মুক্তি বনাম বাঁচার পথ – মামুনুর রশিদ

দেশ স্বাধীন হয়। স্বাধীন দেশে স্বাধীনভাবে বাঁচার, স্বাধীনভাবে কথা বলার, স্বাধীনতায় পথচলার স্বপ্ন, ক্ষুধা আর দারিদ্র্যকে জয় করার প্রত্যয় ছিল দেশের প্রতিটি মানুষের বুকে। কিন্তু সে প্রত্যয়, সে স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যায়। একুশ শতকের বাংলায় আজ আমাদের দেখতে হয়,

পেছনে অনেক পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধা ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে রাস্তার পাশে বসে আছে। কখন কার দয়া হবে আর একটা কয়েন অথবা দু\’টাকার ছেঁড়া-ফাটা নোট ফেলে দেবে অ্যালুমিনিয়ামের শূন্য থালায়। একদিন যে জীবন বাজি রেখেছিল, অস্ত্র হাতে ছুটে গিয়েছিল পাকসেনাদের অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে। ফেলে গিয়েছিল প্রিয়তম স্ত্রী আর প্রাণের অধিক প্রিয় আদরের সন্তানকে, অসহায় বৃদ্ধ পিতা আর জনম দুঃখিনী মাকে। মা-বাবার নিষেধ উপেক্ষা করে আরেক মায়ের সম্মান ফিরিয়ে আনার আশায় একে অপরের হাতে হাত রেখে শকুন তাড়াতে গিয়েছিল। শকুনকে শেষ পর্যন্ত রুখে দিতে পারলেও শকুনের হিংস্র থাবার আঘাতে হারিয়ে ফেলেছে হাত কিংবা পা কিংবা দুটিই। যুদ্ধ শেষ করে বিজয়ের লাল নিশান গেড়েছে স্বাধীন দেশের মাটিতে। কিন্তু সবকিছুকেই গ্রাস করেছে ভয়ঙ্কর শূন্যতা আর হাহাকার। নিস্তব্ধতা আর নির্জনতা গিয়ে মিশেছে একেবারে দিগন্তের সীমায়। বাড়িটা হয়তোবা অন্য কেউ দখল করে নিয়েছে কিংবা পুড়ে যাওয়ার স্মৃতি, রক্ত আর জলের সঙ্গে মিলেমিশে মলিন। সবকিছু হারিয়ে অনেকে সেদিন হয়েছিল সর্বহারা। জীবনের মায়া যেথায় অতি ক্ষুদ্র, সেথায় আজ বেঁচে থাকতে চাওয়াটা বড় বিলাসিতা। কিন্তু বাঁচতে তো হবে? সব গেছে তাতে কি, নিজেকে তো টিকিয়ে রাখতে হবে। শুরু হয় আরেক লড়াই, বেঁচে থাকার লড়াই। কিন্তু বাঁচার পথ কী? মুক্তির পথ আর বাঁচার পথ তো ভিন্ন। মুক্তির পথ বহু কষ্টে পেরিয়ে এসেছে, কিন্তু বাঁচার? অ্যালুমিনিয়ামের থালা। এছাড়া তো আর কোনো উপায় নেই। বাড়ি নেই, জমি নেই, বউ নেই, বাচ্চা নেই; শুধু সামনের সীমাহীন অন্ধকার। সেই অন্ধকারের পথকেই অবলম্বন করে বাঁচার চেষ্টা শুরু হয়। এলাকা থেকে অনেক দূরের রাস্তায় বসে যায় সেই থালাকেই একমাত্র সম্বল করে। যেখানে বসলে কেউ চিনতে পারবে না, জানতে পারবে না যে, সে একদিন যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছিল। জীবনযুদ্ধে টিকে থাকার লড়াই শুরু হয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার চলিল্গশ বছর পরও সে একই রাস্তায় বসে ভিক্ষা করে। কিন্তু এতদিনে হয়তো আগের সেই চেহারা এখন নেই। পঙ্গু হাত কিংবা পা শুকিয়ে শীর্ণ, অযত্ন আর অবহেলায় মাথার চুলে জটা পড়ে গেছে, চোখ কোটরাগত, রোদে পুড়ে শরীরের চামড়া হয়েছে তামাটে, মুখভর্তি পাটের আঁশের মতো সাদা দাড়ি। রাস্তার পাশে ভিক্ষার আশায় বসে থাকে আর রাজাকার গাড়ি হাঁকিয়ে ছুটে চলে। হর্ন দিয়ে চলে যায় তারই সামনে দিয়ে। হয়তো কখনওবা পথে ভিখারি ভেবে করুণা করে দু\’এক টাকা ফেলে দেয় গাড়ির কাচটা একটু ফাঁক করে। লক্ষ্যভেদ হলে ধীর পায়ে ভিখারি খুঁজে নিয়ে তুলে রাখে তার শেষ সম্বল অ্যালুমিনিয়ামের থালায়। এভাবে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর কাটে তার ভিক্ষা করে। কোনো কোনো দিন হয়তো সন্ধ্যা হলে চলে যাবে বাড়ি; কিন্তু এ দেশে তো ভিক্ষুকের ভিক্ষার থলেও নিরাপদ নয়। কোনো কোনো দিন হয়তো বখাটে ছেলেরা কিংবা নগরের ছিনতাইকারীদের পাল্লায় পড়ে। অতঃপর আগামী দিনের প্রতীক্ষায় থেকে নির্ঘুম অনাহারী রাত পার হয়ে যায় তার জীবন থেকে। কী করবে? একাকী জীবন যতদিন বিধাতা ধুঁকে ধুঁকে টিকিয়ে রাখে, ততদিন তো বাঁচতে হবে, বাঁচার চেষ্টা করতে হবে। বাঁচার সংগ্রাম করতে হবে। দেশের জন্য সংগ্রামী আর নিজের জীবনের জন্য সংগ্রাম করে চলেছে এখনও, চলবে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত।

লেখক : মামুনুর রশিদ
সূত্র: প্রিয় ডট ম