নিরব এই আমি

অচেনা স্বপ্ন ॥ মেয়েটা আসলেই একটা পাগল। এই রকমও কেউ করে? আজকাল কেমন যেনো আচরন করছে। আমি নিজেও ওকে ঠিক বুঝতে পারিনা এখন। ক্লাসের নাম করে সেই সকাল ১০ টায় বের হয় আর বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত ৮ টা। কেনো যে দুইজন দুই যায়গায় ভর্তি হতে গেলাম? তা না হলে সারাদিন একসাথে থাকতে পারতাম। কলেজেও আমরা একসাথে ছিলাম, খুব মজা করতাম। ক্লাসের পরই কোথাও না কোথাও ঘুরতে যেতাম।

ছোট বেলায়ই মা হারায় অহনা আর ওর বাবা দেশের বাইরে থাকে ওর সৎ মাকে নিয়ে। মাসে মাসে ওর জন্য টাকা পাঠায়। ওই টাকায়ই আমরা দুইজন আয়েশ করি। আমার বাবা মা গ্রামে থাকে তাই আমরা দুই বান্ধবি ঢাকায় একটা রুমে ভাড়া থাকি। অহনা আমার খুব ছোট বেলার বন্ধু। ওকে আমি ভালো করে চিনি। খুব ভালো মেয়ে ও। দেখতে খুব একটা ভালো না হলেও ওর মনটা খুব ভালো। যে একবার ওর মনটা চিনতে পারে সেই চট করে ওর প্রেমে পড়ে যায়। আমি চুপচাপ দেখি আর হাসি। অনেক ছেলেরা ঘুরে ওর পিছনে। ধুর…… কি বলতে কি বলছি?

বলছিলাম অহনার কথা। সেই সকাল ১০টায় বের হয়েছে আর এখন বিকাল ৫টা বাজতে যাচ্ছে, ওর কোনো খবরই নেই। ফোনটাও এখন বেশিরভাগ সময় সাইলেন্ট মুডে রাখে। খবর পাওয়ার কোনো উপায় নেই। দুই মাস আগেও ও এমন ছিলোনা। তখন এক মিনিটের জন্যও ফোনটাকে চোখের আড়াল হতে দিতোনা। অন্তিক ফোন দিয়ে না পেলে রাগ হয়ে যেতো খুব। অন্তিক ছেলেটাকে আমার কাছে খুব লাকি মনে হয়েছে। অহনার মত একটা মেয়ের ভালোবাসা পেয়েছে ও। ভালোবাসা কখনই তেমন পায়নি অহনা কিন্তু তাই বলে কাউকে ভালোবাসতে গেলে কোনো কমতি রাখেনা। মন উজার করে ভালোবাসে।

অন্তিকের সাথে ওর সম্পর্ক ৫ বছর ধরে চলছে। অন্তিক কিভাবে যেনো ওর নাম্বার পেয়ে ওকে ফোন দিয়েছিলো। অহনা তেমন একটা কথা বলতে চাইতোনা তখন কিন্তু অন্তিক কথা বলবেই। যাই হোক অনেক নয় ছয় করে কথা শুরু করলো অহনা। কথা বলতে বলতে কখন কিভাবে যে অহনার মনে অন্তিক ঢুকে গেল বলতেও পারবেনা ও। প্রতিদিনই একটু একটু করে এগুচ্ছিলো ওদের ভালোবাসার রেলগাড়ি। আর প্রতিদিন অহনার ভালোবাসাও বাড়ছিলো দিগুন আকারে। সকালে ঘুম ভাংতো অন্তিকের ঘুম জড়ানো কন্ঠ শুনে আর রাতে ১১ টা থেকে কথা শুরু করে ২ টা ৩ টা পর্যন্ত চলতো। আবার সকালে ঘুম থেকে উঠিয়ে যে যার কলেজের উদ্দেশ্যে বের হয়ে যেতো। এভাবেই চলছিলো ওদের দিন।

দেখা হতো মাঝে মাঝে। ফোনেও চলতো অহনার খবরদারি, অন্তিক ঠিক মত খেলো কিনা? সন্ধার আগেই বাসায় ঢুকলো কিনা? সন্ধার সাথে সাথেই কিছু খেয়ে পড়তে বসলো কিনা এইসব ভুলেও জিজ্ঞেস করতে ভুলতোনা অহনা। খুব কেয়ারফুল ছিলো অন্তিকের ব্যাপারে। অন্যদিকে অন্তিককে কখনো শুনিনি যে অহনার খাবার অথবা পড়ার কথা জানতে চেয়েছে। ছেলেটা সবসময় নিজের কথাই ভাবতো, অহনা কেমন আছে বা কি করছে, মন ভালো আছে নাকি কখনোই জানতে চাইতোনা। এই নিয়ে মাঝে মাঝে অহনার মন খারাপ হলেও বুঝতে দিতোনা কাউকে কিন্তু আমি ঠিকই বুঝে যেতাম ওর মন খারাপের কারন।

বছর খানিকের মাঝেই অহনা ওকে এতো ভালোবেসে ফেললো যে অন্তিক যা বলে তাই ঠিক। ও যতদোষই করুক কোনো ব্যাপার না, ওর জন্য হাজার খুন মাফ। ভালোবাসার পরিমানটা এতোবেড়ে গেলো যে অন্তিক হাওয়ায় ভাসতে লাগলো। ঝগড়া হলে অবশ্য ১০ মিনিটের বেশি সময় নিতোনা অন্তিক ফোন দিতে। ১০ মিনিটেই আবার সব ঠিক হয়ে যেতো ওদের। এভাবেই ওদের ভালোবাসার তিনটি বছর কেটে গেলো। এই তিন বছরে ওদের ভালোবসা দেখে খুব ভালো লাগতো যে এভাবেও কেউ কাউকে ভালোবাসতে পারে। অহনাও খুব খুশি থাকতো। রাতে ঘুমানোর সময় আমরা একজন আরেকজনকে সারদিনের ঘটনা বলতাম। অহনার কথা শুনে মাঝে মাঝে আমারও মনে হতো ইশ! এইভাবে যদি কেউ আমাকে ভালোবাসতো।
ভালোবাসার চতুর্থ বছরে গিয়ে ঘটলো বিপত্তি, দুইজনের মধ্যে ঝামেলা। অন্তিকের বিবিএ এর ক্লাস শুরু হওয়ার পর থেকে একদম পালটে যেতে লাগলো ও। আগের মত ফোনেও আর সময় দেয়না অহনাকে। দুপুরে ক্লাস শেষ করে বাসায় চলে আসে ঠিকই কিন্তু বাকি দিনটা ঘুমিয়ে কাটিয়ে দেয়। বলতে গেলে ওর দুপুরের ঘুম ভাঙ্গে পরদিন সকালে ক্লাসের আগে। ক্লাসে যাওয়ার আগে সকাল ৭ টায় অহনার ঘুম ভাঙ্গায় কিন্তু অন্তিক বলতেও পারবেনা যে ওর অপেক্ষায় সারারাত অহনা না ঘুমিয়েই কাটিয়েছে। সকাল ৬ টায় ঘুমালেও ৭ টায় অন্তিকের ফোন দেখে একটুও রাগ হয়না অহনা। এরপর এভাবেই চলতে থাকে প্রতিদিন। সকাল ৭টায় একবার কথা আর বিকালে একবার কিন্তু আগে যেখানে সারাদিন কথা বলতো সেখানে দিনে দুইবার মানাতে খুব কষ্ট হয়ে গেলো অহনার। অহনা বার বার অন্তিককে বলে, ফোন দিতে না পারো একটা এস এম এস তো দিতেই পারো। অন্তিকও খুব বুঝে কিন্তু ফোন রাখলেই আবার সব ভুলে যায়।

ঠিক ৫ মাস পর অন্তিক জানালো সে আর এই রিলেশন রাখতে পারবেনা। যখন এই কথাটা অহনার কানে গেলো অহনা আমার সাম্নেই বসে ছিলো। আমি কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই দেখলাম অঝর ধারায় বর্ষন হতে লাগ্লো ওর চোখ দিয়ে। হয়তো খুব চেষ্টা করে নিঃশব্দ ছিলো কিছুক্ষন, কিছুসময় পর আমাকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কাঁদতে লাগলো। জরের মধ্যে যেভাবে মানুষ প্রলাপ বকে ঠিক ওইভাবেই বলতে লাগলো ও গলা ফাটিয়ে চিৎকার করছে। এর মাঝে আমি যে কথাটা বুঝতে পেরেছিলাম তা ছিলো, ‘আমার কি দোষ ছিলো, কেনো ও আমাকে ছাড়লো? কিভাবে থাকবো আমি ওকে ছাড়া?’ কথাগুলো শুনে আমারো খুব কান্না পাচ্ছিলো কারন আমিও দেখেছিলাম অহনার ভালোবাসা। কোনো কারন ছাড়া কিভাবে একটা নিশপাপ মেয়েকে কেউ এতোটা কষ্ট দিতে পারে। অনেক বুঝালাম অহনাকে কিন্তু কিছুতেই ও থামছিলোনা। সারা রাত লাইট জালিয়ে ফোন্টা হাতে নিয়ে বসে ছিল এই আশায় হয়তো অন্তিক ফোন দিয়ে সরি বলবে। এভাবেই সকাল হলো।

আজকের ক্লাসটা মিস করলো অহনা, সাথে আমিও। সারাদিন গল্প করে পার করলাম আমরা কিন্তু তবুও ঘরের কোনায় যে বিষন্নতাটা ছিলো তা রয়েই গেলো। দূর করতে পারলাম্না কোনোভাবেই। আমার সাথে ১৫ মিনিট কথা বললে ১৬ মিনিটের সময় এই বলে কেদে উঠে যে, আমার কি দোষ ছিলো? খুব কষ্টো হচ্ছিলো ওর জন্য। দুপুরে অনেক চেষ্টার পর একটু ঘুমালো। হটাত একটা ফোনের আওয়াজে ঘুম ভাংলো, উঠে দেখে ফোনের স্ক্রিনের নামটা অন্তিক। কেনো যেনো ও ফোন্টা না ধরে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষন। কাদতে শুরু করলো আবার সেই কথা মনে করে। এর মধ্যে ফোনতো বেজেই যাচ্ছে। তৃতীয় বার ফোন ধরে কান্নার মাঝেই হ্যালো বলে চুপ করে শুনতে লাগ্লো অন্তিকের কথা। কি বললো কিছুই বুঝলাম্না কিন্তু কান্নার আওয়াজ বের হচ্ছে এখন। খুব মায়া লাগছে ওর চেহারাটা দেখে। ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাদছিলো।

অহনাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম কি জন্য ও চলে গেলো? ওই দিন কি শুনছিলো ও চুপ করে? কেনো অন্তিকের সাম্নেই কেদে উঠলো আওয়াজ করে? অনেকদিন পর জানতে পেরেছিলাম এর কারন ছিলো ওই মেয়েটি যে বিনা কারনেই সারাদিন ফোন দিতো অন্তিককে। নোট, সাজেশন, সিলেবাস বলে কথা চালিয়ে যেতো। প্রায়ই নাকি ফোন ওয়েটিং পেতো কিন্তু অহনা ওকে এতোটাই বিশ্বাস করতো যে ও যা বলতো তাই বিশ্বাস করতো। অন্তিক চলে গেলো ৫ বছরের সম্পর্ক শেষ করে। সাথে পালটে দিয়ে গেলো অনেক কিছু। বলতে গেলে সব কিছুই। আগে যেখানে ক্লাসের সময় ছাড়া বাকি সময় আমরা একসাথে থাকতাম বাসায় সেখানে এখন ওর সাথে আমার শুধু রাতে দেখা হয়। কথাতো হয়না বললেই চলে। কথা বলার জন্য যদি প্রশ্ন করি উত্তর এর পর আবার নিরবতা।

শুনেছিলাম মেয়েদের জন্য নাকি ছেলেরা খারাপ হয় কিন্তু এখানেতো পুরাই উলটা দেখছি। ওই ছেলেকে ভুলার জন্য নিজেকেই ভুলে থাকতে চাচ্ছে ও। সকালে বের হয়ে যায়, কিছু নেশাখোর বন্ধু জুটিয়েছে ওদের সাথেই ঘুরে বেরাচ্ছে সারাদিন। ফোন সারাক্ষন সাইলেন্ট। কেউ ফোন দিয়ে পায়না ওকে। কারো সাথে কথা বলেনা তেমন। রাতে বাসায় এসেই ল্যাপটপের ভিতর মুখ ঢুকিয়ে ফেলে। আমার সাথেও শুধু কি খবর বলেই শেষ। রাতে বিছানায় যায় ৩টার দিকে। হাতে একটা সিগারেট আর একটা পেপ্সির বোতল। বোতলের মুখ খুললে খুব বিষাক্ত একটা গন্ধে ঘর ভরে যায়। আমার কোনো কথাই শুনেনা, উলটা আমাকে বলে ‘আয় তোকে সিগারেট খাওয়া শিখাই’ বলেই বড় করে একটা টান দেয় আর বেশ কিছুক্ষন পর অল্প কিছু ধোয়া বের করে দেয় নাক দিয়ে। তারপর বোতলে একটা চুমুক দেয় আর চেহারাটা খুব বিকৃত করে। ওর কান্ড দেখে আমার চোখ বড় বড় হয়ে যায়। কি করবো আমি এই মেয়েটার?

কতো সুন্দর ছিলো আমাদের জীবন, কেনো নিজের হাতে শেষ করে দিচ্ছিস অহনা? আমার প্রশ্নে অহনা উত্তর দেয়, ‘আমিতো তাদের থেকে অনেক ভালো যারা মানুষের জীবন নষ্ট করে বিনা অনুমতিতে। আমিকি অন্তিক্কে আমার জীবনে ডেকেছিলাম, কেনো ও আমার জীবন নষ্ট করলো? আমিতো ওর কাছে শুধু একটু ভালোবাসা চেয়েছিলাম, তার জন্য ও আমাকে এতো বড় শাস্তি দিবে? আমিতো অন্য কারো জীবনে যাচ্ছিনা, কারো জীবন শেষ করছিনা অন্তিকের মত। আমি শুধু আমার নিজের জীবনে একটু শান্তি চাচ্ছি। ভুলে থাকতে চাচ্ছি ওই নিষ্ঠুর অতীতকে। আমি কি খারাপ করছি বল?’ এইসব বলতে বলতেই ডুকরে কেদে উঠে ও, আর বলে ‘তুই আবার আমাকে কাঁদালি। আমি কাঁদতে চাইনা একদম। কার জন্য কাঁদবো? যে আমাকে জীবনের সবচেয়ে বেশি কষ্ট দিয়েছে? না আমি আর কাঁদবো না। এখন থেকে আমরা জীবন উপভোগ করবো’।

ওর কথা শুনে আমি কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেলি। শুধু ওকে জড়িয়ে ধরি শক্ত করে আর কেঁদে যাই নিরবে।