সম্পাদকীয় ॥ কেউ জানে না শাহানা বেঁচে আছেন কিনা। তবে তাকে শেষ পর্যন্ত বাঁচার স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন উদ্ধারকারীরা। তাকে উদ্ধারে টানা ১৮ ঘণ্টা চেষ্টা চালিয়েছেন তারা। সুড়ঙ্গ বেয়ে নিচে নেমেছেন। সরু জায়গায় বসে হাতে চালানো করাত দিয়ে রড কেটেছেন। হাতুড়ি দিয়ে ইট-সুরকি ভেঙেছেন। গতকাল দিনভর চলে শাহানাকে বাঁচানোর প্রাণান্ত চেষ্টা। ভবন ধসের পঞ্চম দিনে জীবিত উদ্ধারও করা হয় কয়েকজনকে। শাহানা জীবিত আছেন এমনটি নিশ্চিত হওয়ার পর ধ্বংসস্তূপ সরাতে ভারি যন্ত্রপাতি ব্যবহারে বিলম্ব করা হয়। অপেক্ষা করা হয় জীবিত এই প্রাণের স্পন্দনকে মুক্ত আলোয় ফিরিয়ে আনার। ফায়ার সার্ভিসের নিবেদিতপ্রাণ কর্মীরা ঝুঁকি নিয়ে কাজ করে একেবারে কাছাকাছি চলে গিয়েছিলেন শাহানার। তার সঙ্গে কথাও হয়। হাত মেলান। খাবার ও পানি দেয়া হয়। ফায়ার সার্ভিসের সিনিয়র কর্মকর্তা আবুল খায়েরকে ‘ভাই’ ডেকে নিজেকে বাঁচানোর আকুতি জানিয়েছিলেন শাহানা।
কুষ্টিয়ার শাহানা জানিয়েছিলেন, তার দেড় বছরের একটি ছেলে আছে। চারদিন ধরে তার ছেলেটি বুকের দুধ খেতে পারছে না। তিনি ছেলের মুখটি দেখতে চান। শাহানার আকুতি শুনে আবুল খায়ের একটি মুহূর্তের জন্য উদ্ধারস্থল থেকে সরেননি। আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়েছেন শাহানাকে বের করে আনার। রাতে তিনিসহ উদ্ধার কাছে অংশ নেয়া অন্য কর্মীরাও শাহানার সঙ্গে কথা বলেন। কয়েকটি রডের জন্য শাহানাকে বের করে আনা যাচ্ছিল না। শাহানা বের হওয়ার জন্য একবার চেষ্টাও করেছিলেন। কিন্তু শরীর আর জামা আটকে যাচ্ছিল বিমে। ভাই ডাকা সেই উদ্ধারকারী শাহানাকে গায়ের জামা খুলে ফেলতে অনুরোধ করেছিলেন। বলেছিলেন, শ্যাম্পু দিচ্ছি। গায়ে মেখে পিচ্ছিল করে বের হওয়ার চেষ্টা করুন। শাহানা অন্ধকার মৃত্যুকূপেও শরীরের জামা খুলতে চাননি। বলেছিলেন, একটু চেষ্টা করে রডগুলো কেটে নিন। ততক্ষণ তিনি অপেক্ষা করবেন। তিনি নিজেও করাত দিয়ে একটি রড কাটার চেষ্টা করছিলেন। একেবারে শেষ পর্যায়ে একজন সিভিল উদ্ধারকারী যোগদেন রড কাটার কাজে। ইলেকট্রিক করাত দিয়ে রড কাটার সময় অগ্নিস্ফুলিঙ্গে আগুন ধরে যায় গার্মেন্টের কাপড় ও কাগজপত্রে। ধীরে ধীরে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। অসহায় উদ্ধারকর্মীরা শাহানাকে ফেলে রেখেই নিজেদের প্রাণ রক্ষা করেন। ফিরে আসতে আসতে তাদের কয়েকজন অগ্নিদগ্ধ হন মারাত্মকভাবে। যে উদ্ধারকারী মেশিন দিয়ে রড কাটছিলেন তিনিও গুরুতর আহত হয়েছেন।
তাদের আহত অবস্থায় সাভার সিএমএইচে ভর্তি করা হয়েছে। রাত ১০টায় আগুন লাগার পর ফায়ার সার্ভিসের দুটি ইউনিট চেষ্টা করে আগুন নিভিয়ে ফেলে। তবে সুড়ঙ্গের ভেতর পুরোটা ধোঁয়ায় ডেকে যায়। রাতভর সেখান থেকে ধোঁয়া বের হতে থাকে। আগুন আর ধোয়ায় শাহানার বেঁচে থাকার সম্ভাবনা অনেকটাই ক্ষীণ হয়ে আসে। এ কারণেই হয়তো উদ্ধারকারীরা সুড়ঙ্গ থেকে বের হয়ে এসে কান্নায় ভেঙে পড়েন। অনেকে হাউমাউ করে কেঁদেছেন। আপনজন হারালেও হয়তো মানুষ এভাবে কাঁদে না। তাদের কান্না দেখে চোখের পানি ধরে রাখতে পারেননি উপস্থিত গণমাধ্যম কর্মীরাও। এদিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসার পর আইএসপিআরের পরিচালক শাহিনুল ইসলাম তাৎক্ষণিক ব্রিফিংয়ে কথা বলার সময় তার চোখে মুখে ছিল অব্যক্ত বেদনা আর আবেগ। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, আমরা চেষ্টা করেছি। এখানে মানবতার জয় হয়েছে।
অগ্নিকাণ্ডের পর ম্যানুয়ালি উদ্ধার তৎপরতা বন্ধ করে দেয়া হয়। শাহানার ভাগ্যে কি ঘটেছে এখনও কেউ জানে না। তবে উদ্ধারকারীরা বলছেন তার বেঁচে থাকার সম্ভাবনা খুব একটা নেই। শাহানাকে না বাঁচাতে পারলেও চেষ্টার কোন কমতি রাখেননি উদ্ধারকর্মীরা। নিজেদের জীবনের মায়া ভুলে তারা যে চেষ্টা চালিয়েছেন তা অনুসরণীয়, অনুকরণীয়। মানুষ মানুষের জন্য এই সত্যটিকে ছবির মতোই দেখিয়ে দিয়েছেন তারা। শাহানা বেঁচে থাকবেন এই কামনা এখনও কোটি মানুষের। আর যদি হেরে যান মৃত্যুর কাছে তবে বলবো, শাহানা তুমি ক্ষমা করে দিও তাদের, যারা তোমাকে বাঁচাতে লড়ে গেছেন শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত। ক্ষমা করে দিও আমাদের, আমরা যারা তোমার বাঁচার আকুতি দেখেছি টেলিভিশন পর্দায়। কিন্তু কিছুই করতে পারিনি চোখের পানি ফেলা ছাড়া।
গতকাল রাত সাড়ে ১১টার দিকে ভারি যন্ত্র ব্যবহার করে ধ্বংসস্তূপ সরানো শুরু হয়। ধ্বংসস্তূপ থেকে এ পর্যন্ত চারজনের লাশ বের করা হয়েছে। সরানো হচ্ছে ধ্বংসস্তূপ। জীবিত মানুষের সন্ধান মিলতে পারে এমন আশা নিয়ে সাবধানতার সঙ্গে চলছে ধ্বংসস্তূপ সরানোর কাজ। যারা দীর্ঘ চার থেকে পাঁচদিন ধ্বংসস্তূপের নিচে থেকে বাঁচার আকুতি জানিয়েছেন, তাদের জীবিত উদ্ধার করার কোন সম্ভাবনাও নেই আর। যদি দৈব কোন কিছু হয় তাহলে হয়তো কেউ জীবিত বের হয়ে আসতে পারেন। আমরা এখনও জীবিত প্রাণের মুখ দেখার আশায় আছি। যাদের নিথর দেহ চাপা পড়ে আছে ইট-পাথরের স্তূপে, ক্ষমা চাই তাদের কাছে। ক্ষমা চাই তাদের সন্তান আর স্বজনদের কাছে।