তোর অপেক্ষায়

অচেনা স্বপ্ন ॥ আচ্ছা স্কুল এর দিনগুলির কথা কি তোর মনে আছে? কত্তো মজা করতাম আমরা। আমরা ৬ জন ছিলাম, সব সময় এক সাথেই ঘুরতাম আমরা । ক্লাস এর ফাকেই চলতো আড্ডা কিন্তু ধর্ম ক্লাসটা খুব কমই করতাম আমরা। ওই ক্লাস মিস দিয়ে আড্ডাটা কোথায় দিতাম তা তো ভুলার কনো কারন ই নাই। আর এর মাঝে যদি বিভা মেডাম এর আওয়াজ পাইতাম তাইলেতো কথাই নাই এক এক জন এক এক বাথরুম এ লুকাইতাম। আলমগির স্যার এর ক্লাস এ হোম ওয়ার্ক না করে সবাই বেঞ্চের উপর কান ধরে দাঁড়ায় থাকতাম, একদিন তো লিজা খাতা আনার পরও কান ধরে দাড়ালো আমাদের সঙ্গ দেওয়ার জন্য।

স্কুল ছুটির পরই দল বেধে চলে যেতাম কর্নফুলির চার তালায়। আমাদের আড্ডার জায়গাতো সবসময় রিজার্ভ ই থাকতো। প্রতিদিন ওই টেবিলেই বসা চাই আমাদের। রিফাত ভাই এর দোকান এর সামনের কোনার টেবিল টা। খুব চিল্লাচিল্লি করতাম আমরা সবাই মিলে, একদিনতো লিজা আমাদের সাথে বাজি লেগে দুইটা ছেলের নাম্বার নিয়ে আসলো। ইসসস কি আড্ডাবাজ ই না ছিলাম তখন আমরা। মাঝে মাঝেতো দিনে দুইবার ও যেতাম ওখানে। শুক্রবারে দেখা যেতো দোকান খুলার সাথে সাথেই আমরা হাজির কিন্তু ওদের খাবার রেডি হতোনা। আমরাও ছিলাম নাছরবান্দা, খাবার খেয়েই তবে আসতাম। ওইসময় প্রায় সারাদিন ই একসাথে থাকতাম আমরা। দিন গুলো আসলেই খুব ভাল ছিল তখন, তুই ও খুব ভাল ছিলিরে, তোকে যত কিছুই বলতাম তুই কিছুই বলতি না, যতই চিল্লাইতাম তুই চুপ করে শুনতি। কারন তুই জানতি আমার রাগ উঠলে উলটা পালটা বলতাম। আমার রাগটা তুই খুব ভালো বুঝতি। উল্টা আমাকে কেউ কিছু বললে তার সাথেই লেগে যাইতি, এমনকি তোর বোন, মা, খালার সাথেও লাগতি। কোথাও যেতে হলে আমাকেই লাগতো তোর সাথে, আবার আমাদের সাথে অন্য কাউকেও নিতে চাইতিনা, কেউ যদি যেতে চাইতো তুই রাগ হয়ে যাইতি। মনে আছে রাব্বি যখন বলল আমার বন্ধু হতে চায় তাও আবার তোর মত, মানে আমার আর তোর যেমন বন্ধুত্ত তেমন। তুই যে তখন কি রাগ হয়েছিলি আর রাব্বিকে যে কত বকেছিলি তা শুধু আমিই শুনেছি। স্কুল ফাঁকি দিয়ে মাঝে মাঝে আমরা দুইজন রিক্সা ভ্রমন করতাম, সেই সকাল ৭ টায় বের হতাম আর দুপুর ১২ টায় বাসায় আসতাম। কখনও টিএসসি আবার কখনও নিউ মার্কেট ঘুরে বেরাতাম। দিনে দুইবারতো দেখা হতই তারপর ফোনতো আছেই। প্রায় সারা সন্ধ্যাই ফোন এ বকবক করতাম তাও কথা শেষ হইতনা। মন খারাপ হলেই তোকে ফোন দিয়ে চুপ করে থাকতাম তুই কিভাবে যেনো বুঝতি যে আমার মন খারাপ, আমি কাদলেও বুঝতে পারতি কিছু সমস্যা হয়েছে। আমিও তুই ছাড়া অন্য কাউকে কিছু বলতে পারতাম না, বাসায় যতো কিছুই হোক তোকে জানানোই লাগতো। একবার আম্মুর সাথে ঝগড়া করে খুব কাদলাম, তোকে বলার সাথে সাথেই তুই বাসায় চলে আসলি আমাকে বাইরে নিয়ে যাওয়ার জন্য। তারপর সারাদিন বাইরে ঘুরলাম আমরা কোন ফাঁকে যে তুই আমার মন ভাল করে দিলি টের ই পেলাম না। আমরা প্ল্যান করতাম কোথায় ঘুরা যায়? কাকে কিভাবে জালানো যায়? ফোনেও মানুষ্ কে খুব জালাতাম আমরা। দুইজন সন্ধ্যার পর মনেহয় ১০ থেকে ১২ বার কথা হতো ঘুমের আগ পর্যন্ত মাঝে মাঝেতো রাত ১ টা ২ টায়ও ফোন দিতাম আমরা, এক জন আর এক জন কে অকারনেই। কতো যে বাদ্রামি করেছি ওই দিন গুলিতে তা আর বলে শেষ করা যাবেনা। যখন আমার বাসায় একসাথে হতাম সারা দুপুর গল্প করেই কাটাতাম আর আম্মু এসে বলত, ‘কতো কথা বলিস তোরা? কিযে হবে তোদের বিয়ের পর? মাসের পর মাস দেখা হবেনা দুজনের’। তুই তখন চিল্লায় বলতি, ‘আমরা আলাদা হলেইনা দেখা হবে, এক ঘরে দুই ভাই দেখেই আমরা বিয়ে করবো আমি বড় ছেলেকে বিয়ে করব আর আপনার মেয়েকে দিবো ছোটোটার কাছে, সব কাজ ওকে দিয়েই করাবো। খুব জালাবো আপনার মেয়েকে। এক্ সাথেই শপিং এ যাবো। আর যদি আমাদের কোনো ননদ থাকে তাহলে তাকে জালাবো আমরা দুইজন মিলে।

যখন আমরা স্কুল শেষ করে কলেজ এ উঠলাম তখন মনেহয় বাকি কলেজ পড়ুয়া ছেলে মেয়েদের মত আমাদেরও পাখা গজালো। যদিও তখন সবার সাথে যোগাযোগ অনেক কমে গেল, শুধু রইলাম আমি আর তুই। আমাদের কলেজ আলাদা হওয়াতে দেখাটা একটু কমে গেল তারপর ও এক দিন পর পর ই দেখা হত আর ফোন্ তো ছিলই, কম দেখা হওয়ার কারনে ফোনে কথা বেরে গেল দ্বিগুন সাথে ঘুরাঘুরিও অনেক বারল এখন আমরা শুধু বেইলিরোড আর টি এস সি তে ঘুরি না। আমরা বসুন্ধরা সিটি আর ধানমন্ডির মার্কেট এ ঘুরে বেড়াই আর সাথে টুকটাক শপিং করি। বইমেলা আর বানিজ্য মেলার কথাতো না বললেই না। বইমেলার ২৮ দিন এর মধ্যে মনে হয় ১০, ১২ দিন যাওয়াই লাগতো। আর কতো বই যে তুই কিনতি পড়তেও বেশি সময় লাগত না তোর। আমরা দুইজন ই ছিলাম দুই জন এর জান, আমি দুই দিন এর জন্য ঢাকার বাইরে গেলেই তোর মন খারাপ হয়ে যেতো। আমাদের মধ্যে ঝগড়া খুব কমই হতো, একবার ই ঝগড়া হইছিলো দুই দিন ছিলাম কথা না বলে আর ওই দুইদিনেই শিক্ষা হইছিলো আমাদের তারপর প্রমিজ করছিলাম আর কখনও ঝগড়া করবোনা। তুই বলছিলি আমার সাথে কথা না বলে তুই থাকতে পারবিনা।

কলেজ এ তোর বেশকিছু নতুন বন্ধু হয়েছিলো কিন্তু আমি আর নতুন কাউকে পাইনি। অল্প দিনেই তুই ওদের সাথে খুব ঘনিষ্ট হয়ে গেলি আর আমি? আমার চারপাশে শুধু তুই এ ছিলি। ইন্টার এর রেজাল্ট এর দিনের কথা মনে আছে তোর? খুব কান্না করেছিলি তুই 4.90 পেয়ে। আর আমি কোনো মতে তোকে সামলে তোর বাসায় দিয়ে আসলাম, তার পরই শুরু হলো ভর্তি যুদ্ধ আর তার সাথেই শুরু হল আমাদের সম্পর্কের ফাটোল। তুই ফোন দেয়া কমিয়ে দিলি আর আমার ফোন ও রিসিভ করতি কম কিন্তু আমি এর কোনো কারন খুজে পাইনি।

২০০৫ থেকে ২০০৯ পর্যন্ত আমাদের চার বছরের সম্পর্ক ভাঙতে চার দিন ও সময় নিলিনা তুই। আস্তে আস্তে আমাকে ফোন দেওয়া আর আমার ফোন রিসিভ করা বন্ধ করে দিলি, আমি অন্য নাম্বার থেকে ফোন দিলেও আমার কন্ঠ শুনেই ফোন কেটে দিতি। তখন যে আমি কি অবস্থায় ছিলাম তা যদি আজ তোকে বুঝাতে পারতাম। কেউ যখন কোনো কারন ছাড়াই কাউকে ছেড়ে যায় তার মনের অবস্থা কি হতে পারে আমি তখন তা উপলব্ধি করেছিলাম। তোকে অনেক ফোন দিয়েছি এমনকি তোর বাসায় ও গিয়েছিলাম কিন্তু তুই কিছুই বলিসনি আর আমার না জানা কারন না জানাই রয়ে গেল। ফেসবুকেও তোকে অনেক খুজেছি কিন্তু তানজিনা শহিদ নামে কেওই আমার বন্ধু হতে চায়না এখন। কিছুই জানালিনা আমাকে আর এভাবেই এক দিন দু দিন করে তুই অনেক দূরে চলে গেলি আমার কাছ থেকে। এই চার বছর যেভাবে পহেলা বৈশাখ, পহেলা ফাল্গুন, ভালবাসা দিবস, বন্ধু দিবসে আমরা একসাথে ঘুরতাম তা এখন অনেক মিস করি, এখন আর যাওয়া হয়না কোথাও এই বিশেষ দিন গুলিতে। বাসায় একাই কাটাই। এখন আর মন খারাপ হলে কাউকে ফোন দিয়ে চুপ করে থাকলেও ওরা বুঝেনা যে আমার মন খারাপ, নিঃশব্দে কাঁদলেও কেও বুঝতে পারেনা যে আমি কাঁদছি। হ্যা, আমি যে বন্ধুহীন তা বলবোনা বেশকিছু বন্ধু আছে আমার কিন্তু কেনো যেনো ওদেরকে আমার মনের কথা গুলো বলতে পারিনা অথবা বলতে ইচ্ছা হয়না আর বল্লেই বা কি কেও আমাকে বুঝতে পারেনা। তুই যে আমাকে কতোখানি পাল্টে দিয়েছিস তা আমি কখনো তোকে বুঝাতে পারবোনা। তুই যাওয়ার পর আমি কিছুদিন খুব অসুস্থ হয়ে গিয়েছিলাম তোকে খুব দেখতে ইচ্ছে হতো কিন্তু কাউকে কিছুই বলতাম না। আম্মু অবশ্য অনেকদিন তোকে ফোনও দিয়েছিল কিন্তু তুই আম্মুর ফোন ও ধরিসনি। তোকে যে মিস করি তা হয়তো তুই জানিস কারন তোকে প্রায়ই এস এম এস করি। মাঝে মাঝে অন্য নাম্বার থেকে ফোন দিয়ে তোর কন্ঠটাও শুনি, কথা বলিনা কারন আমার কন্ঠ শুনেতো তুই ফোন কেটে দিস। তোর কন্ঠ শুনে মাঝে মাঝে চোখ ভিজে যায়, গাল বেয়ে পানিও পড়ে কয়েক ফোটা। তোকে ফোন দিতেও ভয় লাগে যদি আমার জ্বালায় তুই নাম্বার পাল্টে ফেলিস তখনতো আমার আম ছালা সবই যাবে। জানিস এখন আর আমার জন্মদিনে তোর মত করে কেউ ফোন দেয়না, সকালে এসে কেউ আর আমার ঘুম ভাঙ্গায়না। মাঝরাতে তোর সাথে খুব কথা বলতে ইচ্ছে হয় কিন্তু তাতে কি তোরতো আর ইচ্ছে হয়না আমার সাথে কথা বলতে। কিভাবে থাকিস এখন আমাকে ছাড়া? যেই তানজিনা আমাকে ছাড়া চার দিন থাকতে পারতোনা সে এই চার বছর কিভাবে কাটালো আমাকে ছাড়া? এখন তুই কার সাথে মার্কেটে যাস আর পার্লারেইবা কে নিয়ে যায় তোকে? স্কুলের কোনো ফ্রেন্ডদের সাথেও কথা হয়না এখন, ফেসবুকে যে দু তিন জন আছে তাদের সাথে হাই হ্যালো হয় মাঝে মধ্যে।

সব শেষে তোকে বলবো, যেখানেই আছিস অনেক ভাল থাকিস শুনেছি তুই এখন IU(Independent university) তে BBA পড়ছিস। তোর অনেক বন্ধু হয়েছে নতুন কিন্তু আমি এখনও সেই জায়গায় ই আছি যেখানে তুই আমাকে রেখে গেছিস। তোর যায়গায় কেউ আসেনি এখনও, তোকে সত্যিই অনেক ভালোবাসিরে তানজিনা। রাস্তায় বের হলে আশে পাশে কেনো জানি তোকে খুজি, তোর বাসার সামনে দিয়ে যখন যাই অপলক তাকিয়ে থাকি তোদের গেট এর দিকে মনে হয় যদি তুই বের হস তুই আসবিনা জেনেও তোর জন্য অপেক্ষা করি। যদি কখন ভুলেও আমাকে মনে হয় ফোন দিস আর যদি এই লিখাটা তোর চোখে পড়ে তাহলেতো বুঝতেই পারছিস যে এখনও আমি তোকে কতোখানি ভালবাসি। আজ ২০১২ সালেও তোকে মনে করে আমার সেই পুরানো ডাইরিতে অনেক কিছু লিখি যে ডাইরিটা তুই আমাকে দিয়েছিলি কিন্তু তোকে কিছুই বলতে পারিনা। তোর অপেক্ষায় থাকবো।

কিছুকথাঃ এটা কোনো গল্প না এটা আমার নিজের জীবনের কিছু কথা। আমি আমার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু তানজিনার কাছে কোনোভাবে যেতে চাচ্ছি। ওকে ফিরে পাওয়ার ছোট্টো একটু আশা নিয়ে আমার এই লিখা।