত্যুর কারণ হয়, এটা বোমা ছোড়ার এক মুহূর্ত আগেও বোঝার কোনো উপায় নেই। মাঝেমধ্যে পত্রিকায় ময়মনসিংহের সিনেমা হলে বোমার বিস্ফোরণ, খুলনার এক সমাবেশে জঙ্গি হামলা, রমনার বটমূলে বোমা নিক্ষেপের ফলে নিহত ছাড়াও যাঁরা আহত হয়ে পঙ্গু জীবনযাপন করছেন, তাঁদের বছরওয়ারি সচিত্র প্রতিবেদন ওঠে। কী নিদারুণ মর্মস্পর্শী সে জীবনকাহিনি। মহাসচিব সাহেবের কথার আইরনি বা কূটাভাষটা হলো এখানে যে নাশকতামূলক কাজে বর্তমান বিরোধী দলের অভিজ্ঞতা ও ইতিহাস যতটা ভারী, সরকারি দলের ততটা নেই। একবারে যে নেই তা নয়, তবে অপেক্ষাকৃত কম। সে জন্য প্রমাণ হিসেবে ২০০৪ সালের ২১ আগস্টে আওয়ামী লীগের জনসভায় নাশকতামূলক আক্রমণ এবং তাঁর পরিণামে লোক ক্ষয়—আইভি রহমানের মৃত্যু এবং দূরবর্তীভাবে আওয়ামী লীগের সাবেক মেয়র মোহাম্মদ হানিফের মৃত্যু—এ কথা মনে করিয়ে দেয় যে ১২ মার্চের বিরোধী দলের মহাসমাবেশ নিয়ে (কিংবা ১৪ মার্চের সরকারি দলের মহাসমাবেশ নিয়ে) সাধারণ মানুষের মনে মির্জা ফখরুল ইসলামের মতো যে সন্দেহ ঢোকেনি তা নয়। তা ছাড়া শুধু যে নাশকতা থেকে লোক চোট পাবে বা ক্ষয় হবে তা তো নয়, পুলিশের সঙ্গে দাঙ্গা হতে পারে, পরস্পরবিরোধী জনতার মধ্যে হানাহানি হতে পারে, অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুর, গাড়ি পোড়ানোসহ নানা বিপত্তি ঘটতে পারে। একটি সহিংস চিত্রই তো মনের মধ্যে ফুটে উঠছে। সেখানে নিরাপত্তার আশা করাটা কতটুকু যৌক্তিক?

সরকারি দল বারবার প্রচার করছে যে বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে আন্দোলন করছে না, করছে যুদ্ধাপরাধী বিচারের কাজে বাধা সৃষ্টি করার জন্য। ধরলাম যে সরকারি দলের এ কথাটি ঠিক নয়, কিন্তু বর্তমান সরকার ক্ষমতা হারালে যুদ্ধাপরাধী বিচারের কাজ ব্যাহত হবে, তখন উপকৃত হবে তাঁরাই যাঁরা প্রকৃত অর্থে যুদ্ধাপরাধ করেছিল। সে অর্থে বর্তমান আন্দোলনের সঙ্গে যুদ্ধাপরাধী বিচার নস্যাৎ করার একটি সংযোগ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে।

১২ মার্চের পর কী হবে, এটিও চিন্তায় আসছে। যদি ধরি যে লোকের অবস্থান ধরে রেখে বিরোধী দল আরব বসন্ত নিয়ে এল, তখন আরব বসন্তের সঙ্গে ঢাকার বসন্তের মধ্যে এ তফাতটুকু বুঝতে হবে যে আরব বসন্ত প্রতিটি ক্ষেত্রেই ন্যাটোসহ মার্কিনি পয়সায় পুষ্ট হয়ে মধ্যপ্রাচ্যের স্বৈরাচারী সরকারগুলোর পতন ঘটাতে তৎপর হয়েছে। সেখানে বহিঃপরাশক্তিগুলোর বিরাট স্টেইক বা বাজি রয়েছে, যেমন তৈলাধারগুলোর নিয়ন্ত্রণ নেওয়া। কিন্তু ঢাকার বসন্তের বেলায় একটি নির্বাচিত দলীয় সরকারকে জনতার চাপের মুখে সরে যেতে বাধ্য করার প্রচেষ্টা চলছে। কিন্তু সে দলেরও যে প্রায় সমান বা বেশি জনসমর্থন আছে, সেটি তো এড়িয়ে যাওয়ার উপায় নেই। আর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হলে সরকারি দল যদি জরুরি অবস্থা ঘোষণা করার মতো চরম ব্যবস্থা নেয়, তা হলে সেটি বাংলাদেশের কিছুটা বলীয়ান হয়ে উঠতে থাকা গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক পরিবেশের বিরুদ্ধে যাবে। আর যদি অবস্থা এমন চরম হয় যে সরকারের পতন ঘটল, পরিস্থিতি উত্তপ্ত হলো, সম্পদ নষ্ট এবং লোক ক্ষয় হতে থাকল, সুনিশ্চিত এবং তাৎক্ষণিক বিপদের সৃষ্টি হলো তখন অন্য কোনো শক্তি ক্ষমতা নিতে বাধ্য হবে, আবার আমরা ফিরে যাব চতুর্ভুজ এঁকে।

কিন্তু বাংলাদেশের লোক নৃতাত্ত্বিকভাবে সহিংস চরিত্রের নয়। অন্তত ইতিহাস তা বলে না। আবার ঐতিহাসিকভাবে বাংলাদেশের সমাজ জ্ঞানী ও ধী-শক্তিসম্পন্ন সমাজ। যদিও আমাদের প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক চর্চায় মেধার চেয়ে পেশির শক্তি বেশি বলে প্রতীয়মান হয়, কিন্তু প্রায়শই আমাদের মূল অর্জনগুলো এসেছে পরিণত রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত থেকে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের পর্যায়গুলো পাঠ করলে তাই-ই ধারণা হয়। এখনো আমার ব্যক্তিগত ধারণা সরকারি দল ও বিরোধী দল উভয়ই হূদয়ঙ্গম করতে পারছে যে সংঘর্ষের পথে গেলে কারোরই তেমন লাভ নেই, না আওয়ামী লীগের, না বিএনপির, দেশের মানুষের তো লাভ নেই-ই। রাস্তার ঠিক পাশেই সংসদ ভবন, সেখানে গিয়ে আলোচনা করুন। দেখবেন যে সমস্যা রাস্তায় সময় নেয় এক মাস, সেটা আলোচনার টেবিলে সময় নেয় এক ঘণ্টা। আলোচনার তৎপরতাটা আধুনিক, ঝুঁকি কম কিন্তু প্রাপ্তি বেশি।

একজন শৌখিন দাবাড়ু হিসেবে চিত্রপটটি আমার কাছে দাবা খেলার যুদ্ধের মতো মনে হচ্ছে। তবে ভীষণভাবে কামনা করব পরিস্থিতি যেন কোনোভাবেই পরস্পরবিরোধী দুই নেত্রীর নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে না যায়। দাবা খেলায় একই রঙের বড়ে যদি হাতির কোনাকুনি রাস্তা বন্ধ করে দেয় সে হাতিকে বলা হয় ব্যাড বিশপ বা অচল হাতি। দুই দলেরই নেত্রী দুজন ছাড়াও অধস্তন নেতারা এত আস্ফাালন করছেন যে নেত্রীদ্বয়ের কণ্ঠ চাপা পড়ে যাচ্ছে। তাঁরা ব্যাড বিশপ বা অচল হাতিতে পরিণত হচ্ছেন।