ঈদের আনন্দ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে ছোটমনি নিবাসের অনাথ শিশুরা – কর্মচারীদের বেতন বন্ধ এগারো মাস

গৌরনদী ডটকম ডেস্ক ॥ এইমাত্র যে শিশুটির জন্ম হল তার নাম কি? কে রাখবে, কি রাখা হবে তার নাম? ও কি হিন্দু, মুসলিম, খ্রিষ্টান নাকি বৈদ্য ধর্মালম্বি? কে ওর বাবা-মা? কোথায় জন্ম হয়েছে তার, তা কেউ কোন দিন বলতেও পারবেনা? কিছুই জানেনা এইমাত্র জন্ম নেয়া নিষ্পাপ মানব শিশুটি! বড় হয়ে সে একদিন জানবে- পৃথিবীতে একজন মানব সন্তান হিসেবে কোন এক মায়ের গর্ভে তার জন্ম হয়েছিল। জন্ম নিয়ে পিতৃ-মাতৃ স্নেহ বঞ্চিত শিশুটির নাম আমেনা আক্তার তানহা। বরিশাল বিভাগীয় আগৈলঝাড়া বেবী হোমের কর্মচারীরা তার নাম রেখেছে।

বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গত ১ আগষ্ট তথাকথিত মা, তাকে ভর্তি করে পালিয়ে যায়। হাসপাতালের ভর্তির বহিতে তার জন্ম তারিখ লেখা রয়েছে ২৫ জুলাই ২০১২। মা, পালিয়ে যাওয়ার পর ভর্তি বহিতে তার দেয়া ঠিকানা অনুযায়ী যোগাযোগ করে শিশু বা তার বাবা-মা’র সঠিক কোন পরিচয় পাওয়া যায়নি। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ অনেক খোঁজাখুজির পর শিশুটির কোন সঠিক পরিচয় না পেয়ে সমাজসেবা অধিদপ্তরের সরনাপন্ন হলে গত ২ আগষ্ট তার শিশুটির ঠাই মেলে গৈলা বিভাগীয় ছোটমনি নিবাস বা বেবী হোমে। এখানেই তার নাম রাখা হয়েছে আমেনা আক্তার তানহা। এ রকম জন্ম পরিচয় পাওয়া গেল ৭ মাস বয়সের ঐশি’র। সেও এসেছে বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে। ৬ বছর বয়সি মুসফিক এসছে পটুয়াখালী জেনারেল হাসপাতাল থেকে। জন্মের পর তাকে ফেলে দেয়া হয়েছিল একটি ডাষ্টবিনে। কাক ডাকা ভোরে একদল কাক তার দু’চোখ খুচিয়ে উপরে ফেলে ক্ষত বিক্ষত করেছিল সমস্ত দেহ? কোন একজন এ অবস্থা দেখে উদ্ধার করে ভর্তি করে পটুয়াখালী হাসপাতালে। চিকিৎসকরা তাকে সুস্থ্য করে তোলার পর তার ঠাঁই হয় তানহা, ঐশি’র মত গৈলা বেবী হোমে। বেবী হোমের মাধ্যমে ঢাকার চক্ষু হাসপাতালে চিকিৎসা করালেও চিকিৎসকেরা বলেছেন তার চোখের আলো নিভে গেছে চিরদিনের জন্য? কত নিষ্ঠুর বিধাতা! পৃথিবীতে এমন হাজারো শিশুর সাথেই করেছেন নিষ্ঠুর আচরণ। যাদের একাংশের ঠাঁই হচ্ছে বরিশালের গৈলা বিভাগীয় ছোটমনি নিবাস বা বেবী হোমসহ দেশের বিভিন্ন বেবী হোমে।

শিশুরাই জাতির ভবিষ্যত। প্রতিটি শিশুর রয়েছে পূর্ণ মানবিক মর্যাদাসহ বেঁচে থেকে বেড়ে ওঠার জন্মগত অধিকার। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে প্রতিটি শিশুকে সুষ্ঠভাবে লালন পালন, রক্ষনাবেক্ষণ ও উন্নয়নের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহন করে তাদের সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা প্রতিটি পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের নৈতিক দায়িত্ব ও কর্তব্য। তবে আমরা এর কতটুকু দ্বায়িত্ব পালন করতে পেরেছি? জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদ এবং আন্তর্জাতিকভাবে গৃহীত সীদ্ধান্তবলীতে সকল শিশুর অধিকার প্রতিষ্ঠা ও সংরক্ষণ, মানবিক উন্নয়ন ও সর্বোত্তম স্বার্থরক্ষার প্রতি বিশেষ গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। বাংলাদেশও জাতিসংঘের সনদে স্বাক্ষর করা দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম। তাই এ লক্ষ্যে হাসপাতাল বা রাস্তাঘাটে পরিত্যক্ত অবস্থায় প্রাপ্ত দাবিদারহীন শিশু, হারিয়ে যাওয়া বিপন্ন শিশু, পাচারকারীদের কবল থেকে উদ্ধারকৃত শিশু, নিরাপদ হেফাজত ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য জেলখানা হতে প্রেরিত শিশু, পিতৃ-মাতৃহীন শিশু, অন্যান্য সূত্র হতে প্রাপ্ত দুর্দশাগ্রস্থ ও বিপন্ন শিশুদের জন্য ১৯৬২ সনে ঢাকায় ছোটমনি নিবাস স্থাপনপূর্বক এ সকল শিশুদের লালন-পালন পূর্বক তাদের দ্বায়িত্ব গ্রহন করে সমাজসেবা অধিদপ্তর। প্রকল্পটি পথ শিশুদের জন্য আশ্রয়দান, অভিভাবকত্ব গ্রহণ ও ভরন পোষনের ব্যবস্থা, মাতৃ øেহে লালন পালন, শিক্ষা, প্রশিক্ষণ, স্বাস্থ্যসেবা, চিত্ত বিনোদনের ব্যবস্থাসহ উন্নয়ন ও পূনর্বাসনের লক্ষ্যে রাষ্ট্রিয় পর্যায়ে উপযোগী করে গড়ে তোলার ইতিবাচক ভূমিকা পালন করে আসছে। ফলে পর্যায়ক্রমে ২০০৩ সনের মধ্যে ঢাকা, চট্রগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল ও সিলেটে গড়ে ওঠে দেশের ছয়টি বিভাগীয় ছোটমনি নিবাস বা বেবী হোম। যেখানে ৫৫০ জন শিশুর মানসিক বিকাশের মাধ্যমে বেড়ে ওঠার কথা ছিল। তবে শুরু থেকেই শিশুদের মেধা বিকাশের জন্য  নিয়োগ দেয়া হয়নি কোন শিক্ষককে। প্রতি শিশুর জন্য গড়ে প্রতিদিন ২৬ টাকা ৩৫ পয়সা হিসেবে মাসে ৭০৯ টাকা ৫০ পয়সা বরাদ্দ করে সরকার। যা বর্তমান বাজারের প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত নঘন্য। এ সকল বেবী হোমে শিশুদের লালন পালনের জন্য জনবল কাঠামো নিয়োগ দেয়া হয় ৯৩ জনকে। ২০০৩ সনের ৩০ জুন প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হলেও তৎকালীন সময়ের সরকার প্রকল্পটি রাজস্বখাতে না নেয়ায় স্থবির হয়ে পরে এর কার্যক্রম। জনবল কাঠামোর বেশিরভাগই অন্যান্য কর্মস্থলে যোগদান করেন। যারা নিস্পাপ শিশুদের ভুলে অন্য কোথাও যেতে পারেনি তারা আজ পর্যন্তওই সকল আশ্রিত শিশুদের মত মানবেতর জীবন যাপন করছেন। ২০০৩ সনের জুলাই মাস থেকে প্রকল্পেরে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের রাজস্বখাতে নেয়ার প্রক্রিয়া আজও বাস্তবায়ন হয়নি। ঝুলে আছে বছরের পর বছর। ফলে বছরে একবার বা দু’বার সরকার বরাদ্দ দিলে তারা বেতন তোলেন। উৎসব বোনাস তাদের ভাগ্যে জোটেনা। ১১ মাস আগে ২০১১ সনের সেপ্টেম্বর মাসে সর্বশেষ বেতন পেয়েছেন বেবী হোমের কর্মচারীরা। গত ঈদ-উল-আজহার বোনাসও হাতে পাননি তারা। শিশুদের খাবারের জন্য চলতি বছরের জুন পর্যন্ত বরাদ্দর পর আসন্ন ঈদের আগে এখন পর্যন্তও বরাদ্দ পাওয়া যায়নি।

বরিশালের আগৈলঝাড়ার গৈলায় অবস্থিত ১’শ আসন বিশিষ্ট ছোটমনি নিবাস বা বেবী হোম এর অফিস সহকারী নুরুজ্জামান মোল্ল¬া বলেন, একই অবস্থা দেশের খুলনা ও সিলেট বেবী হোমের। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বরিশালের গৈলায় ১’শ আসনের বেবী হোমে বর্তমানে ২২ জন শিশু আশ্রিত রয়েছে। যাদের বয়স শুন্য থেকে ৫ বছর। ১৭ জনের স্থানে কর্মরত রয়েছেন ১০ জন ষ্টাফ। ১১ মাস যাবত বেতন পাচ্ছেন না তারা। শিশুদের জন্য সরকারি বরাদ্দ শেষ হয়েছে দু’মাস আগে জুন মাসে। বর্তমানে ঠিকাদার এম.এল এন্টারপ্রাইজের মালিক লুৎফর রহমানের উদ্যোগে চলছে শিশুদের খাবারের ব্যবস্থা। শিশুদের প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষাদান ও মেধা বিকাশের জন্য আলাদা কোন শিক্ষক নিয়োগ না থাকলেও এতদিন কর্মচারীরা এটা করে আসছিলেন। সম্প্রতি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশ আগৈলঝাড়া এডিপির উদ্যোগে সাধারন শিক্ষা বিষয়ের জন্য একজন শিক্ষক ও শিল্পকলার জন্য (নাচ-গান) একজন শিক্ষক নিয়োগ সহ শিল্পকলার সকল সরঞ্জাম সরবরাহ করা হয়েছে।

আর ক’দিন পর আসছে পবিত্র ঈদুল-ফিতর। বরিশাল বিভাগীয় বেবী হোমের ২২ জন অনাথ শিশুরা বোঝেনা ঈদ আনন্দ কি? সরকারিভাবে এখনো আসেনি তাদের জন্য কোন বরাদ্দ। ১১ মাস বেতন পাচ্ছেন না কর্মচারীরা। তবে ছোটমনি নিবাসের উপ-তত্ত্বাবধায়ক আবুল কালাম আজাদের উদ্যোগে অনাথ শিশুদের জন্য এক সেট করে নতুন জামা-কাপর এর ব্যবস্থা করা হয়েছে। ঈঁদের দিন কি খাবার জুটবে তাদের ভাগ্যে তা এখনও নিশ্চিত হয়নি। ছোটমনি নিবাসে গিয়ে কথা হয় আশ্রিত ওইসব অনাথ শিশুদের সাথে। আশ্রিত শিশু আবদুল্ল¬াহ জানায়, “মা কি জিনিস তা সে জানেনা। তবে ভাইয়াদের (কর্মকর্তা- কর্মচারীদের) মুখে মায়েদের কথা শুনে তারও মায়ের সাথে ঈদ করতে এবং মায়ের ভীষন আদর পেতে  ইচ্ছে করে বলেও উল্লেখ করে। একইভাবেই বলে, বিলকিস, মাহতাবসহ অন্যান্য শিশুরা। এ নিবাসের অবুঝ শিশুরা কেউ বোঝেনা ঈঁদ কি? ছোটমণি নিবাসের আয়া শাহিদা আক্তার বলেন-“মানবাধিকার বঞ্চিত শিশুদের ঈঁদের অনন্দ দিতে আমরা সাধ্যমতো চেষ্টা করে থাকি। ঈঁদের দিনে আমরা সবাই ওদের (আশ্রিত শিশুদের) সাথে সময় কাটাই। শিশুরা যাতে মন খারাপ করে বসে না থাকে সে জন্য আমরা তাদের সব সময় আনন্দ দিয়ে রাখি। দেশের শিল্পপতি, রাজনৈতিক নেতারাও এখন পর্যন্ত এগিয়ে আসেনি বেবী হোমের শিশুদের পাশে। এলাকা তথা দেশের বিত্তবানরা একটু এগিয়ে আসলে এসব অনাথ শিশুরা অন্তত ঈদের দিনটি ভাল ভাবে কাটাতে পারতো।

ঈদের আনন্দ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে ছোটমনি নিবাসের অনাথ শিশুরা - কর্মচারীদের বেতন বন্ধ এগারো মাস