মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে বিভ্রান্ত প্রজন্মের কাছ থেকে এমন প্রশ্ন আসলেই অপ্রত্যাশিত নয়

অমি রহমান পিয়াল :

১. মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক কে ছিলো?
২. মুক্তিযুদ্ধ কি ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ ছিলো?
৩. কেনো ওসমানীর পরিবর্তে ইন্ডিয়ান জেনারেল সাইন করেছে?

১. মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক ছিলেন বঙ্গবন্ধূ শেখ মুজিবুর রহমান। ১০ এপ্রিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা দিয়ে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার গঠিত হলে ওসমানী এক্টিভ লিস্টে আহূত হন। ১২ এপ্রিল বাংলাদেশ সরকারের যুদ্ধকালীন মন্ত্রিসভার নাম ঘোষণা করা হয়। এতে রাষ্ট্রপ্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানকে মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক বলে ঘোষনা করা হয়। এবং বাংলাদেশ সরকার এক ঘোষনায় ওসমানীকে ১২ এপ্রিল থেকে মন্ত্রীর মর্যাদাসহ বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি নিযুক্ত করে। ১৯৭১ সালের ১১ জুলাই মুজিবনগরে উচ্চপদস্থ সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তাদের এক বৈঠকে সশস্ত্র বাহিনীর সদর দপ্তর গঠন করা হয়। সেখানে আনুষ্ঠানিকভাবে ওসমানিকে মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি হিসেবে নিযুক্তি দেওয়া হয়। তার পেশাগত ক্রমিক নম্বর ৮২১। তার নিয়োগপত্রের লিংক দেওয়া হলো: https://www.facebook.com/photo.php?fbid=10151119212798363&set=a.10151110058523363.459189.515328362&type=3&src=https%3A%2F%2Ffbcdn-sphotos-h-a.akamaihd.net%2Fhphotos-ak-snc6%2F280105_10151119212798363_1329030495_o.jpg&smallsrc=https%3A%2F%2Ffbcdn-sphotos-h-a.akamaihd.net%2Fhphotos-ak-ash4%2F424318_10151119212798363_1329030495_n.jpg&size=1800%2C1416
আর ঘোষণাপত্রের লিংক: https://www.facebook.com/photo.php?fbid=10151169408533363
মজার ব্যাপার হচ্ছে এই ইস্যুটা নিয়ে সবচেয়ে বেশী প্যাচায় ছাগুরা। তারা কিন্তু এটা ভুলে যায় মুক্তিযুদ্ধের আগে ওসমানী একজন অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা হলেও আওয়ামী লীগের নির্বাচিত একজন এমপি ছিলেন। মজাই লাগে ব্যাপারটা। নিয়োগপত্রে দেখা যাচ্ছে ওসমানীকে মুক্তিবাহিনীর প্রধান হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার পাশাপাশি একজন ক্যাবিনেট মিনিস্টারের সমান মর্যাদা দেওয়া হয়েছে।
তবে ওসমানীর আনুষ্ঠানিক অধিভুক্তিতে একটু সময় লেগে যায়। ১৯৬৭ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি সেনাবাহিনী থেকে অবসর নেন ওসমানী। মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য তাকে নতুন করে প্রতিরক্ষা বাহিনীতে যোগ দিতে হয়। ১৫ জুলাই ‘৭১ (কাগজে ভুলে ৭০ লেখা) বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর আনুষ্ঠানিক কাগজপত্রে ওসমানীকে নতুন করে সেনাবাহিনীতে অধিভুক্ত করা হয়, এবং এতে সাক্ষর দেন উপ-সেনাপ্রধান গ্রুপ ক্যাপ্টেন আবদুল করিম খন্দকার । প্রসঙ্গত একে খন্দকার তখন অ্যাক্টিভ সার্ভিস হোল্ডারদের মধ্যে সবচেয়ে সিনিয়র ছিলেন, আনুষ্ঠানিক আত্মসমর্পন অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর প্রতিনিধিত্ব করেন তিনিই।
লিংক:https://www.facebook.com/photo.php?fbid=10151119220938363
আর অধিভুক্ত হওয়ার কাগজপত্রে ওসমানীর পক্ষে সাক্ষী হিসেবে সই করেছিলেন ২ নম্বর সেক্টর অধিনায়ক খালেদ মোশাররফ ১৫ জুলাই, ১৯৭১
লিংক: https://www.facebook.com/photo.php?fbid=10151119233328363

এই দেরি হওয়ার ছিলো বাংলাদেশ সরকারের দাপ্তরিক কাগজপত্র সিল ইত্যাদি তখনও চূড়ান্ত হয়নি। যে কারণে ওসমানীকে মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি হিসেবে নিয়োগে সাধারণ কাগজপত্রই ব্যবহার করা হয় প্রথমে। তার নিয়োগ অনুমোদন দিয়ে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি হিসেবে সাক্ষর করেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম।

লিংক: https://www.facebook.com/photo.php?fbid=10151119214368363

এখন কেনো কমান্ডার ইন চিফ মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক নন এই ব্যাপারে খোদ তাজউদ্দিন আহমেদ (যিনি আসলে মুক্তিযুদ্ধের সত্যিকার সেনাপতি)সুন্দর যুক্তি দিয়ে ব্যাখ্যা দিয়েছেন: সিএনসির বাংলা তরজমা কিন্তু সর্বাধিনায়ক নয়, প্রধান সেনাপতি। আমাদের সরকার সামরিক নয়। সামরিক সরকারের প্রেসিডেন্ট এবং প্রধান সেনাপতি একই ব্যক্তি থাকেন। এজন্য প্রধান সামরিক শাসক ও প্রেসিডেন্ট তিনবাহিনীর পুরো দায়িত্বে থাকেন। এজন্যই তখন সেনাবাহিনী প্রধানকে সর্বাধিনায়ক বলা হয়। গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় তিনবাহিনীর তিনজন প্রধান থাকেন। রাষ্ট্রপ্রতি তিন বাহিনীর সমন্বয়ক হিসেবে তিনিই হন সর্বাধিনায়ক।‘
তো যেহেতু রাষ্ট্রপতি ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তিনিই মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক।

২. আমাদের স্বাধীনতার লড়াইয়ের একটা পর্যায়ে এসে পাকিস্তান ও ভারত যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। কিন্তু আমাদের মুক্তিযুদ্ধ মোটেও ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ নয়। এমনকি গৃহযুদ্ধও নয়। কারণ ১২ এপ্রিল গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার গঠিত হওয়ার পরপর পূর্ব পাকিস্তানের অস্তিত্ব আনুষ্ঠানিকভাবেই বিলুপ্ত হয়।এবং আমাদের স্বাধীনতার ঘোষণা ২৬ মার্চ থেকে কার্যকর বলে অনুমোদিত হয় সেই ঘোষণায় যা এক অর্থে আমাদের প্রথম সংবিধানও।প্রসঙ্গত বলতে হয় গত শতকে শুধু বাংলাদেশই আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়। গোটা বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের পর দ্বিতীয় এবং একমাত্র দেশ বাংলাদেশ । মূল ঘোষণাটার লিংক: https://www.facebook.com/photo.php?fbid=10151169406343363

আমাদের মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকার নামে মুজিবনগরকে রাজধানী হিসেবে উল্লেখ করে কাগজপত্রে ব্যবহার করলেও বাস্তবে তাদের অবস্থান ছিলো কলকাতায়। এবং আমাদের মুক্তিযোদ্ধারাও ভারতেই ট্রেনিং নিয়ে তাদের অস্ত্রের সহায়তা নিয়েই জন্মভুমিতে ফেরে দেশকে মুক্ত করতে। তো পাকিস্তান সরকার এবং তাদের এদেশী অনুচররা (জামাতে ইসলামী-মুসলিম লিগ-নেজামে ইসলামী-পিডিপি) মুক্তিযোদ্ধাদের ভারতের দালাল (সংক্ষেপে ভাদা) বলে অফিসিয়ালি উল্লেখ করতো। এবং ইয়াহিয়া সরকার প্রায়ই ভারতকে হুমকি দিতো মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য দেওয়া বন্ধ না করলে আক্রমণের। গোলাম আযম তো ঘোষণাই দিয়েছিলো দিল্লীতে গিয়ে ঈদের নামাজ পড়ার যদিও সে ঈদের পরদিনই পাকিস্তান পালায়।

যাহোক ২১ নভেম্বর ‘৭১ বাংলাদেশ ও ভারত সরকারের যৌথ সিদ্ধান্তে ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর সমন্বয়ে মিত্রবাহিনীর যৌথ কমান্ড গঠিত হয়। আর এই কমান্ডের অধিনায়ক ছিলেন লে. জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা। যেহেতু বাংলাদেশ ভারতের পূর্ব দিকে তাই পূর্বাঞ্চল অধিনায়ক হিসেবে অরোরা এই দায়িত্ব পান। যদিও ভারতের সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান ছিলেন স্যাম মানেকশ। এমন সিদ্ধান্তে আসার কারণ যুদ্ধ তখন চূড়ান্ত পর্যায়ের দিকে যাচ্ছিলো। এবং সেই লড়াই ভারী অস্ত্রের লড়াই। ট্যাংক-মিগ আর ফ্রিগেটের লড়াই যার কিছুই ছিলো না বাংলাদেশের। থ্রি নট থ্রি, স্টেন, গ্রেনেড এমনকি ভারী মেশিনগানও মুক্তিযোদ্ধাদের দিয়েছে ভারত কিন্তু কয়েকশ মিগ, কয়েকশ ট্যাংক আর নৌবহর তো দিতে পারে না। ওগুলা তাদেরই চালাতে হবে। তাই মিত্রবাহিনী গঠন।

৩ ডিসেম্বর বিকেলে ভারতের বিভিন্ন বিমান ঘাটিতে আক্রমণ চালিয়ে পাকিস্তান ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। এই যুদ্ধ চলে দুটো ফ্রন্টে। পূর্ব ফ্রন্টে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মুখোমুখি হয় মিত্রবাহিনী। আর পশ্চিম ফ্রন্টে শুধু ভারতীয় বাহিনী। পূর্ব ফ্রন্টে ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানী বাহিনী আত্মসমর্পন করে। জন্ম নেয় স্বাধীন বাংলাদেশ। তাই এই অংশের লড়াই লিবারেশন ওয়ার অব বাংলাদেশ বা বাংলাদেশের স্বাধীনতার যুদ্ধ বলে উল্লেখিত যার ব্যাপ্তি ২৬ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর। পশ্চিম ফ্রন্টে যুদ্ধ শেষ হয় ১৯ ডিসেম্বর। দ্বিতীয় ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ (প্রথমটি ১৯৬৫ সালে) তাই ৩ ডিসেম্বর থেকে ১৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত হিসেব করা হয়।

প্রসঙ্গত বিডিনিউজের হয়ে ঠিক এই প্রশ্নটাই বেশ ক্ষোভ নিয়েই আমি করেছিলাম ভারতীয় জেনারেল জেএফআর জ্যাকবকে। বলেছিলাম- কোনো কোনো মহল আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ বলে অভিহিত করে এবং এটা আমাদের অহমে আঘাত দেয়। এ বিষয়ে আপনার দৃষ্টি ভঙ্গীটা কি? তার উত্তর ছিলো: I’ve always said it was your liberation war. It was your war of independence, not otherwise. (আমি সবসময়ই বলে এসেছি এটা তোমাদের স্বাধীনতার যুদ্ধ, তোমাদের মুক্তিযুদ্ধ, অন্য কিছু নয়।
লিংক: http://www.bdnews24.com/details.php?id=98561&cid=3

৩. এই প্রশ্নটা ঘুরিয়ে করা হয়েছে। এমনিতে ছাগুদের প্রশ্ন হয় ওসমানী কেনো আত্মসমর্পন অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন না। মূল কারণটা হচ্ছে আর্মি প্রটোকল। তাজউদ্দিন আহমেদ যদি ওসমানীকে প্রধান সেনাপতি হিসেবে নিযোগ না দিতেন তাহলে সিনিয়ারিটি অনুযায়ী বাই ডিফল্ট এটি হতেন গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ কে খন্দকার, কারণ তিনিই ছিলেন মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে সবচেয়ে সিনিয়র অফিসার এবং একই সঙ্গে উপ-সেনাপ্রধান। অন্যদিকে ওসমানী তখনও কর্ণেল এবং তাকে জেনারেল হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয় ১৬ ডিসেম্বরের পর। যাহোক তারপরও তিনি আমাদের প্রধান সেনাপতি এবং ভারতীয় বাহিনীর প্রধান স্যাম মানেকশর সমানই তার মর্যাদা ছিলো তখন। অন্যদিকে অরোরা একজন আঞ্চলিক প্রধান।পূর্ব ফ্রন্টের অধিনায়ক। যেমন লে. জেনারেল নিয়াজীও পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পূর্ব ফ্রন্টের অধিনায়ক। পূর্ব ফ্রন্টের জন্য গঠিত মিত্রবাহিনী তাই অরোরার কমান্ডেই হবে সেটাই স্বাভাবিক। ওসমানী কেনো সই করবেন? পাকিস্তানের পক্ষে কি তাদের সেনা প্রধান সই করেছিলো? আত্মসমর্পন অনুষ্ঠানে কি স্যাম মানেকশ ছিলেন? তাহলে ওসমানী কেনো যাবেন?

এই প্রশ্নে জ্যাকবের উত্তর ছিলো: There is a lot of propaganda about it. The fact is, he was in Sylhet. He was in a helicopter that was shot at by the Pakistan army. I had ordered everyone on the Bangladesh side to stay in Kolkata. But he rode the chopper, got shot and couldn’t attend the ceremony. It’s not our fault. He should have been there. We wanted him there. Khandker (deputy commander-in-chief AK Khandker) attended in his absence.

জ্যাকবের কথাটা সত্যনিষ্ট নয়। এ প্রসঙ্গে ওসমানীর ভাষ্যটা বরং আমরা শুনি : যুদ্ধকালীন বাংলাদেশ সরকারের অধীনে মুক্তিবাহিনীর সদর দপ্তরে জনসংযোগ কর্মকর্তার দায়িত্বে ছিলেন নজরুল ইসলাম। একাত্তরের রণাঙ্গন অকথিত কিছু কথা নামে এক স্মৃতিচারণে তিনি তুলে ধরেছেন এর বিষদ বিবরণ।

ঘটনা হচ্ছে ১২ ডিসেম্বর ওসমানী কলকাতা থেকে আগরতলা হয়ে মুক্তাঞ্চল সিলেটে যান। এটা নিশ্চিত করেন মুক্তিবাহিনী হেডকোয়ার্টারের অফিসার ইন চার্জ জেনারেল ওসমানীর বিশ্বস্ত বন্ধু মেজর এমআর চৌধুরী। তার ভাষায়- তানী এখন সিলেট গেছুন।

১৮ ডিসেম্বর সদর দপ্তরে ফিরে তাকে নিয়ে এসব গুজব শুনে ভীষণ ক্ষুব্ধ হন ওসমানী। নজরুল ইসলামের মুখে পুরোটা শুনে যে জবাব দিয়েছেন কোট করছি:

দেখুন আমরা স্বাধীনতা অর্জন করতে যাচ্ছি। কিন্তু দুঃখ হলো স্বাধীন জাতি হিসেবে আমাদের মধ্যে আত্মমর্যাদাবোধ সম্পর্কে কোনো চেতনা এখনও জন্ম হয়নি। আমাকে নিয়ে রিউমার ছড়ানোর সুযোগটা কোথায়? কোনো সুযোগ নেই। তার অনেক কারণ রয়েছে। নাম্বার ওয়ান- পাকিস্তানী সেনাবাহিনী কবে আত্মসমর্পণ করবে আমি জানতাম না। আমি কলকাতা ছেড়ে চলে যাওয়ার পর তাদের আত্মসমর্পণের প্রস্তাব এসেছে।

নাম্বার টু- ঢাকায় আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে আমার যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। কারণ এই সশস্ত্র যুদ্ধ ভারত-বাংলাদেশের যৌথ কমান্ডের অধীনে হলেও যুদ্ধের অপারেটিং পার্টের পুরো কমান্ডে ছিলেন ভারতীয় সেনাপ্রধান লেফট্যানেন্ট জেনারেল স্যাম মানেকশ। সত্যি কথা হচ্ছে আমি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত কোনো নিয়মিত সেনাবাহিনীর সেনাপ্রধানও নই। আন্তর্জাতিক রীতিনীতি অনুযায়ী পাকিস্তান সেনাবাহিনী আমার কাছে আত্মসমর্পণ করতে পারে না। কারণ বাংলাদেশ জেনেভা কনভেনশনে স্বাক্ষরকারী কোনো দেশ নয়।

আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে জেনারেল মানেকশকে রিপ্রেজেন্ট করবেন লে.জে অরোরা। জেনারেল মানেকশ গেলে তার সঙ্গে যাওয়ার প্রশ্ন উঠতো। সার্বভৌম সমতার ভিত্তিতে আমার অবস্থান জেনারেল মানেকশর সমান। সেখানে তার অধীনস্থ আঞ্চলিক বাহিনীর প্রধান জেনারেল অরোরার সফরসঙ্গী আমি হতে পারি না। এটা দেমাগের কথা নয়। এটা প্রটোকলের ব্যাপার। আমি দুঃখিত, আমাকে অবমূল্যায়ন করা হয়েছে। আমাদের মধ্যে আত্মমর্যাদাবোধের বড় অভাব।

ঢাকায় ভারতীয় বাহিনী আমার কমান্ডে নয়। জেনারেল মানেকশর পক্ষে জেনারেল অরোরার কমান্ডের অধীন। পাকিস্তানী সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণ করবে যৌথ কমান্ডের ভারতীয় বাহিনীর কাছে। আমি সেখানে (ঢাকায়) যাবো কি জেনারেল অরোরার পাশে দাড়িয়ে তামাশা দেখার জন্য? হাও ক্যান আই!

আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষর করবেন জেনারেল মানেকশর পক্ষে জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা আর পাকিস্তানী বাহিনীর পক্ষে জেনারেল নিয়াজী। এখানে আমার ভূমিকা কি? খামোখা আমাকে নিয়ে টানা হ্যাচড়া করা হচ্ছে।

পাশাপাশি কেনো মুক্তিবাহিনীর কাছে পাকিস্তানীরা আত্মসমর্পণ করেনি এটার ব্যাখ্যাও দিয়েছেন ওসমানী সংক্ষেপে ব্যাপারটা এমন যে যুদ্ধবন্দীদের ব্যাপারে আন্তর্জাতিক নীতিমালা আছে যার অন্যনাম জেনেভা কনভেনশন। বাংলাদেশ এই কনভেনশনে স্বাক্ষরকারী দেশ নয় বলেই সেই নীতিমালা মানতে মুক্তিবাহিনী বাধ্য ছিলো না। তাই তাদের হত্যা করলে বা তাদের উপর অত্যাচার করলে বলার থাকতো না কিছু। পাকিস্তানীরা জেনেশুনে সে ঝুকি নেয়নি। তাছাড়া ৯০ হাজার যুদ্ধবন্দীকে খাওয়ানো পড়ানো তদারক করার ক্ষমতাও যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের ছিলো না। তখনও নিজের খাওয়াটাই যে জোটে না!
(তথ্যসূত্র : একাত্তরের রণাঙ্গন অকথিত কিছু কথা লেখক: নজরুল ইসলাম, অনুপম প্রকাশনী ১৯৯৯)

তো ওসমানী সিলেটে কি করেছেন? হেলিকপ্টারে গুলি ছোড়ার কাহিনী একটা গল্প বটে।কারণ তাতে ওসমানী আহত হননি। আগরতলা দিয়ে ওসমানী কুমিল্লা হয়ে সিলেটে ঢোকেন। কুমিল্লা থেকে হবিগঞ্জ যাওয়ার পথেই তার কপ্টারে গুলি ছোড়া হয় বলে কথিত আছে। যাহোক ১২ তারিখ তিনি হবিগঞ্জে মুক্তাঞ্চল সফর করেছেন। লিংক: https://www.facebook.com/photo.php?fbid=10151110059433363

সিলেটে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী আত্মসমর্পন করে ১৫ ডিসেম্বরে। ওসমানী সেখানে উপস্থিত ছিলেন। ১৫ ডিসেম্বর মুক্ত সিলেটে ওসমানী। কথা বলছেন দুই সেক্টর কমান্ডার লে.কর্নেল সিআর দত্ত এবং লে.কর্নেল মীর শওকত আলীর সঙ্গে এমন একটা ছবি ওসমানীর নিজের স্মৃতিকথাতেই প্রকাশিত : https://www.facebook.com/photo.php?fbid=10151110069528363

আর তিনি আত্মসমর্পনের দায়িত্বে থাকা মিত্র বাহিনীর ভারতীয় অফিসারদের অভিনন্দন জানাচ্ছেন সে ছবিটাও আছে তার উপর প্রকাশিত সেই বইয়ে (ও জেনারেল, মাই জেনারেল): https://www.facebook.com/photo.php?fbid=10151119022123363

এমনকি মিত্রবাহিনী গঠন ও অনুমোদন তার সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতেই হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিনের সঙ্গে স্যাম মানেকশর বৈঠকে তিনিও ছিলেন। ছবি: https://www.facebook.com/photo.php?fbid=10151119020723363
এমনকি সৈয়দ নজরুল ইসলামের সঙ্গে বৈঠকেও। https://www.facebook.com/photo.php?fbid=10151119021418363

এখন আসা যাক, আপনার প্রশ্নের মধ্যে গোপন প্রশ্নটায়। ভারতীয় জেনারেল সই করেছেন যে দলিলটায় সেটায় কি পাকিস্তান ভারতের কাছে আত্মসমর্পন করেছে? উত্তর না। করেছে বাংলাদেশ-ভারত যৌথ কমান্ডের কাছে। সেই এখতিয়ার বাংলাদেশ সরকার অরোরাকে দিয়েছে। আত্মসমর্পনের যে দলিল সেটা ইনস্ট্রুমেন্ট অব সারেন্ডার নামে পরিচিত। সেটার বাদিকে নীচে অরোরা যেখানে সই করেছেন, সেখানে কি লেখা দেখেন তো? লেখা: জেনারেল অফিসার কমান্ডার ইন চীফ ইন্ডিয়ান অ্যান্ড বাংলাদেশ ফোর্সেস ইন দ্য ইস্টার্ন থিয়েটার। লিংক: http://1.bp.blogspot.com/-vP7oLR2v73o/TbGvgJfnFiI/AAAAAAAAAFg/yvDpzVfQhZI/s1600/Instrument+of+Surrender%2816-12-09+DS%29.JPG

উত্তর পাইলেন? এত তথ্য প্রমাণের পরও সন্তুষ্ট না হইলে আমি নাচার।

কারণ এইসব বিভ্রান্তি যারা ছড়ায় সেই ছাগুরা জানে তারা যদি বিসমিল্লাহ সহকারে বলে যে আম গাছে আসলে লিচু ফলে সেইটাও মনেপ্রাণে বিশ্বাস করার মতো বহু বলদ বাংলাদেশে গিজগিজ করতেছে। এবং সবচেয়ে মন খারাপের বিষয় হইলো, এই লেখাটা হয়তো অনেকে লাইক দিবে, তারা শেয়ারও দিবে হয়তো। কিন্ত কেউ লিংকগুলা ক্লিক করে মন দিয়া পড়বে না। পড়লেও মনে থাকবে না। কয়দিন পর ছাগুদের কোনো পেইজে আপনার প্রশ্নগুলা তারা আবার পড়বে, তারপর আমারে ম্যাসেজ দিবে, ভাই ওরা যে বলে এই এই এই, এইগুলার উত্তর কি। তখন খালি মনে হয় হে ধরণী দ্বিধা হও।

মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রধানমন্ত্রী ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ সাক্ষরিত আতাউল গনি ওসমানীর প্রধান সেনাপতি হিসেবে নিয়োগপত্র যা ১২ এপ্রিল থেকে কার্যকর বলে ধরা হয়।

মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রধানমন্ত্রী ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ সাক্ষরিত আতাউল গনি ওসমানীর প্রধান সেনাপতি হিসেবে নিয়োগপত্র যা ১২ এপ্রিল থেকে কার্যকর বলে ধরা হয়।