বেডরুম থেকে সাংবাদিকের অফিসকক্ষ!

ফজলুল বারী, সিডনি ॥ বিডিনিউজ অফিসের ভিতর সাংবাদিকদের ছোপ ছোপ রক্ত! দেখে বিস্মিত-স্তম্ভিত-বাকরুদ্ধ হয়ে যেতে হয়। এর আগে এমন রক্ত আমরা দেখেছি সাংবাদিক সাগর-রুনি’র বেডরুমে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তখন বলেছিলেন, কারও বেডরুম পাহারা দেয়া সরকারের পক্ষে সম্ভব নয়! কিন্তু এখন হামলা হয়েছে সাংবাদিকদের অফিসকক্ষে! তাও আবার যেনতেন অফিসে নয়। খোদ রাজধানী ঢাকায় একটি বার্তাসংস্থার প্রধান কার্যালয়ে! কী বলবেন এখন প্রধানমন্ত্রী? ক’দিন আগে ‘সাংবাদিক পেটালে কিছু হয় না (!)’— পুলিশকে এমন উদ্ধত ঘোষণা দিয়ে দিয়ে আমরা ঢাকা শহরের রাস্তায় বিনা উস্কানিতে একসঙ্গে তিনজন ফটো সাংবাদিককে পিটিয়ে মাটিতে শুইয়ে দিতে দেখেছি। পুলিশ প্রথমে তার নয় সদস্যকে সাময়িক বরখাস্ত করলেও ঘটনার নায়ক এসি শহিদুল ইসলামকে রাঙ্গামাটি বদলি করে পিঠ বাঁচাতে চেয়েছে। কিন্তু সাংবাদিকদের প্রতিবাদের মুখে পরে তাকেও সাময়িক বরখাস্ত করা হয়! কিন্তু এখন পর্যন্ত তাকে গ্রেফতার করা হয়নি। সাদা পোশাকে থাকা পুলিশের আরেক কর্মকর্তা স্যান্ডেল(চটিজুতা) খুলে সাংবাদিক জাহিদুল করিমকে লাথি মারছেন–সে ছবিও আছে; সেই আহমেদ কবির এখনও বহাল তবিয়তে অফিস করছেন! এসবের কী বার্তা পায় অশুভ শক্তি?

বিশ্ব শান্তিরক্ষী দিবস উপলক্ষে বাংলানিউজের রিপোর্টে বলা হয়েছে, জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনীতে বাংলাদেশ এখন দাপুটে অবস্থানে আছে; এটি দেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের তৃতীয় বৃহত্তম মাধ্যম! জাতিসংঘ বাহিনীতে সেনাবাহিনীর সদস্যদের পরেই পুলিশের অবস্থান। কাজেই বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনের তৃতীয় বৃহত্তম মাধ্যমটি রক্ষা করতে চাইলে সরকারকে তার এই পুলিশ বাহিনী নিয়ে গুরুত্বের সঙ্গে ভাবতে হবে। ‘দুষ্ট গরু’ বলে চিহ্নিতদের বিদায় করতে হবে এ বাহিনী থেকে। বিরোধীদলের নেতাকর্মীদের রাস্তায় গরু-ছাগলের মতো পেটাতে পুলিশকে এখন যে ঠ্যাঙ্গাড়ে বাহিনীর মতো ব্যবহার করা হছে, এ দুষ্টনীতি বদলাতে হবে। বিরোধী রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের রাস্তায় গরু-ছাগলের মতো পেটালে তার বিনিময়ে এখন পুলিশের প্রমোশন হচ্ছে! কী অদ্ভূত নৈরাজ্যের এ দেশ আমার! এসব কাণ্ড স্বৈরাচারী এরশাদের আমলে হয়েছে, বিএনপির আমলে হয়েছে, এখন এ আমলেও হচ্ছে! আল্লাহ’র ওয়াস্তে এসব রাষ্ট্রীয় নৈরাজ্য বন্ধ করুন। এসি শহিদুল কী তেমন কোনো প্রমোশনের আশায় সেদিনের কর্মটি করেছেন? এসব নৈরাজ্যের উৎসাহদাতা কে? পুলিশের কোন বিধিতে এভাবে মানুষ পেটানোর অধিকার দেয়া হয়েছে? এসব ছবি যত বিদেশে যাবে, তত কিন্তু কন্টকিত হবে জাতিসংঘ মিশনের দরজা। কারণ যেসব দেশের অনুদানে জাতিসংঘের কাজকর্ম চলে, সেসব দেশের ট্যাক্সপেয়ারদের মধ্যে বিষয়গুলো ছড়ালে কিন্তু খবর হতে বেশি সময় লাগবে না। কারণ এসব দেশ নিজেদের দেশের বাইরে যা-ই করুক, এদের ট্যাক্সপেয়াররা কিন্তু মানবাধিকারের বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দেন। তাদের টাকা এমন দেশের পিছনে যাচ্ছে যারা মানবাধিকারের ‘ম’ও মানে না, এমন খবর ছড়াতে শুরু করলে কিন্তু বিপদ বাড়বে দেশের! ক্রসফায়ার-এনকাউন্টার নামীয় রাষ্ট্রীয় মিথ্যাচার সমূহও বন্ধ করতে হবে। আর পুলিশের যেসব সদস্য এসব করছেন, জাতিসংঘ বাহিনীতে যেতে চাইলে তারা যেন সেই কোহিনুর মিয়ার দৃষ্টান্ত মনে রাখেন! আমেরিকার মতো দেশও কিন্তু মানবাধিকার লংঘনের দায়ে তাকে ভিসা দিতে রাজি হয়নি! সেই মহা দাপুটে(!) কোহিনুর মিয়া এখন কোথায়? অতএব সাধু সাবধান!

রাস্তায় মালপত্র রাখাকে কেন্দ্র করে একজন অফিস সহকর্মীর সঙ্গে বাদানুবাদের সূত্রে বিডিনিউজ অফিসে হামলা হয়ে থাকতে পারে বলে পুলিশের একটি সূত্র ধারণা দেবার চেষ্টা করেছে! এর জন্যে সন্ত্রাসীরা জোটবদ্ধ হয়ে একটি মিডিয়া অফিসে ঢুকে সাংবাদিকদের কুপিয়ে ছুরিকাহত করে চলে গেছে! এত সহজভাবে এসব যেন দেখার চেষ্টা না হয়। দেশে যে এখনও দুর্নীতিবাজরা আজান দিয়ে দুর্নীতি-মস্তানি করে না, একটু লুকিয়ে-ছাপিয়ে করার চেষ্টা করে, সে ও তো মিডিয়ার নজরদারির কারণে। মিডিয়ার একজন  হিসাবে আমার ধারণা, একের পর এক সাংবাদিক হত্যা-নির্যাতনের ঘটনার প্রতিকার না হওয়াতেই দুর্বৃত্তরা দিনে দিনে আস্কারা পাচ্ছে।

কিছুদিন আগে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, বিএনপি আমলে অতজন সাংবাদিক নির্যাতন হলেও আজকের মতো এমন প্রতিবাদ তো তখন হয়নি। কিন্তু সে আমলে সাংবাদিক হত্যার ঘটনাগুলোর বিচার কেন এ আমলেও আটকে আছে? শুধু সাংবাদিক শামছুর রহমান হত্যা মামলার দৃষ্টান্ত উল্লেখ করলেই প্রশ্নটি আরও পোক্ত হবে। ২০০০ সালের ১৬ জুলাই খুন হন শামছুর রহমান। তার নৃশংস হত্যাকাণ্ডের বিচার আজ পর্যন্ত শেষ করা হয়নি! শামছুর রহমানের পলাতক খুনিদের একজন বিএনপি নেতা তরিকুল ইসলামের দেহরক্ষী পাগলা সেলিম কিছুদিন আগে ভারতে গ্রেফতার হলেও তাকে দেশে ফিরিয়ে আনার কোনো উদ্যোগ নেয়নি সরকার! বঙ্গবন্ধুর পলাতক খুনিদের ভারত থেকে ফিরিয়ে আনতে সরকার যত সক্রিয়, অন্য খুনিদের ব্যাপারে এর কিয়দংশ চেষ্টাও আছে কী? আসলে বিএনপি-আওয়ামী লীগ দুই দলই যে সাংবাদিক খুন-নির্যাতন এসবের ব্যাপারে নিস্পৃহ তা শুধু শামছুর রহমান হত্যা মামলার দৃষ্টান্ত দিয়ে চোখে আঙ্গুল দিয়ে বলে দেয়া যায়। এখন খালেদা জিয়া বিরোধীদলে বলে সাংবাদিক খুন-নির্যাতনের নিন্দা করছেন, অথচ ২০০১ সালে ক্ষমতায় গিয়ে তিনিই শামছুর হত্যা মামলার সব গ্রেফতারকৃত আসামিকে জামিনে বের করে নিয়েছেন! সাংবাদিক খুন-নির্যাতনের বিচারের বাণী এভাবে খালেদার আমলেও নীরবে মাথা কুটে মরেছে, যা ঘটছে শেখ হাসিনার আমলেও! এর প্রতিকার করতে পারে কেবল ঐক্যবদ্ধ সাংবাদিক আন্দোলন।

সাংবাদিক নেতাদের বলছি, আল্লাহ’র ওয়াস্তে ঐক্য বজায় রেখে হাঁটুন। আপনাদের ঐক্যের কারণে এসি শহিদুলকে এখন সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। শুধু এটা না, দুর্বৃত্ত চরিত্রের পুলিশদের  স্থায়ী বহিষ্কারের দাবি তুলুন। একটা দৃষ্টান্ত হোক। এমন দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করতে না পারলে কিন্তু আগামীতে এমন ঘটনা ঘটতেই থাকবে, প্লিজ!

ফজলুল বারীঃ সিডনিপ্রবাসী সাংবাদিক