বঙ্গবন্ধুর ডাকে আর ফিরে যাওয়া হয়নি

প্রেমানন্দ ঘরামী ॥  বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সারাদিয়ে ছুটিতে বাড়িতে বেড়াতে এসেও আর চাকুরিতে ফিরে যাওয়া হয়নি। দেশ মাতৃকার টানে যোগদিয়েছিলাম মুক্তিযুদ্ধে। নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ করে ছিনিয়ে এনেছিলাম সবুজে রক্তে লাল বিজয় পতাকা। জীবনের প্রথম সম্মুখ যুদ্ধেই হারিয়েছি সহযোদ্ধা চার বীর মুক্তিযোদ্ধাকে। সেইদিনের সে স্মৃতি আজো আমাকে পীড়া দেয়। আবেগ আপ্লুত হয়ে কান্নাজড়িত কন্ঠে কথাগুলো বলছিলেন, বীর মুক্তিযোদ্ধা সার্জেন্ট (অবঃ) আব্দুর রাজ্জাক চোকদার। ১৯৭১ সনের ২৫ এপ্রিল মুক্তিযুদ্ধের উত্তাল মুহুর্তে সড়ক পথে প্রথম মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধের মুখে পরে সম্মুখ যুদ্ধে পরাস্থ হয়েছিলো পাক সেনারা। সেদিন ঢাকা-বরিশাল মহাসড়ক দিয়ে পাকসেনারা দক্ষিণাঞ্চলের প্রবেশদ্বার গৌরনদীর কটকস্থলে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধের মুখে। ওইদিন সম্মুখযুদ্ধে সাতজন পাক সেনা নিহত ও মুক্তিবাহিনীর চারজন বীর সৈনিক শহীদ হয়েছিলেন। যে কারনে আজ ২৫ এপ্রিল গৌরনদী প্রতিরোধ দিবস।

সেইদিনের রণাঙ্গন কাঁপানো বীর মুক্তিযোদ্ধা সার্জেন্ট আব্দুর রাজ্জাক চোকদার পাক সেনাদের সাথে তাদের সম্মুখ যুদ্ধের বর্ননা দিতে গিয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পরেন। একান্ত সাক্ষাতকারে বর্তমান গৌরনদী উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডের সহকারি কমান্ডার আব্দুর রাজ্জাক চোকদার বলেন, আমার জীবনের এমন একটি সুযোগ তৈরী হবে ভাবতেই পারিনি। তৎকালীন পাকিস্তান সেনাবাহীনিতে যোগদান করে চাকুরির সুবাধে পাকিস্তানেই বসবাস শুরু করি। ১৯৭১ সনে ছুটিতে দেশে আসার কিছুদিন পরেই শুরু হল স্বাধীনতার মুক্তি সংগ্রাম। সে সময় স্বাধীনতার স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সারাদিয়ে বাঙালি জাতিকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সৃষ্টি করার লক্ষ্যে আর চাকুরীতে ফিরে যাওয়া হয়নি। তখন আমাদের এলাকায় ছুটিতে থাকা তৎকালীন সেনা সদস্যরা একত্রিত হয়ে সেনা সার্জেন্ট সৈয়দ আবুল হোসেনের নেতৃত্বে আমিসহ বন্ধুবর সুবেদার গোলাম মোস্তফা, সৈয়দ আবুল হাসেম, সৈয়দ অলিউল ইসলাম, মোক্তার হোসেন, আলাউদ্দিন সরদার ওরফে আলবক্স, আব্দুল হাকিম, মোসলেম উদ্দিন, মুজিবুর রহমান, আমিনুল ইসলামসহ অনেকেই স্থানীয় এমপি (চাঁদশী গ্রামের) এ্যাডভোকেট করিম সরদারের সাথে দেখা করি।

তখন তিনি তৎকালীন সেনা সার্জেন্ট সৈয়দ আবুল হোসেনকে নির্দেশ দিয়েছিলেন সেনা ইপিআর, পুলিশ ও আনসার সদস্যদেরকে নিয়ে আপনার নেতৃত্বে প্লাটুন তৈরি করে বেসামরিক লোকদের সামরিক প্রশিক্ষণ শুরু করেন। তখন তিনি আমাদের ছয়টি থ্রীনাট থ্রী রাইফেল, দুটি দোনালা বন্দুক ও কিছু গুলি দিয়েছিলেন। এরপর আমরা গৌরনদী কলেজের প্রতিষ্ঠাতা হরলাল গাঙ্গুলির বাড়ির পূর্বপাশের কলেজ ছাত্রাবাসে প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে অবস্থান নিয়ে বেসামরিক যুবকদের শসস্ত্র প্রশিক্ষণ দেয়া শুরু করি। এরইমধ্যে ১৯৭১ সনের ২৫ এপ্রিল সকাল ১০ টার দিকে আকস্মিকভাবে তৎকালীন এমপি এ্যাডভোকেট আব্দুর করিম সরদার আমাদের ক্যাম্পে উপস্থিত হয়ে পুরো প্লাটুন নিয়ে মুহুর্তের মধ্যে ভুরঘাটার দিকে অগ্রসর হওয়ার নির্দেশ দেন। তাৎক্ষনিক বেসামরিক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে প্লাটুন অন্তুর্ভুক্ত করে তিনটি সেকশনে ভাগ করে ভুরঘাটার উদ্দেশ্যে রওনা হলাম।

পথিমধ্যে ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কের কটকস্থল নামকস্থানে পৌঁছলে আমরা দেখতে পাই পাক হানাদার বাহিনী কনবাই নিয়ে বরিশালে প্রবেশ করছে। এটা দেখামাত্রই আমরা মুক্তিযোদ্ধারা মহাসড়কের দু’পাশে অ্যামবুশ (যুদ্ধ প্রস্তুতি) নেই। পাকিদের কনবাই গাড়ির চাকার ওপর গুলিবর্ষন করার পর পাক সেনারা আমাদের সাথে সম্মুখ যুদ্ধে লিপ্ত হয়। ওইদিন সাতজন পাক সেনা মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে নিহত হওয়ার পর পাকিরা ক্ষিপ্ত হয়ে বৃষ্টির মতো গুলি ছুঁড়তে থাকে। ফলশ্র“তিতে ভাগ্যক্রমে আমরা বেঁচে গেলেও ঘটনাস্থলেই শহীদ হন আমাদের সহযোদ্ধা বীর মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ আবুল হাসেম, মোক্তার হোসেন, আলাউদ্দিন সরদার ওরফে আলা বক্স ও পরিমল মন্ডল। এটাইছিলো সড়ক পথে দক্ষিণাঞ্চলে পাক সেনাদের প্রথম প্রতিরোধ ও এরাই হচ্ছেন সম্মুখ যুদ্ধের প্রথম চার শহীদ।
আক্ষেপ করে বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রাজ্জাক চোকদার বলেন, প্রতিবছর ২৫ এপ্রিল আসলেই ছুঁটে যাই সেইদিনের ঘটনাস্থল কটকস্থলে। কিন্তু অতিব দুঃখের বিষয় ঘটনাস্থলে গিয়ে আজো ব্যথিত হই আমি ও আমরা। স্বাধীনতার ৪২ বছর পরেও দক্ষিণাঞ্চলের সর্বপ্রথম সম্মুখ যুদ্ধের ঘটনাস্থল (কটকস্থলে) আজো নির্মিত হয়নি কোন স্মৃতিস্তম্ভ। প্রজন্ম জানে না, ২৫ এপ্রিলের গুরুত্ব। দক্ষিণাঞ্চলের প্রথম প্রতিরোধ দিবসে সরকারি ভাবে এখানে পালন করা হয়নি কোন কর্মসূচী। গত কয়েক বছর স্থানীয় সংবাদকর্মীদের উদ্যোগে দিবসটি উপলক্ষ্যে কটকস্থলে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মানের দাবিতে মানববন্ধনসহ বিভিন্ন কর্মসূচী পালন করা হয়। এবছর স্বেচ্ছাসেবী এনজিও টিপিডিও এবং আইডব্লিউএফ’র উদ্যোগে একই দাবিতে মানববন্ধন কর্মসূচীর আয়োজন করা হয়েছে। ভবিষ্যত প্রজন্ম হয়তো একদিন ভুলে যাবে কটস্থলে মুক্তিযোদ্ধাদের গৌরবের ইতিহাস। তাই তিনি কটকস্থলে শহীদ চার মুক্তিযোদ্ধারা স্মৃতি রক্ষার্থে জরুরি ভিত্তিতে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মানের জন্য প্রধানমন্ত্রী ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে জোর দাবি জানিয়েছেন।