আজ ভয়াল সেই ১৫ নভেম্বর – সেই রাতের তান্ডবলীলা মনে করে আজও শিউরে ওঠেন উপকূলবাসী

নিজস্ব সংবাদদাতা ॥ আজ ভয়াল সেই ১৫ নভেম্বর। প্রলংকারী ঘূর্ণিঝড় সিডর এর ৫ম বার্ষিকী। ২০০৭ সালের এই দিনে সিডর নামক প্রলংকারী ঘূর্ণিঝড় ভয়াবহ আঘাত হেনেছিল উপকূলবর্তী ৩০টি জেলায়। লন্ডভন্ড করে দিয়েছিল সমগ্র উপকূলকে। শতাব্দীর ভয়াবহ ঐ ঘূর্ণিঝড়ে প্রাণ হারিয়েছিল সাড়ে ৩ হাজার আদম সন্তান। নিখোঁজ হয় আরো সহস্রাধিক। সরকারী হিসেবে ২০ লাখ ঘরবাড়ি ভেসে যায় পানির স্রোতে। প্রায় ৪০ লাখ একর জমির ফসল বিনষ্ট হয়। মৃত্যু হয়েছে ৪ লাখ ৬৮ হাজার গবাদি পশুর। এরমধ্যে খুলনা বিভাগের বাগেরহাট, খুলনা ও সাতক্ষীরায় মারা গেছে ৭০ হাজার গবাদি পশু। বাকি গবাদি পশুর মৃত্যু হয়েছে বরিশাল অঞ্চলের বিভিন্ন জেলায়। সিডরে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্থ হয় বাগেরহাট, পটুয়াখালী, পিরোজপুর ও বরগুনা জেলার।

সিডরের ভয়াবহতা এতই নির্মম হবে তা বুঝতে পারেনি উপকূলভাগের বাসিন্দারা। সিডরের মাত্র কয়েক মাস পূর্বে সুনামী’র পূর্বাভাস ও তা আঘাত না হানায় সিডর নিয়ে আতংক ছিল না এ অঞ্চলের মানুষের মাঝে। ১৫নভেম্বর ছিল বৃহস্পতিবার। প্রশাসনের পক্ষ থেকে বার বার তাগাদা দেয়া সত্বেও বঙ্গোপসাগরের কুল ঘেঁষে বসবাস করা বরগুনার পাথরঘাটা, আমতলী-তালতলী, পটুয়াখালীর বাউফল, কলাপাড়া, গলাচিপা, দশমিনা, কাকচিড়া, মাঝেরচর, পটুয়াখালীর মির্জাগঞ্জ উপজেলার সুবিদখালী ও ভোলার ঢাল চর, কুকরি মুকরী ও চর পাতিলার লোকজন আশ্রয় কেন্দ্রে যেতে আগ্রহ দেখায় নি। এমনকি কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতেও বেশকিছু অতি উৎসাহী পর্যটক সেদিন থেকে গিয়েছিলেন। চরমরানিন্দ্রা, হাসা’র চর ও আশা’র চরে মাছ ধরতে যাওয়া অস্থায়ী ভাবে বসবাসকারী শত শত জেলেরা সেখানেই থেকে গিয়েছিলেন। অনেকেরই ধারণা ছিল শেষ পর্যন্ত তেমন কিছু হবে না।

বরিশাল মহানগরীও যেন মৃত নগরীতে পরিণত হয়। রাস্তায় মানুষ তো দুরের কথা কোন প্রাণীও ছিল না। বাতাসের তীব্র কানকাটা শব্দে সকল স্তব্দতা ভন্ডুল করে দেয়। পুরো দক্ষিণ জুড়ে যখন মাতম শুরু করে ঘূর্ণিঝড় সিডর, ততক্ষণে বিদ্যুৎ ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়ে প্রেত পূরীতে পরিণত হয় পুরো দক্ষিণাঞ্চল। রাত ৮ টা থেকে সাড়ে ৮ টা পর্যন্ত কিছু কিছু যোগাযোগ সম্ভব হলেও রাত ৯ টার পর আর কোন যোগাযোগের মাধ্যম ছিল না। দুর্গম চরগুলোর গবাদি পশুগুলো প্রাণে রক্ষা পেতে ছুটো ছুটি করে শেষ পর্যন্ত মৃত্যুর কাছে যেন সমার্পণ করে দেয়। শুধু গবাদি পশু নয় বন্য প্রাণীও মারা গেছে বহু। রাত বাড়ার সাথে সাথে তান্ডব বাড়তে থাকে। আতংকিত প্রিয়জনকে সাথে নিয়ে নতুন ভোরের অপেক্ষায় থাকেন সবাই। কিন্তু সকলেরই সে সোনালী সকাল দেখার সৌভাগ্য আর কপালে জোটেনি। নিজের জীবন ও প্রিয় স্বজনকে নিয়ে যারা প্রাণে বেঁচে গেছেন তাদেরও খোয়া গেছে সহায় সম্বল। সিডরের পরদিন যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন দক্ষিণাঞ্চলে দেখা দেয় হাহাকার। লাশ খোঁজার পাশাপাশি খাবারের আশায় ত্রাণের সন্ধানে ছোটেন ক্ষুধার্ত মানুষ। কিন্তু গত ৫ বছরেও তাদের ক্ষুধার জ্বালা মেটাতে সরকারী তরফ থেকে তেমন কোন উদ্যোগ নেয়া হয়নি। এরই মাঝে আবার ঘুরে এসেছে ভয়াল সেই স্মৃতির দিন।

পটুয়াখালীর মির্জাগঞ্জ উপজেলার দেউলি সুবিদখালীর সিকান্দার আলী ভয়াবহ ঐ রাতের বর্ননা দিতে গিয়ে বলেন বাতাসের একটা মোচড়েই সবকিছু শেষ করে দিয়ে গেছে। বাকেরগঞ্জের ফলাঘর গ্রামের প্রতিবন্ধি আবুল হাওলাদারের পুত্র বধু মুক্তা বলেন রাতে স্বামীকে নিয়ে ঘুমিয়ে ছিলাম। গভির রাতে ঝরের তান্ডবে আমার পাশেই লাশহয়ে পড়ে থাকতে দেখেছি স্বামী রুবেল হাওলাদারকে। আর কিছুই বলতে পারবোনা। কারন তখন আমার সব ষেশ হয়ে গেছে। সকালে মানুষের ঢল নামে আমাদের পোড়াকপাল দেখতে। আমার স্বশুর প্রতিবন্ধী আবুল হাওলাদার আজ ভিক্ষাকরে সংশার চালান। আমাদের সংসারে একমাত্র আয়ের উৎস ছিল রুবেল। বাউফলের চর ফেডারেশনের খোরশেদ গাজী বলেন সেদিন রাতে আমার জীবনের সবচেয়ে বড় সম্পদ ৫ সন্তানকে হারিয়েছি। আজ আমার সংসারের হালধরার কেউ নেই। সেদিন এই চরের ৩৮ জন জীবন হারিয়ে ছিল।

রাজাপুরের নারিকেলবাড়িয়ার আনোয়ার হোসেন জানান, বাতাসের তান্ডব এত ভয়াবহ হবে সন্ধ্যায় বুঝিনি। বাড়িতেই ঘুমিয়েছিলেন গালুয়ার নাসিমা বেগম। রাতের তান্ডবে পরিবারের কে কোথায় ছিল তা জানেন না। পরদিন সকালে ১০ বছরের শিশু সন্তান মাহমুদকে মৃত অবস্থায় কুড়িয়ে এনেছিলেন একটি গাছের নীচ থেকে। বড় গালুয়া গ্রামের একই পরিবারের ৪ জনের মৃত্যু হয়। ঐ উপজেলার রেবেকা ও ইউসুফ দম্পতি তাদের দু’সন্তানকে হারিয়ে দুঃসহ স্মৃতি নিয়ে পার করেছেন ৫টি বছর। ভয়াবহ এসব স্মৃতি মনে উঠলে এখনো মুর্ছা যান দক্ষিণ জনপথের মানুষ। তবুও তাদেরকে বেঁচে থাকতে হচ্ছে অজানা আশংকার মাঝেই। পর্যাপ্ত সাইক্লোন শেল্টার এখনো নির্মাণ কাজ শেষ হয়নি। প্রকৃতির রুদ্ররোষকে মোকাবেলা করেই তারা বেঁচে থাকার দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে সকল বঞ্চনাকে মেনে নিয়েছেন। পার করে দিয়েছেন সিডর পরবর্তী ৫ টি বছর। মির্জাগঞ্জ উপজেলায় সিডরে প্রাণ হারিয়েছিল ১১৬ জন। দু’হাজার গবাদী পশুর সাথে ভেসে গিয়েছিল ২০ হাজার হাস-মুরগী। উপজেলার ৫ হাজার ২০টি পরিবার সম্পূর্ণ রূপে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। ঝালকাঠীতে সিডরে প্রাণ হারিয়েছে ৪৭ জন। ফলে বিভিষিকাময় ছাই পোড়া তকের দাগ এখনো মন থেকে ঘোচাতে পারেনি এ অঞ্চলের মানুষ। ভয়াল সেই রাতের কথা মনে উঠলেই আতকে উঠে এ অঞ্চলের লাখ লাখ মানুষ।

//এম.মিরাজ হোসাইন, বরিশাল ও মনিরুজ্জামান মনির, ঝালকাঠি//

আজ ভয়াল সেই ১৫ নভেম্বর - সেই রাতের তান্ডবলীলা মনে করে আজও শিউরে ওঠেন উপকূলবাসী