খুনী রূপমকে ফাঁসিতে ঝুঁলিয়ে মৃত্যুদন্ডের রায় – বরিশালের আলোচিত শিক্ষক ও মুক্তিযোদ্ধা জিন্নাত আলী হত্যা মামলার রায় ঘোষনা

খোকন আহম্মেদ হীরা, বরিশাল ॥ বরিশালের বহুল অলোচিত বীর মুক্তিযোদ্ধা ও শিক্ষক জিন্নাত আলী হত্যা মামলার আজ বুধবার রায় ঘোষনা করা হয়েছে। ওই রায়ে হত্যাকারী ঘাতক রূপম চন্দ্র দে’কে (২১) ফাঁসিতে ঝুঁলিয়ে মৃত্যুদন্ডের রায় কার্যকর ও অপর আসামি মনোয়ার হোসেন টাপ্পুকে বেকসুর খালাস দেয়া হয়েছে। জেলা ও দায়রা জজ একেএম সলিমউল্লাহ বুধবার দুপুর আড়াইটায় এ রায় ঘোষণা করেন।

আদালত সূত্রে জানা গেছে, নগরীর রূপাতলী এ ওয়াহেদ মাধ্যামিক বিদ্যালয়ের গণিত শিক্ষক ও বীর মুক্তিযোদ্ধা জিন্নাত আলীর কন্যা নগরীর মডেল স্কুল এন্ড কলেজে একাদশ শ্রেনীর ছাত্রী তাজরীন জিন্নাত সুপ্তিকে প্রেমের প্রস্তাবে দীর্ঘদিন থেকে উত্যক্ত করে আসছিলো নগরীর বাজার রোড এলাকার সুলতানী বিড়ি ফ্যাক্টরীর পিছনের বাসিন্দা মৃত কৃষ্ণ চন্দ্র দে’র বখাটে পুত্র রূপম চন্দ্র দে। এ ঘটনায় স্কুল শিক্ষক থানায় সাধারন ডায়েরী করায় ক্ষিপ্ত হয়ে ২০১১ সনের ২৫ নবেম্বর সন্ধ্যায় বখাটে রূপম তার সহযোগীদের নিয়ে শিক্ষক জিন্নাত আলীকে তার রূপাতলী শের-ই বাংলা সড়কের ভাড়া বাসার সন্নিকটে বসে ছুরিকাঘাত করে গুরুতর জখম করে। স্থানীয়রা জিন্নাত আলীকে মুর্মুর্ষ অবস্থায় উদ্ধার করে শের-ই বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করেন। চিকিৎসাধীন অবস্থায় শিক্ষক জিন্নাত আলীর অবস্থার অবনতি হলে ২৬ আগস্ট তাকে (জিন্নাত আলীকে) ঢাকায় প্রেরন করা হয়। এ্যাম্বুলেন্সযোগে জিন্নাত আলীকে ঢাকায় নেয়ার পথিমধ্যে গৌরনদী এলাকায় তিনি (জিন্নাত আলী) মৃত্যুর কোলে ঢলে পরেন।

এ ঘটনায় ওইদিন রাতে নিহত জিন্নাত আলীর স্ত্রী কাজী শিরিন বাদি হয়ে কোতোয়ালী মডেল থানায় বখাটে রূপম চন্দ্র দে, তার সহযোগী মানোয়ার হোসেন টাপ্পু ও আরিফুর রহমান মিঠুকে আসামি করে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। আলোচিত এ মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা এস.আই আবু সাইদ গত ১৩ জানুয়ারি হত্যাকারী ঘাতক রূপম চন্দ্র দে ও তার একমাত্র সহযোগী হিসেবে মনোয়ার হোসেন টাপ্পুকে অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন। মামলার ২৯ জন স্বাক্ষীর মধ্যে ২৮ জনের স্বাক্ষী গ্রহণ শেষে বুধবার জেলা ও দায়রা জজ একেএম সলিমউল্লাহ তার আদালতে বরিশালের আলোচিত মুক্তিযোদ্ধা ও শিক্ষক জিন্নাত আলী হত্যা মামলার প্রধান ঘাতক বখাটে রূপমকে ফাঁসিতে ঝুঁলিয়ে মৃত্যুদন্ডের রায় কার্যকর ও অপর আসামি মনোয়ার হোসেন টাপ্পুকে বেকসুর খালাস প্রদানের রায় ঘোষনা করেন। বেখসুর খালাসপ্রাপ্ত মনোয়ার হোসেন টাপ্পু নগরীর ভাটিখানা সাহাপাড়া রোডের বাসিন্দা হারুন-অর রশিদের পুত্র। মামলার পর থেকে পুলিশের গ্রেফতার আতংকে টাপ্পু পলাতক রয়েছে।

যেভাবে গ্রেফতার হয় খুনী রূপম: বীর মুক্তিযোদ্ধা ও স্কুল শিক্ষক জিন্নাত আলীকে হত্যাকারী ঘাতক রুপম চন্দ্র দে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার সময় গত ২৮ নবেম্বর যশোরের খাজুরা বাসষ্ট্যান্ড থেকে পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে। ওইসময় গ্রেফতারকৃত রূপমের কাছ থেকে রক্তমাখা চাক্কু উদ্ধার করা হয়। রুপম পালিয়ে ভারতে যাওয়ার জন্য ঢাকা থেকে বেনাপোলগামী উদয়ন এলিগেন্স পরিবহনে রওয়ানা হয়েছিলো। গোপন সংবাদের ভিত্তিতে এ খবর পেয়ে বরিশাল কোতয়ালী মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ ওসি মোঃ শাহিদুজ্জামানের নেতৃত্বে পুলিশের একটি দল ওৎপেতে যশোরের খাজুরা বাসস্ট্যান্ডে বসে এলিগেন্স পরিবহনে তল্লাশী চালিয়ে খুনী রূপমকে গ্রেফতার করে। ওইসময় পুলিশ রূপমের ব্যাগ থেকে হত্যাকান্ডে ব্যবহৃত রক্ত মাখা চাক্কু, জিডি প্রত্যাহারের জন্য কাউনিয়া থানার ওসির বরাবরের একটি আবেদনপত্র ও নিজের লেখা কবিতার খাতা উদ্ধার করেন। আলোচিত এ মামলার প্রধান খুনী রূপমকে কৌশলে গ্রেফতার করায় ওই সময় বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের মেয়র শওকত হোসেন হিরনের পক্ষ থেকে অভিযানকারী কোতোয়ালী থানা ও  মেট্রো ডিবি পুলিশ সদস্যদের ৫০ হাজার টাকা পুরস্কার দেয়া হয়েছিলো।

গ্রেফতারের পর পুলিশের পক্ষ থেকে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে খুনী রূপম হত্যার কথা অকপটে স্বীকার করে নিজের রচিত নাটকে বলেছিলো-স্যারের (জিন্নাত আলীর) মেয়ে তাজরীন জিন্নাত সুপ্তির সাথে আমার সাড়ে তিন বছর ধরে প্রেমের সর্ম্পক ছিলো। প্রায় এক বছর থেকে সে (সুপ্তি) আমাকে এড়িয়ে চলতে থাকে। এরপর বিভিন্ন সময়ে আমি রাস্তা ঘাটে বসে তার (সুপ্তির) সাথে কথা বলার চেষ্টা করে ব্যর্থ হই। এ ঘটনা সুপ্তি স্যারকে জানালে সে (জিন্নাত আলী) আমার বিরুদ্ধে থানায় একটি সাধারন ডায়েরী করেন। এরপর থেকে পুলিশ বিভিন্ন সময় আমার বাড়িতে অভিযান চালায়। উপায়অন্তুর না পেয়ে আমি তখন ঢাকায় চলে যাই। পরবর্তীতে আমি বাড়িতে আসলে পুলিশ আবার আমার বাসায় অভিযান চালায়। ওই দিনই আমি পূর্ণরায় ঢাকায় চলে যাই। এরপর সুপ্তিকে ফোন করে সাধারন ডায়েরীটি প্রত্যাহারের জন্য অনুরোধ করি। কিন্তুসে (সুপ্তি) আমাকে পুলিশে ধরিয়ে দেয়ার ভয় দেখায়। কয়েকদিন আগে স্যারকে (জিন্নাত আলীকে) মোবাইল ফোনের মাধ্যমে জিডিটি প্রত্যাহারের জন্য অনুরোধ করলে সে আমাকে বাসায় আসতে বলে। তার কথা অনুযায়ী গত ২৫ নবেম্বর থানায় জিডি প্রত্যাহারের একটি লিখিত আবেদন নিয়ে আমি স্যারের বাসায় যাই। কিন্তু স্যারে জিডি না উঠিয়ে আমাকে পুলিশে ধরিয়ে দেয়ার হুমকি দেয়। ঘরের বাইরে বের হয়ে আসার সময়ে স্যার পুলিশকে ফোন করতে চাইলে আমি তার পেটে চাক্কু ঢুকিয়ে দেই। এতেই যে স্যার মারা যাবে তা বুঝতে পারিনি।

পরবর্তীতে বীর মুক্তিযোদ্ধা ও স্কুল শিক্ষক জিন্নাত আলী হত্যা মামলার আসামিদের দৃষ্টান্ত মূলক শাস্তির দাবিতে গোটা দক্ষিণাঞ্চল উত্তাল হয়ে উঠেছিলো। একই দাবিতে সর্বস্তুরের জনসাধারনের উপস্থিতিতে বিভিন্ন জেলা ও উপজেলায় অব্যাহত ভাবে অনুষ্ঠিত হয় বিক্ষোভ মিছিল, সমাবেশ ও মানববন্ধন। অবশেষে গতকাল বুধবার আলোচিত এ মামলার রায়ে সন্তুটি প্রকাশ করেছেন মামলার বাদি নিহত জিন্নাত আলীর স্ত্রী কাজী শিরিনসহ সুশীল সমাজের নেতৃবৃন্দরা।

খুনী রূপমকে ফাঁসিতে ঝুঁলিয়ে মৃত্যুদন্ডের রায় - বরিশালের আলোচিত শিক্ষক ও মুক্তিযোদ্ধা জিন্নাত আলী হত্যা মামলার রায় ঘোষনা