নিজস্ব সংবাদদাতা ॥ শীত মৌসুমেও বিদ্যুতের ভয়াবহ লোডশেডিং ও জাতীয় গ্রীডের ‘স্ক্যাডা’ (বিশেষ পদ্ধতিতে ফিডার সংযোগ বন্ধ করা) সমস্যার কারনে বরিশাল বিসিক শিল্প এলাকার অর্ধশতাধিক শিল্প প্রতিষ্ঠান বন্ধের উপক্রম হয়ে দাঁড়িয়েছে। লক্ষ লক্ষ টাকা গচ্ছা দিয়েও ক্ষুদ্র, কুটির ও মাঝারি শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোকে টিকিয়ে রাখতে পারছেন না শিল্প প্রতিষ্ঠানের মালিকরা। ফলে বিপুল টাকা ব্যয়ের এসব শিল্প প্রতিষ্ঠান চালু করা হলেও লোকসানের মুখে এখন ওইসব ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশংকা রয়েছে।
শিল্প মালিকরা জানান, শীত মৌসুমেও চাহিদার অর্ধেক বিদ্যুৎ পাওয়া যাচ্ছে না। জাতীয় গ্রীডের ৩৩ কেভি সঞ্চালন লাইনের লোডশেডিং এর পাশাপাশি ‘স্ক্যাডা’ সমস্যায় জর্জরিত হয়ে পরেছেন তারা। বিদ্যুৎ কন্ট্রোল রুম থেকে জানা গেছে, বরিশালে গড়ে অফপিক আওয়ারে ২৮ মেগাওয়াট ও পিক আওয়ার ৪২ থেকে ৪৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়। অথচ বরিশালে শীতকালেই চাহিদা রয়েছে পিক আওয়ারে ৭৫ মেগাওয়াট ও অফপিক আওয়ার ৪৫ মেগাওয়াট। জাতীয় গ্রীড থেকে যখন চাহিদার প্রায় অর্ধেক বিদুৎ সরবারহ করা হচ্ছে ঠিক তখনই ‘স্ক্যাডা’ সমস্যায় দূর্ভোগ আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। বিদুৎ বিভাগ ও ব্যবসায়ীরা জানান, বরিশাল বিসিক শিল্প এলাকাটি কাশিপুর ফিডারের অধীনে। সেখানে শিল্প প্রতিষ্ঠান থাকায় বিদুৎ এর চাহিদা বেশি। বর্তমানে জাতীয় গ্রীড পরিচালনার দায়িত্বরত ঢাকার প্রকৌশলীরা যে কোন সময় ঢাকায় বসে যে কয়টি ফিডারে স্ক্যাডা পদ্ধতিতে সরবারহ বন্ধ করতে পারেন তারমধ্যে এ ফিডারটি অর্š—ভূক্ত রয়েছে। তাই রাজধানী ঢাকাসহ গুরুত্বপূর্ন স্থানে বিদুৎ সংকট দেখা দিলেই স্ক্যাডার কবলে পরে এ ফিডারটি। বিসিকের শিল্প মালিক-শ্রমিকদের সাথে আলাপ করে জানা গেছে, স্থানীয় কন্টোল রুম থেকে এক ঘন্টার লোডশেডিং দেয়ার পর তারা যখন কাজ শুরু করেন, তার মাত্র ১০ মিনিট পরই আবার স্ক্যাডা করে বাড়তি আরো এক ঘন্টা লোডশেডিং দেয়া হয়। এতে উৎপাদন ব্যহৃত হওয়ার চেয়েও কাঁচামাল নষ্ট হয়ে তাদের বিপুল লোকসান গুনতে হচ্ছে। প্রতিষ্ঠানগুলোর বেহালদশার কারনে বিসিকের ১০ হাজারেরও বেশি শ্রমিক এখন চরম দূর্ভোগ পোহাচ্ছেন। মালিকের লোকসানী প্রতিষ্ঠানের শ্রমিকেরা ঠিকমত বেতন-ভাতা না পেয়ে পরিবার পরিজন নিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন। শিল্প মালিকরা শ্রমিকদের দূর্ভোগের কথা স্বীকার করে জানান, প্রতিষ্ঠান টিকিয়ে রাখাই যেখানে মুশকিল, সেখানে বেতন-ভাতা দিয়ে তারা কিভাবে শ্রমিকদের সমস্যা সমাধান করবেন। মালিকদের বক্তব্য সার্বক্ষনিক নিরবিচ্ছিন্ন বিদুৎ যদি তাদের সরবারহ করা হয়, তাহলে শ্রমিকদের বেতন-ভাতার পর ওভার টাইমের জন্য অতিরিক্ত টাকাও দেয়া সম্ভব হবে। সরেজমিনে বিসিক এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, শিল্প মালিকদের নানা দূর্ভোগের চিত্র। বেঙ্গল বিস্কুট লিমিটেড’র ফ্যাক্টরীর ম্যানেজার শহিদুল ইসলাম জানান, বিদ্যুৎ বিপর্যয়ের কারণে প্রতিদিন তার কয়েক লাখ টাকার ক্ষতি হচ্ছে। হঠাৎ লোডশেডিং হলে বিস্কুটসহ তাদের লাখ লাখ টাকার যন্ত্রপাতিও নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। তাদের ফ্যাক্টরীতে কর্মরত ৫’শ শ্রমিককে সার্বক্ষনিক কাজে লাগানো সম্ভব হয় না। ফলে প্রতিষ্ঠান টিকিয়ে রাখা প্রায় অসম্ভব হয়ে পরেছে। নতুন বৃহৎ শিল্প প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ফরচুন সুজ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমানুর রহমান জানান, অব্যাহত লোডশেডিংয়ে দৈনিক তার ৩ থেকে ৪ লক্ষ টাকার ক্ষতি হচ্ছে। নতুন এ শিল্প প্রতিষ্ঠান বিদ্যুতের অভাবে টেকানো যাচ্ছে না বলেও তিনি উল্লেখ করেন। প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ৬’শ শ্রমিক পোহাচ্ছেন লোকসানের এ দূর্ভোগের বোঝা। অনন্যা ফুটস ও প্যাকেজিং’র স্বত্ত্বাধিকারী সামসুদ্দিন কামাল জানান, তার ফ্যাক্টরীর ৩ শতাধিক শ্রমিক এখন অধিকাংশ সময় অলস সময় কাটাচ্ছেন। একই অবস্থা ম্যাকপাই পিভিসি প্লাষ্টিক, রাফি প্লাষ্টিক, সাউদান পলি, হাওলাদার পিভিসিসহ বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানের। সকলেই বিদ্যুত বিপর্যয়ের জন্য লোকসানের কথা জানিয়েছেন। ম্যাকপাই পিভিসি প্লাষ্টিক ইন্ডাষ্ট্রিজের স্বত্ত্বাধিকারী রাইসুল হায়দার টিপু জানান, গরমের তীব্র লোডশেডিং কাটিয়ে ওঠার পর শীত মৌসুমেও একই অবস্থা হবে তা তারা বুঝে উঠতে পারেননি। সকাল ৯টায় ফ্যাক্টরী চালু হবার পর প্রতি এক ঘন্টার ব্যবধানে হঠাৎ বিদ্যুত যাওয়া-আসার কারনে তার বিপুল টাকার প্লাষ্টিক নষ্ট হচ্ছে। শুভ ইঞ্জিনিয়ারিং, শাহাদাত ষ্টীলসহ একাধিক ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপের মালিকেরা জানিয়েছেন, প্রতিদিন গড়ে ৭ থেকে ৮ বার বিদ্যুত যাওয়া আসা করে। বিদ্যুত গেলে কমপক্ষে এক ঘন্টার আগে বিদ্যুতের দেখা মেলে না। তীব্র শীতেই এ অবস্থা হওয়ায় শংকিত শিল্প মালিকরা। আর এ কারনে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে নতুন উদ্যোক্তারা।
বরিশাল বিদ্যুত বিভাগের (ডিভিশন-২) নির্বাহী প্রকৌশলী তারিকুল ইসলাম জানান, ‘স্ক্যাডা’ অন্তর্ভূক্ত ফিডার গুলোর মধ্যে যে কোন ফিডার জাতীয় গ্রিডের সমস্যার কারনে ঢাকা থেকে সরবারহ বন্ধ করা হয়ে থাকে। বিসিক শিল্প এলাকাটি স্ক্যাডা অন্তর্ভূক্ত কাশিপুর ফিডারের আওতায় থাকায় উত্তোরণের কোনো উপায় তাদের কাছে নেই বলেও তিনি উল্লেখ করেন। ঢাকা থেকে ‘স্ক্যাডা’ প্রক্রিয়ায় ফিডার বন্ধ করে দিলে স্থানীয় বিদ্যুত বিভাগের কোন উপায় থাকে না। সারাদেশেই ‘স্ক্যাডা’য় যুক্ত ফিডারের গ্রাহকেরা এ দূর্ভোগ পোহাচ্ছের বলে প্রকৌশলী তারিকুল ইসলাম জানিয়েছেন। এ ব্যাপারে বরিশাল চেম্বার অব কর্মাসের সভাপতি সাইদুর রহমান রিন্টু বলেন, বিসিককে বাঁচাতে হলে জরুরি ভিত্তিতে জেলা প্রশাসন বিদুৎ বিভাগের সাথে যোগাযোগ করে সরবরাহ নিশ্চিত করলে অবশ্যই বিসিক আবার ঘুরে দাঁড়াবে। আর বিসিক ঘুরে দাঁড়ালে শুধু ব্যবসায়ী শিল্প উদ্যোক্তারা লাভবান হবে না বরং বরিশালের বেকারত্বও দূর হবে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।