নগর পুড়লে দেবালয় এড়ায় না – সামারুহ মির্জা

 

আমার পিতা মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। আপাদমস্তক একজন রাজনীতিবিদ। আমি এই মানুষটি এবং অন্য আরও কিছু প্রসঙ্গ নিয়ে কিছু কথা লিখছি। নিজের পিতাকে নিয়ে লেখা বোধ হয় খুব শোভন নয়! আপাতদৃষ্টিতে এই অশোভন কাজটি আমি আজ করতে চাই, এবং করব। 

সামারুহ মির্জামির্জা আলমগীরের রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীরা তাকে শ্রদ্ধা করেছেন সব সময়। এলাকায় যেকোনো বিপদ আপদে প্রথমে ছোটে তাঁর কাছে, সমাধানের জন্য। সে যে দলেরই হোক না কেন, সে যে ধর্মেরই হোক না কেন।বলুকাকার একটি কথা মনে পড়ে গেল। নির্বাচনী প্রচারণায় আমি হাঁটছি এক পাড়া থেকে আরেক পাড়ায়। বলুকাকার বাসার সামনে এসেছি, সঙ্গে থাকা দুজন বললেন, ভিতরে যাবার দরকার নেই, তিনি আব্বুর বিরুদ্ধে প্রচারণা করছেন। আমি তবুও এগিয়ে গেলাম। ঘরে ঢুকতেই দেখি বলুকাকা আর কজন বসে। বললাম, বলুকাকা, আব্বুর জন্য প্রার্থনা করবেন। বলুকাকা হেসে বললেন, মাগো, রাজনৈতিক কারনে আমি তোমার বাবার বিরোধিতা করছি, কিন্তু মানুষ আলমগীরের জন্য আমার মঙ্গল কামণা নির্ভেজাল, সব সময়।
নাম বলছি না, তবে আওয়ামী লীগের এক বিখ্যাত বাগ্মী রাজনীতিবিদ এক টক শোতে আব্বুর সাথে বসতে চাননি। তার স্রেফ কথা, এই ভদ্রলোকের সাথে আমি ঝগড়া করতে পারবো না। শতভাগ সততার সাথে মানুষটি সারা জীবন রাজনীতি করেছেন, নিজের আদর্শ, নিজের বিশ্বাসের সাথে কখনো সমঝোতা করেন নি, শুধু বোঝেন নি, এই বাংলাদেশে তিনি বড়ই অনুপযুক্ত এক রাজনীতিবিদ। একটি “গনতান্ত্রিক” সরকার আজ এই মানুষটিকে যেভাবে অপদস্থ করল, তা আসলেই উদাহরণ হয়ে থাকবে চরম অবিচারের।
কি অপরাধ ছিল তাঁর? তিনি বিরোধী দলের জিএস, সরকারের সমালোচনা করতেন, কর্মীদের সংগঠিত করতেন, তাঁদের উজ্জীবিত করতেন সরকার বিরোধী আন্দোলনে প্রকাশ্যে বক্তৃতা দিয়ে, যা পুরো বাংলাদেশের মানুষ দেখত, শুনত, উপলব্ধি করার চেষ্টা করত। তিনি বোমাবাজি করেছেন, কিংবা করিয়েছেন? গাড়িতে আগুন দিতে বলেছেন? মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, মির্জা আলমগীরের চরম শত্রুও তা বিশ্বাস করবে না !৬৫ বছরের মানুষটাকে আমি প্রায় প্রশ্ন করতাম, আব্বু, এই নষ্ট, পচে যাওয়া সমাজে তুমি কেন এখনও রাজনীতি করছ? ৭১ পূর্ববর্তী রাজনীতির সেই পরিবেশ তো আর নেই। আগেও রাজনীতিবিদদের বন্দী করা হতো, তাদের সাথে যথাযথ ভাবে ব্যবহার করা হতো, আজতো কোন নিয়ম নাই, আইন নাই, বিচার নাই, আজ তো গ্রেফতার করেই রিমান্ডে নিয়ে গিয়ে প্রাগৈতিহাসিক ভাবে অত্যাচার করে। সব জঙ্গলের আইন। এসব বাদ দাও না। আব্বু স্মিত হেসে বলতেন, “শেষ চেষ্টাটা করেই দেখি, আমার তো চাওয়া, পাওয়ার কিছু নেই”। তাঁর খুব প্রিয় কবিতার একটি লাইন প্রায়ই আমাকে বলতেন “এখনি অন্ধ বন্ধ করো না পাখা”।

আমার এই বাবার বিরুদ্ধে এই সরকার দুটি আজব মামলা দিয়েছে। একটিতে অভিযোগ, আব্বু এবং আরও কজন মিলে সচিবালয়ে ককটেল ফুটিয়েছে বা ফোটাতে সহযোগিতা করেছে, আরেকটিতে অভিযোগ, তাঁর এবং আরও কজনের প্ররোচনায় ২৯শে এপ্রিল একটি বাস পোড়ানো হয়েছে।

মামলার চার্জশিট পড়ছিলাম। নিজের অজান্তেই হেসে উঠলাম। আমাকে হাসতে দেখে আমার এক স্টুডেন্ট প্রশ্ন করলো, কেন হাসছি। ওকে পুরো ঘটনাটা খুলে বললাম। ও অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকল। তোমার বাবাকে আসামী বানিয়েছে? এই মামলায়? ওর বিস্ময় দেখে বললাম, বাংলাদেশের ৯৯ ভাগ মানুষ তোমার মতই বিস্মিত! ওকে বললাম, জানো, এই সরকার, দুই তৃতীয়াংশ ভোট পেয়ে সরকার গঠন করেছে, এরা দিন বদলের কথা বলেছে! ওর বিস্ময় আরও বাড়ল। “বল কি? এটা নির্বাচিত সরকার ! আমিতো ভেবেছি, এটা স্বৈরাচারী সামরিক সরকার”। খারাপ লাগছিল। বললাম, “চিন্তা করো না, ঠিক হয়ে যাবে, সরকার একটু টালমাটাল এখন, ঠিক হয়ে যাবে”।

আন্তর্জাতিক মিডিয়াতে ঘটনাটা আসার পরে অনেকেই আমার কাছে জানতে চাইল পুরো ব্যপারটা। খুব চেষ্টা করলাম দেশের “ভাবমূর্তি” রক্ষা করে বুঝিয়ে বলবার! সকলকেই আশ্বাস দিলাম, আমাদের বিচার ব্যবস্থার উপর আস্থা আছে।আজ নিম্ন আদালত আব্বুদের জামিন নামঞ্জুর করে কারাগারে পাঠিয়েছে। রায় ঘোষণার পর পরই আব্বুক্কে ফোন দিলাম। ভীষণ পজিটিভ, হাসছিলেন আমার দুশ্চিন্তা দেখে। হঠাৎ গলাটা বোধ হয় আবেগে কিছুটা বুজে এলো। বললেন “মাগো, তুমি সাহস হারায়ও না, আমরা একসাথে এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করবো, করতেই হবে, যা-ই হোক, তুমি সাহস হারায়ও না মা”।আমি আর কথা বলতে পারলাম না। তাঁকে বললাম না, আমি আর স্বপ্ন দেখি না বাংলাদেশ নিয়ে, আমি আর আশা করি না, আমার কেন জানি আজকাল শুধু মনে হয়, ওরা ভিন্ন মতাবলম্বী, সাহসী, সত্যবাদী, দেশপ্রেমিক কোন বাংলাদেশী নাগরিককে মুক্ত থাকতে দিবে না। তুমি যদি স্বাধীন ভাবে কথা বলতে চাও,চুপ করে থাকো। এর কিছুই তাঁকে বলা হোল না। শুধু বললাম, “তুমি ভালো থেকো আব্বু”।

আমার প্রিয় শিক্ষক প্রফেসর আনোয়ার হোসেনের লেখা আজকাল প্রায় পড়ি। সব লেখাতেই অন্যায়ের বিরুদ্ধে, স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে তাঁর সংগ্রামের কথা, তাঁর ভাইয়ের আত্মদানের কথা, সোনার বাংলা নিয়ে তাঁর পরিবারের স্বপ্নের কথা। আমারও মনে পড়ে, ১/১১ এর পরে তাঁর সাহসী ভুমিকার কথা, আরেকটু আগেকার কথাও মনে পড়ে, শামসুন্নাহার হলে পুলিশ অভিযানের বিরুধধে তাঁর সাহসী ভুমিকার কথা, আমরা তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। স্যারকে দেখতে গিয়েছিলাম তাঁর বাসায়, তাঁর আগেও স্যারের বাসায় গেছি রাতের খাবার খেতে, কজন বন্ধুসহ। কিছুদিন আগে মেইলে পেলাম তাঁর চিঠি, ১/১১ এর পরে কোর্টে দেওয়া তাঁর জবানবন্দি সহ, তাঁকে ভোট দেওয়ার আবেদন করে।

এই স্যার আজ আর প্রতিবাদ করছেন না, গর্জে উঠছেন না, মিছিলে যাচ্ছেন না। উনি দেখছেন, সেই একই পুলিসি রিমান্ডে রাজনৈতিক নেত্রীকে চার পেয়ে পশুর মতো অত্যাচার করা হচ্ছে, মেয়েটি দাঁড়াতে পারছে না, সেই একই রিমান্ডে মানুষের মেরুদণ্ড ভেঙে দেওয়া হচ্ছে, সেই একই বাহিনী রাতে অন্ধকারে তুলে নিয়ে যাচ্ছে কারো বাবাকে, কারো স্বামীকে, কারো সন্তানকে, কদিন পরে বুড়িগঙ্গায় ভেসে উঠছে মানুষের হাত, পা। স্যার কিন্তু কিছুই বলছেন না।

বছরের পর বছর ধরে একজন অনির্বাচিত ভিসি বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্বে আছেন, তিনি কিছুই বলছেন না। স্যার একটি রাজনৈতিক আদর্শে বিশ্বাস করেন জানি। খুব স্বাভাবিক। প্রতিটি মানুষ রাজনৈতিক। কিন্তু যেকোনো অন্যায় তো অন্যায়ই, যেকোনো অবিচার তো অবিচারই, যেকোনো অত্যাচার তো অত্যাচারই, এসবের তো অন্য কোন নাম নেই, অন্য কোন সংজ্ঞা নেই। তবে? তাঁর এই নীরবতার কারণ কি? স্যারের একটি লেখা পড়লাম, কালের কণ্ঠে। তিনি লিখেছেন তাঁর প্রিয় শিক্ষককে নিয়ে। সেই লেখাতেও তিনি কয়েকবার উল্লেখ করলেন অন্যায়ের বিরুধধে তাঁর অতীত সংগ্রামের কথা। প্রশ্ন করি তাঁকে, আপনার ভাই যে আদর্শের জন্য জীবন দিয়েছেন তাঁর কতটুকু এই “সোনার বাংলায়” বাস্তবায়িত হয়েছে? প্রশ্ন করি তাঁকে, বর্তমান কে তিনি কিভাবে দেখছেন এবং বর্তমানে তিনি কি করছেন? সংগ্রাম কি চলমান প্রক্রিয়া নয়?

আমি স্যারের কথা উল্লেখ করলাম কারণ আমি মনে করি বাংলাদেশের বেশির ভাগ বুদ্ধিজীবীকে তিনি প্রতিনিধিত্ব করেন। আমাদের আঁতেলরা এক একটি দলের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করতে গিয়ে কেমন জানি বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী হয়ে যান। একটি মার্কা, একটি রঙ তাঁদের অন্ধ করে দেয়। চোখের সামনে সমাজটা নষ্ট হয়ে যায়, চোখের সামনে মানুষগুলো কুঁকড়ে যায়, চোখের সামনে দেশটা বধ্যভূমিতে পরিণত হয়, এদের কিচ্ছু যায় আসে না। (একটু আগেই খবর পেলাম, আনোয়ার স্যার জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি মনোনীত হয়েছেন, স্যারের সাম্প্রতিক নীরবতার কারণটা এখন বোধগম্য হোল)!

সোহেল তাজের পদত্যাগের পর একটা ব্যপার আমার কাছে পুরো পরিষ্কার। আমরা সবাই এক একটি সোহেল তাজ। আমরা খুব সাহস, উদ্যোগ নিয়ে নেমে পড়ি সমাজ বদলাবো বলে, ফেসবুকে এমন ঝড় তুলি, সে ঝড়েই যেন উড়ে যায় সব অনাচার, রাজনীতিবিদদের গালিগালাজ করে অর্গাজমের সমপরিমান আনন্দ বোধ করি, অন্যের পিণ্ডি চটকিয়ে দাবি করি, আমিই আলাদা, আমিই শুদ্ধ। তারপর যখন reality bites, দৈত্য গুলো কামড়ে দেয়, তখন গাল ফুলাই, অবুঝ শিশুর মত বলি “আমি তোমার সাথে আর খেলবো না”। বিশাল একটা চিঠি লিখে পালিয়ে যাই আমেরিকা। ব্যস, নাটকের এখানেই সমাপ্তি।

আমার কিছু উচ্চশিক্ষিত বন্ধু আছে, এরা প্রায়ই বিভিন্ন আড্ডায়, ফেসবুকে রাজনীতিবিদের পিণ্ডি চটকায়। খুব ফ্যাশনের কাজ, নিজের নিরপেক্ষতা প্রমানের কি সাংঘাতিক চেষ্টা, অনেক হাত তালি। ভাবখানা এমন “হোলতো ? দেশ ও সমাজের প্রতি দায়িত্ব পালন করা শেষ, এবার চলো, শীশা খেতে যাই”। সুবিধাবাদের চূড়ান্ত! রাজনীতিবিদদের গালি দিয়ে দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি বদলানো যায় না, এ সহজ কথাটি আমার উচ্চশিক্ষিত বন্ধুদের মাথায় ঢুকে না, সম্ভবত ইচ্ছাকৃত ভাবেই!

আমার বাবা একটি কথা আজকাল প্রায়ই বলেন, “আমাদের দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক পরিবর্তনে একটি অন্যতম মূল ভুমিকা রেখেছে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত । পুঁজিবাদ আর ভোগবাদের প্রভাবে এই মধ্যবিত্ত আজ নির্লিপ্ত হয়ে গেছে, সুবিধাজনক বলে”। আর আমার মাথা বলে, এটা খুব ভয়ংকর একটা অবস্থা। কোন নিয়মতান্ত্রিক ভাবে, সভ্যভাবে এই অবস্থার পরিবর্তন সম্ভব নয়। আজ ব্যক্তি মির্জা আলমগীরের উপর যে অন্যায় হলো, যে অবিচার হলো, এর ফল ভোগ করতে হবে পুরো জাতিকে। এ পরিষ্কার। আজ অথবা কাল। নগর পুড়লে দেবালয় এড়ায় না।