নারী পুরুষ সমান অধিকার – ফেন্সিডিল থেকে ইয়াবা পর্যন্ত এমনকি গাজার নেশায়ও পিছিয়ে নেই নারীরা

নিজস্ব সংবাদদাতা ॥ এ যেন নারী পুরুষ সমান অধিকার, তাই ফেন্সিডিল থেকে ইয়াবা পর্যন্ত এমনকি গাজার নেশায়ও পিছিয়ে নেই নারীরা। কাশিপুর এলাকার বাসিনা নাছরিন (এটি তার আসল নয়) সাথে কথা বলে জানা গেছে ২০০৫ সাল থেকে তিনি কিভাবে নেশার জগৎ এ ঢুকেছেন। ২৭ বছর বয়সী এ যুবতী জানালেন ঢাকায় বসবাসকালে তার সাথে পরিচয় হয় ধানমন্ডির জলি নামের এক যুবতীর সাথে। পরে ঘনিষ্টতা বাড়ে জলি সহ তার অপর বান্ধবীদের সাথে। জলির বান্দবীদের আড্ডায় গিয়েই দেখতে পান সবাই মিলে সিগারেট পান করছে। ধানমন্ডি লেকের পারে বসে সিগারেটে এক টান-দুই টান দিতে দিতেই সুর্বনা সিগারেটে আসক্ত হয়ে পরেন। এরপর নিজের বাসায় বসেই সিগারেট পানে অভ্যস্থ হয়ে পরেন নাছরিন। কোন প্রকার মান অভিমান বা মনে কষ্ট পেলেই একের পর এক সিগারেট ধরিয়ে সে দু:খ ঘুচাতে লাগলো। এরপর বান্ধবীদের আড্ডায় একদিন গিয়ে দেখলো সিগারেটের টানে ভিন্ন গন্ধ। তখন গাজা সম্পর্কে কোন ধারনা ছিল না নাছরিনের। সিগারেটের নতুন গন্ধের রহস্য জানার জন্য প্রশ্ন করতেই নাছরিন যেন সকলের হাসির পাত্র হয়ে হয়ে উঠেন। তার পর দুষ্টমী করেই তাকে বলা হলো ‘মামা নতুন সিগারেট, বিদেশী একটা টান দেও’। না বুঝিই কৌতুলে সেই নতুন সিগারেটে টান দিয়ে দেখলো ভিন্ন জগৎ। প্রথমে মাথা ঘোরায় তারপর যেন নিজেকে রাজরানীর মত আবিস্কার করতে লাগলো। ধীরে ধীরে গাজাসেবী মনে গেল নাছরিন। বাবা মা টের পাওয়ার পর তাকে নিয়ে আসা হয় বরিশালে। কিন্তু কিছুতেই তাকে নেশা থেকে দূরে রাখা যাচ্ছে না। বাবা মা কে ফাকি দিয়ে বয়-ফ্রেন্ডের সাথে আরালে আবডালে সে সিগারেট এর সাথে গাজা সেবন করছে। নাছরিন জানায় সে গাজা ছাড়তে চায় কিন্ত গাজায় তাকে ছাড়ে না। তবে আগের মত নিয়মিত গাজা সেবনের সুযোগ তার নেই। শুধু সিগারেট চালিয়ে যাচ্ছে পুরোদমে। গাজা বয়ফ্রেন্ড ছাড়া তার কপালে জুটে বলে কম দু:খ নয় বলেই খোলা মেলা জানালেন।

আরেক গাজা সেবী নজরুল (ছদ্মনাম)। বাসা নথুল্লাবাদ এলাকায়। ৩০ বছর বয়সী এ যুবক নেশার জগতে প্রবেশ করেন ২০০১ সালে। গাজা থেকে তার নেশার মেন্যুতে যোগ নতুন করে যুক্ত হয়েছে হিরোইন। ২০০৫ সালে নৌ পরিবহন মন্ত্রনালয়ে অধীনের একটি সংস্থায় সরকারী নিন্মপদে কাজ পেলে নৌ বন্দরে কাজ শুরু করেন। সে জানায় ঢাকা থেকে আসা এক বন্ধুর কাছ থেকে প্রথমবারের মতো সে প্যাথেড্রিনের এর স্বাদ গ্রহন করেন। এরপর থেকে আর ছাড়তে পারেননি। এক সময় পুরোপুরি আসক্ত হয়ে পড়েন। ঢাকায় সদরঘাটেও এ ধরনের বন্ধু তৈরি হয় তার। নতুন বন্ধুদের পেথিডিনে আসক্ত করতে তারা পিপড়ার কামড়, পিপড়া কামড় বলে চেচাচেমি করে শ্লোগান দেয়। কৌতুহলী বন্ধু মিজান (ছদ্মনাম) জানান সে গাজা ফেন্সিডিল ইয়াবা সেবন করেছে এই পুরনো বন্ধুদের আড্ডায় বসেই। সে তাদের কাছে জানতে চায় পিপড়ার কামড় কি? উত্তরে বন্ধুরা তার সামনেই প্যাথেডিন ইনজেশন পুশ করে তারে পিপড়ার কামড়েরর বাস্তবতা দেখায়। বন্ধুদের আড্ডায় সেও নতুন এ স্বাধ একদিনের জন্য গ্রহন করতে গিয়ে এখন প্রতিদিন বাবা-মায়ের টাকা চুরি করে তাকে ৪/৫ টি প্যাথেডিন নিতে হয়।

মনোরোগ বিশেজ্ঞ চিকিৎসকরা জানান এ প্যাথেডিন গ্রহনকারীদের চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় ইঞ্জেকটেবল ড্রাগ ইউজার বলা হয়ে থাকে। প্যাথেডিন আসক্তরা একই ইঞ্জেকশনের দিয়ে ২/৩ জনে প্যাথেড্রিন নিয়ে থাকে। স্বল্প আয়ের আসক্তরা ডাস্টবিন থেকেও সিরিঞ্জ কুড়িয়ে এনে ইঞ্জেকশন নিয়ে থাকে।

বরিশাল ও ঢাকা সদরঘাটের আইনশৃঙ্খখলা বাহিনীর কাছ থেকে মাদক গ্রহণে সহযাগিতা পায় নজরুল সহ তার বন্ধুরা। মাদক বিক্রেতাদের কাছ থেকে উদ্ধার করা এ্যম্পুল পুলিশ তাদের কাছে বিক্রি করে। নজরুল ও তার বন্ধু কামরুল জানায় পুলিশের উপস্থিতিতেই সুঁই ডুকাইছি শরীরে বহুবার। ‘ওরা দেইখ্যাও মোগো কিছু কয় না। ঘাটের পুলিশ কিছু ধরলে মোগো খুইজ্যা বাইর কইর‌্যা সেল (বিক্রি) করে, অরা আবার মোগো কি কইবে?’

এখানকার একমাত্র মাদক নিরাময় কেন্দ্র হলি কেয়ারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান সুমন জানান ইঞ্জেকটেবল ড্রাগ ইউজাররা সুস্থ হয়ে স্বাভাবিক জীবনে খুব একটা ফিরতে পারছে না। কারন এসব মাদকাসক্তের নিডল (সুঁই) শেয়ারের কারণে নানান রোগে তারা আক্রান্ত হচ্ছে। এমনকি তাদের মাঝে এইডস ঝুঁকিও রয়েছে। বুধবার নগরীর জেলগেট এলকায় একটি বেসরকারি সংস্থার ড্রপিং সেন্টারে কথা হয় ৫জন ইঞ্জেকটেবল ড্রাগ ইউজারের সঙ্গে। তারা সকলেই মাদকের বিষাক্ত ছোবল থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছে। ১৯ বছর বয়সী সোহেল রানা জানালেন গত ৩ বছর ধরে প্যাথেড্রিন নিচ্ছেন। প্রথমে এলকার এক বড় ভাই’র কাছ থেকেই প্যাথেড্রিনের নেশায় আসক্ত  হয়েছিল সে। প্রথম দিনের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে বেলাল ভাই বলল ‘সুঁই দেখলে আমার প্রথম ভয় লাগতো। বেলাল ভাই মোটা সুঁইটা খুব সহজেই তার নিজের হাতে ঢুকাচ্ছে দেখে সাহস বেড়ে গেল। আমারেও একই সুই ঢুকিয়ে বিল্লাল ভাই ইনজেকশন পুশ করে দিলো। আমি মুই  ঘুইর‌্যা পইড়্যা গেলাম’। ঐ দিনই রানার বাসার লোকজন টের পেয়ে যায়। বাবা টাকা না দেয়ার কারনে সে বাধ্য হয়েই নেশা ছাড়তে চাইছে কিন্ত এখনো পারেনি। থাকে না বলে মেরেও লাভ হয় না। এক সময় নেশার টাকা জোগাড় করতে নিজ মা’কেও মারধর করতো রুহুল (২৬)। রুহুল বললেন ‘ভাই নেশা না করতে পারলে মইর‌্যা যামু, নিজে না বাচলে বাপ মারে দিয়া কি করমু’।

ফেন্সিডিলের বাজার দখল করেছে ইয়াবা:
এক সময় নগরী ২/৩’শ টাকায় ফেন্সিডিল পাওয়া যেত। র‌্যাব ও ডিবি পুলিশের অভিযানে মুখে বড় বড় চালান ধরা পরায় বাড়তে থাকে ফেন্সিডিলের দাম। ৫/৭ করে হাজার টাকায় দাম উঠে ফেন্সিডিলের। এরপর হাজির হয় নতুন মরন নেশা ইয়াবা। শুরুতে নগরীতে বিসালী এ মাদক বিক্রি হতো প্রতিপিচ ৫’শ টাকায়। এখন বিক্রি হচ্ছে ২’শ থেকে আড়াইশ টাকায়। নতুন এ নেশায় যুব সমাজ ঝুকে পরায় এখন আর ফেন্সিডিলের তেমন কোন কদর নেই। কাচের বোতল এর পরিবর্তে প্লাষ্টিকের বোতলে দেশী তৈরী যে ফেন্সিডিল বিক্রি হচ্ছে তার মাত্র ৭/৮শ টাকা।

নগরীর মাদক স্পট:
নগরীর কাটপট্টি, আমির কুটির, কাউনিয়া ব্রাঞ্চ রোডের ১ম পুকুর, ২য় পুকুর, সাহাপাড়া সংযোগ সড়ক, সেকশন রোড, মনষা বাড়ি, ভাটিখানা, বালুর মাঠ বস্তি, স্টীমার ঘাট, চরমোনাই ট্রলারঘাট, বেলতলা খেয়াঘাট ও নিউ ভাটিখানা পুজা মন্দির সংলগ্ন এলাকায় অবাধে বিক্রি হয় মাদক। কাউনিয়া বিসিক এলাকা সহ পশ্চিম কাউনিয়া ও কাশিপুরে সন্ধ্যার পরই মাদকের হাট বসে। মোটর সাইকেল নিয়ে মাদক আসক্তরা হাজির হন এ সব স্পষ্ঠ। আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রন অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা এ সব ষ্পট থেকে বখড়া পেয়ে থাকে। মাঝে মধ্যে মাসোয়ারা না পেলে চলে অভিযান। মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রন অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক শাহনেওয়াজের বিরুদ্ধেও রয়েছে মাদ স্পট থেকে বখরা আদায়ের অভিযোগ। মাদক বিক্রেতারা জানান- শাহনেওয়াজকে মাসোয়ারা দিতে বিলম্ব হলেই অভিযোগ চালানো হয়। তাকে প্রতিমাসে খুশী করতে পারলে তেমন কোন সমস্যা হয় না। হাসপাতালের সামনের ফার্মেসিগুলোতে বিক্রি হয় প্যাথেড্রিন।  প্যাথেড্রিনের এ্যম্পুল প্রেসক্রিপশন ছাড়া বিক্রি বেআইনি হলেও চড়া দামে তা ইঞ্জেকটেবল আসক্তদের কাছে বিক্রি হয়।

কেয়ার বাংলাদেশ এর ইঞ্জেকটেবল ড্রাগ ইউজার প্রকল্পের দলনেতা ডা. রুপালী শিশির বানু জানান এইডস বিস্তারের অন্যতম কারণ, সুইয়ের মাধ্যমে মাদক গ্রহণের প্রবণতার আধিক্য। রুপালি জানান, সুই ব্যবহারকারী এইডস রোগী থেকে ৭টি মাধ্যমে সাধারণ মানুষের মধ্যে এইচআইভি পজিটিভের বিস্তার হয়। এরমধ্যে নারী যৌনকর্মী, হিজড়া, সমকামী বান্ধবী, পুরুষ যৌনকর্মী, পেশাদার রক্তদাতা সঙ্গী ও স্ত্রী। রক্ত বিক্রি, অনিরাপদ বাণিজ্যিক যৌনতা এবং হেপাটাইটিস বি ও সি বিস্তারে সহায়ক হওয়ায় ঝুকি বাড়ছে। রুপালি শিশির এর মতে ইনজেকশন ব্যবহারকারী মাদক সেবনকারীদের একেবারেই মাদক থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব হয় না। তাদের কাউন্সিলিং এর মাধ্যমে পর্যায়ক্রমে মুক্ত করার উপায় আছে।

মাদক নিরাময় কেন্দ্র হলি কেয়ার এর মনোরোগ বিশেজ্ঞ তপন কুমার সাহা জানান- তার নিরাময় কেন্দ্রে বর্তমানে ১৫ জন রোগী রয়েছে এরমধ্যে ৫ জন ইঞ্জেকটেবল ড্রাগ ইউজার, হিরোইন সেবী ৬ জন ও চারজন ইয়াবা সেবী। ফেন্সিডিলে আসক্ত কোন রোগী তার সেন্টারে এখন নেই। আসক্ত রোগীদের মধ্যে ইঞ্জেকটেবল ড্রাগ ইউজারদের সুস্থ হতে সময় বেশী লাগে বলে তিনি জানান। ইঞ্জেকটেবল ড্রাগ ইউজারদের মধ্যে অনেকেই এইচআইভি ভাইরাসে আক্রান্ত। এরমধ্যে কাটপট্টি রোগের এক ব্যক্তি দীর্ঘদিন কারাগারে আটক থাকার পর মুক্তি পেয়ে কয়েক মাস আগে মাদক নিরাময় কেন্দ্রে ভর্তি হয়। তার শরীরে এইচ আইভি ভাইরাস চিহিৃত করার পর তাকে শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। গতকাল যুবকের মৃত্যু হয় বলে হলি কেয়ার মাদক নিরাময় কেন্দ্রের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান সুমন জানান।