ইভিএম নিয়ে বিব্রত ইসি

বিব্রতকর অবস্থায় রয়েছে নির্বাচন কমিশিন (ইসি)। ইভিএম নিয়ে নির্বাচন কমিশন এগিয়ে যাওয়ার পক্ষপাতী। কিন্তু খোদ প্রধানমন্ত্রী ছাড়া কোনো রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজ বা সম্পাদক ও সাংবাদিকরা আগামী ১০ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইভিএম এর পক্ষ নেয়নি। সকলেই ইভিএমের পক্ষে তবে তা স্থানীয় সরকার নির্বাচনে প্রয়োগের পরে জনগণের আস্থা অর্জনের পর।

আগামী ৭ আগস্ট রোববার সরকারি দল আওয়ামী লীগের সঙ্গে নির্বাচন কমিশনের সংলাপে যদি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সুর মিলিয়ে আওয়ামী লীগের নেতারা ইভিএমের পক্ষে অবস্থান নেন তাহলে একমাত্র দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে হয়তো ১০ম সংসদ নির্বাচনে ইভিএমের পক্ষে পাওয়া যেতে পারে। উল্টো হলে কেউকেই হয়তো পাওয়া যাবেনা ইভিএমের পক্ষে। বিষয়টি নিয়ে বেশ বিব্রতকর অবস্থায় রয়েছে ইসি।

প্রধান নির্বাচন কমিশনার ড. এটি এম শামসুল হুদার যুক্তি, সার্কভুক্ত দেশসমূহের মধ্যে শুধু বাংলাদেশ ও পাকিস্তান বাদে আর সব দেশেই নির্বাচনে কাগজের ব্যালট ব্যবহারের পরিবর্তে ইভিএমএর মাধ্যমে ইলেকট্রনিক ব্যালট ব্যবহার শুরু হয়েছে। পাকিস্তানও তাদের আগামী সংসদ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করতে চায় এবং সে লক্ষ্যে তারা কিছু কাল পূর্বে ঐ মেশিন সংগ্রহের জন্য আন্তর্জাতিক দরপত্রও আহ্বান করেছে।

ইভিএমের প্রোটোটাইপ উদ্ভাবনের জন্য ২০০৯ সালে ইসি বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনষ্টিটিউট অফ ইনফরমেশন এন্ড কমিউনিকেশন টেকনোলজির পরিচালক অধ্যাপক এস এম লুৎফুল কবিরকে অনুরোধ করে। কিছুদিন পর তিনি একটি মডেল ইসির সামনে উপস্থাপন করেন এবং এটির পরিচালনা সংক্রান্ত খুঁটিনাটি মেশিনটি চালিয়ে দেখান।

কমিশন ও অন্যান্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মতামত গ্রহণ করে এটিকে আরও উন্নত করা হয় এবং এই উন্নত সংস্করণে ১০০টি মেশিন তৈরি করে কমিশন ২০১০ সালে অনুষ্ঠিত চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে একটি ওয়ার্ডে এটি সাফল্যের সঙ্গে ব্যবহার করে। কোনো রকম বিতর্ক ছাড়া ভোট শেষ হওয়ার আধা ঘন্টার মধ্যে ওয়ার্ডের ফলাফল ঘোষণা করা সম্ভব হয়। তারপরও আগামী ১০ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের পক্ষে মতামত দিচ্ছেন না কেউ।

নির্বাচন কমিশনের মতে, ১০ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পূর্বে অনুষ্ঠিতব্য সকল পর্যায়ের স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোতে ইভিএম পদ্বতি ব্যবহার শুরু করা হবে। পর্যায়ক্রমে ইভিএম ব্যবহার বিস্তৃত করা হবে। এর জন্য গনসচেতনতা গড়ে তোলার লক্ষ্যে ব্যাপক প্রচার প্রচারনার কাজও হাতে নিবে নির্বাচন কমিশন।

ইসির মতে, নারায়ণগঞ্জ এবং কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করা হবে। এরমধ্যে যদি ঢাকা সিটি কর্পোরেশন (ডিসিসি) নির্বাচন করা যায় সেখানেও তা ব্যবহার করা হবে। এরপর ২০১৪ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তা ব্যবহৃত হবে।

এ লক্ষ্যকে সামনে রেখে আপাতত অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ৭শ’ ইভিএম তৈরির সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইসি। এছাড়া ৪১ হাজারের বেশি কেন্দ্রকে মাথায় রেখে আড়াই লক্ষাধিক ইভিএম তৈরির প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছে নির্বাচন কমিশন।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৪ সালের নির্বাচন ইভিএমে হবে এমন ঘোষণা দিলে এর বিরোধিতা করে প্রধান বিরোধী দল বিএনপিসহ অধিকাংশ রাজনৈতিক দল। এ অবস্থায় বিব্রতকর পরিস্থিতে পড়ে নির্বাচন কমিশন। নিজেদের অবস্থান সম্পর্কে সবাইকে সম্মক ধারণা দিতে ইসি আয়োজন করে রাজনৈতিক সংলাপ। সংলাপে আমন্ত্রণ জানানো হয় নিবন্ধিত ৩৮ রাজনৈতিক দলকে। আলাদা ভাবে আয়োজিত এ সংলাপের শেষটি অনুষ্ঠিত হবে ৭ আগস্ট ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সঙ্গে। বিএনপি, জামাত, বিজেপি ও ইসলামী ঐক্যজোট ইসির সংলাপকে প্রসহনমূলক আখ্যা দিয়ে তা বর্জন করেছে।
সংলাপে অংশ নেয়া বেশির ভাগ রাজনৈতিক দল ইভিএমকে যুগোপযোগি বললেও এখনই জাতীয় নির্বাচনে এর ব্যবহারের বিরোধিতা করে। তাদের মতে, এ পদ্ধতিটি সবার আগে ব্যবহার করতে হবে সকল প্রকার স্থানীয় নির্বাচনে। এ মেশিন সম্পর্কে জনমনের সংশয় দূর হলে পরে তা জাতীয় নির্বাচনে ব্যবহারের পরামর্শ দেন তারা।

অনেক রাজনৈতিক দলই ইভিএম নিয়ে জটিলতার জন্য সরকারি দল আওয়ামী লীগের বাড়াবাড়িকেই দায়ী করেন। তাদের মতে, এতে জনমনে সংশয় দেখা দিয়েছে। তাই আগে স্থানীয় নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করতে হবে।

কেবল রাজনৈতিক দলই নয়, ইভিএম নিয়ে গণমাধ্যমের সম্পাদক ও সিনিয়র সাংবাদিকদের মতামত নিয়েছে ইসি। গণমাধ্যম ব্যক্তিত্বরা তথ্য প্রযুক্তির এ যুগে প্রযুক্তিকে পাশ কাটানো যাবেনা বলে উল্লেখ করে ইভিএমের পক্ষে মত দেন। তবে সেজন্য নির্বাচন কমিশনকে ধীরে চলার পরামর্শ দেন তারা। ২৪ জুলাইয়ের ওই সংলাপে  সংবাদপত্র ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সম্পাদকরা বলেন, দশম সংসদ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করতে হবে, নির্বাচন কমিশনের এজন্য যুদ্ধ ঘোষণার প্রয়োজন  নেই।
গণমাধ্যমের প্রতিনিধিরা ইসিকে বলেন, আধুনিক প্রযুক্তির ইভিএম ব্যবহারের জন্য জনগণকে আস্থায় নিতে হবে সবার আগে। জনগণকে আস্থায় আনা গেলে এর ব্যবহার কেউই ঠেকাতে পারবে না ।
ভোট কর্মকর্তার পক্ষপাতিত্ব, ভোট কেন্দ্র দখল, ভোট জালিয়াতির চলমান সংস্কৃতিতে ইভিএমের আরো বেশি নিরাপত্তা নিশ্চিত করার কথা বলেন তারা। এক্ষেত্রে ভোটার ও প্রার্থীদের মানসিকতা পরিবর্তনের পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থায় কঠোর মনোভাব দেখাতেও ইসিকে পরামর্শ দেন গণমাধ্যম ব্যক্তিত্বরা।  

প্রধান নির্বাচন কমিশনার ড. এটি এম শামসুল হুদা বলেছেন, আমরা কোনো স্টেজে, কখনো বলিনি ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচন হবে ইভিএমের মাধ্যমে। এটা বলেছেন প্রধানমন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় এবং ও ইসি দুইটি সম্পূর্ণ আলাদা প্রতিষ্ঠান। আমরা প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরেরও কেউ নই। আমরা তার অধীনে চাকরিও করিনা। আমরা স্বাধীন প্রতিষ্ঠান হিসেবে নিজেদের কর্মপরিকল্পনা মতো এগোচ্ছি। বরং এই প্রযুক্তির একটি কর্মপরিকল্পনা রেখে যাচ্ছি যা পরবর্তী কমিশন এসে বাস্তবায়ন করবে। তিনি বলেন, সার্কভুক্ত সকল দেশই এ পদ্ধতি গ্রহণ করেছে। তাই আমরাও পিছিয়ে থাকতে চাইনা।

ইসি সূত্রে জানা গেছে, বর্তমান নির্বাচন কমিশনারদের মেয়াদ শেষ হবে ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারিতে। তারা চায় এর আগেই ইভিএমের সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করতে। পরবর্তী কমিশন এটা ব্যবহার করুক কিংবা না করুক সিদ্ধান্ত নেবে নতুন কমিশনই।

বিটিআরসির সাবেক চেয়ারম্যান মার্গুব মোর্শেদ বলেন, দেশে এখনো ইভিএম চালু করার পরিবেশ সৃষ্টি হয়নি। জনসচেতনতা বৃদ্ধি না করে প্রযুক্তিগত অপব্যবহার রোধ করা সম্ভব নয়। যেনো তেনো ভাবে প্রশিক্ষন দিয়ে মাঠ পর্যায়ে ইভিএম ছেড়ে দিলে ফলাফলে বিপর্যয় ঘটবে, দেশে নৈরাজ্য সৃষ্টি হবে, হানাহানিÑমারামারি বৃদ্ধি পাবে। জন গণনার মতো দেশে বিদেশে ফলাফল প্রশ্নবিদ্ধ হবে।