স্বাধীনতার ইতিহাস মুছে ফেলার ষড়যন্ত্র চলছে

মোহাম্মদ গোলাম নবী : শরীরটা কয়েকদিন ধরে ভালো যাচ্ছে না। মনটাও অস্থির লাগছে। কোন কাজেই মন বসছে না। অস্থিরতা থেকেই বোধহয় ফেসবুক আর ব্লগের তৎপরতা বেড়েছে। শুনেছি মানুষের মন যখন অস্থির থাকে তখন মানুষ দুঃস্বপ্ন দেখে। আজকে আমিও দুঃস্বপ্ন দেখেছি।

দুঃস্বপ্ন দেখে ঘুম ভাঙ্গলে সিনেমা নাটকে দেখি ঢক ঢক করে এক গ্লাস পানি খায়। কিন্তু আমার কোন তেষ্টা পাচ্ছিল না। আমি ধীরে সুস্থে বিছানা থেকে নেমে টয়লেট সেরে ল্যাপটপে ইন্টারনেট কানেক্ট করলাম। মনে থাকতে থাকতে দুঃস্বপ্নটা লিখে ফেলব ভাবছি। কয়েক মিনিটের মধ্যে লেখার ইচ্ছেটা চলে গেলো। আমি বুঝতে পারছি অস্থিরতার কারণেই এমনটা হচ্ছে। তবে এর পরের ঘটনাটার জন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম না। হঠাৎ করেই আমার অনেক খিদে লাগলো। এতো সকালে আমার সাধরণত খিদে লাগে না। তাহলে কেন লাগলো? আমি বুঝতে পেরেছি। আমি খিদেটাকে চিনতে পেরেছি। এমন খিদের অনুভূতি ইতোপূর্বে আমার কয়েকবার হয়েছিল।{loadposition bodybottom1}

সময়টা সম্ভবত ১৯৮৬ সালের ২০ এপ্রিল এটলাস স্টার ডোবার সময় আমি নদীতে। ওই লঞ্চ থেকে কয়েকশ গজ দূরে। স্টিমারে। ঝড় উঠার পর স্টিমার মাঝ নদীতেই নোঙ্গর করল। সবাই প্রার্থনা করছে। আমিও করছি। কিন্তু স্থির হয়ে কোথাও দাড়াতে পারছিলাম না। এক পর্যায়ে দোতলা থেকে নিচে নামলাম। সিড়ি দিয়ে পুরোটা নামার আগেই যে দৃশ্য দেখলাম তাতে মনে হলো আর বাকি নাই। স্টিমারের সামনের অংশ ক্ষণে ক্ষণে পানির নিচে চলে যাচ্ছে। আমি সিড়ি দিয়ে উপরে উঠে এলাম। হঠাৎ করেই আমার খিদে পেলো। ক্যান্টিনে গিয়ে এক প্যাকেট বিস্কুট চাইলাম। মুহুর্তের মধ্যে কয়েকজন বলে বসলো, মানুষ মারা যাচ্ছে আর এই পোলা খাওয়া খোঁজে! খিদে লাগলে আমি কি করবো? এখন মনে করতে পারছি না আমি কি চিৎকার করে বলেছিলাম নাকি স্বাভাবিক গলায় বলেছিলাম। যেভাবেই বলে থাকি দোকানদার আমাকে এক প্যাকেট (সম্ভবত গ্লুকোজ) বিস্কুট দিলো। আমি বিস্কুট হাতে নিয়ে একটা বয়ার কাছাকাছি গিয়ে দাড়ালাম। আমি জানি কোন লাভ নেই। তবুও।

দ্বিতীয় ঘটনাটাও নদীতে। পটুয়াখালী থেকে দেড়তলা লঞ্চে খেপুপাড়া যাচ্ছি। গলাচিপা থেকে ছেড়ে আসার কিছুক্ষণ পর হঠাৎ করেই ঝড় উঠল। লঞ্চ থেকে নদীর পাড়ের দিকে তাকিয়ে দেখি নদীর পাড়ের গাছগুলো নুয়ে পড়ছে। পানি নদীর পাড়ে বাড়ি খেয়ে এতোটাই উঠছে যে গাছ ছাড়িয়ে যাবে! লঞ্চটা মুহুর্তেই যেন ডিঙ্গি নৌকা হয়ে গেলো। কয়েকজন চিৎকার করে বলছে কেউ যেন নড়াচড়া না করেন। কারণ মানুষের চলাচলে লঞ্চ কাত হয়ে ডুবে যেতে পারে। কেউ কেউ পরামর্শ দিচ্ছে গলাচিপা ফিরে যেতে। সারেং সেকথা শুনছে না। কারণ লঞ্চ ঘুরাতে গেলে ডুবে যেতে পারে। সে শক্ত করে হাল ধরে লঞ্চ সোজা চালিয়ে নিচ্ছে। মানুষের প্রার্থনার পাশাপাশি গবেষণা চলছে কি করা উচিৎ কি উচিৎ নয়। এদিকে আমার পেটের মধ্যে মোচড় দিয়ে খিদে লেগে গেলো। আমি উঠে গুটিগুটি পায়ে লঞ্চের পেছনে চলে এলাম। এই লঞ্চগুলোর ক্যান্টিন থাকে পেছনভাগের নিচের তলায়। কায়দা করে পেছনে নামতে হয়। লঞ্চের দুলুনিতে পেছনে নামাটা বেশ কঠিন হলো। ক্যান্টিনের লোকটাকে দেখে মনে হলো না যে সে ভয় পেয়েছে। উপরের লোকদের মুখ যতো শুকনো দেখেছি তার কোন প্রতিক্রিয়াই এই লোকের মুখে নেই। আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, লঞ্চ কি ডুবে যাবে? তার জবাব ছিলো, না ভাইজান কিছুই হইব না। আমি তার কথা বিশ্বাস করলাম। কিন্তু সন্দেহ রয়ে গেলো। আমি তাকে বললাম, আমাকে চা বিস্কুট দেন। ক্রিমওয়ালা বিস্কুট দেন। প্রথম চায়ের কাপের অর্ধেক চা-ই পড়ে গেলো। সে আরেক কাপ বানালো। ওখানে দাড়িয়ে দাড়িয়ে ৮/১০টা বিস্কুট খেয়ে ফেললাম। লোকটা বলল, ভাইজান ভয় পাইছেন। আমার তখন মনে হলো, লঞ্চ ডুবলে এই লোক হয়তো আমাকে সাহায্য করবে। আমি তাকে বললাম, আমি সাতার জানি না। এখানে আছি। লঞ্চ ডুবলে সম্ভব হলে আমাকে বাঁচাবেন। ঝড় যেমন হঠাৎ এসেছিল তেমনি হঠাৎই চলে গেলো। তবে লঞ্চ খেপুপাড়া না পৌঁছা পর্যন্ত আমি ওখানেই দাড়িয়ে ছিলাম।{loadposition bodytop1}

আর আজকে স্বপ্ন দেখে আমার সেই অনুভূতি হলো। আমি আজকে স্বপ্নে দেখলাম ২০২১ সালের মধ্যে স্বাধীনতার প্রকৃত ইতিহাস মুছে ফেলার সূক্ষ্ম ষড়যন্ত্র চলছে। ২০২১ সালে আমাদের স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পূর্তির আগেই স্বাধীনতা সংশ্লিষ্ট গৌরবের বিষয়গুলোকে এমনভাবে মুছে ফেলা হবে যাতে করে সেসব আর মানুষের আলোচনায় আসবে না……………………খুব উল্টাপাল্টা স্বপ্ন দেখলাম।

স্বপ্নে আমি চলে গিয়েছি ২০২১ সালে। ৫০ বছর পূর্তির অনেক বড় আয়োজন হয়েছে। পত্র পত্রিকায় বড় বড় লেখা ছাপা হচ্ছে। টেলিভিশনে আলোচনা হচ্ছে। সেসব আলোচনায় অন্য অনেক কিছুর সঙ্গে দেশের বীর সন্তানদের নিয়েও আলোচনা করছে। কিন্তু সেই আলোচনায় স্বাধীনতা যুদ্ধের মহান শহীদ বীরশ্রেষ্ঠ নেই, নেই বীর উত্তম, বীর বিক্রমদের নাম। যাদের কথা আলোচনা করা হচ্ছে তারা বাংলাদেশের বীর সন্তান, তাদের খেতাব হলো- বীর মৃত্যুঞ্জয়ী, বীর চিরঞ্জিব ও বীর দুর্জয়।……………………..আরো অনেক কিছুই বদলে ফেলা হয়েছে…………….দেশের প্রায় সমবয়সী আমি যখন নিজের অক্ষমতা নিয়ে বুক সেলফে থরে থরে সাজানো স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের বইগুলোর সামনে বোবা চোখে তাকিয়ে, আমার মেয়ে পাশে এসে দাড়ালো। বললো, বাবা তুমি ভাবছো কেন হেরে গেছো। আমরা তো আছি…….. আমার মেয়ে এবছরই ২৫ বছরে পা দিলো…….আমি একসময় স্বপ্ন দেখতাম ২৫ বছরের একদল চৌকস ছেলেমেয়ে দেশ উন্নয়নে ১৫ বছরের জন্য কাজ করছে………..সেই যুগ কি তবে শুরু হলো………………

আমার ঘুম ভেঙ্গে গেলো……….আমার মেয়ে আর বউ স্কুলে যাচ্ছে। আমি উঠলাম………..

আমি কোন দুঃস্বপ্নই লিখতে পারি নাই। আজকেও পারলাম না।

 

প্রথম প্রকাশ: মোহাম্মদ গোলাম নবীর ব্লগ, http://mgnabi.wordpress.com ৩০ নভেম্বর ২০১১