লালমোহনে গেজেট প্রকাশ না হওয়ায় নির্বাচিত ইউপি সদস্যরা উপেক্ষিত

শাহীন হাসান, বরিশাল ॥ ভোলার লালমোহন উপজেলার ফরাজগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণা ও নির্বাচিতদের গেজেট প্রকাশিত না হওয়ায় অনিয়মের মধ্যে দিয়ে চলছে ইউনিয়নের সব ধরণের কার্যক্রম। নবনির্বাচিত ইউপি সদস্যরা দায়িত্ব না পাওয়ায় পুরাতন ইউপি সদস্যদের কাছ থেকে স্বাক্ষার নিয়ে এলকায় বিজিডি ও বিজিএফ বিতরণ করছে সরকার দলীয় ক্যাডাররা। ফলে জনগনের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা ক্যাডারদের কাছে উপেক্ষিত হচ্ছে। ঘরে বসেই চেয়ারম্যান আবুল বাশার সেলিম ভাগ বাটোয়ারায় অংশ নিচ্ছেন বলে ক্ষুব্দ স্থানীয়রা। অপরদিকে ফরাজগঞ্জ ইউনিয়নে ইউপি চেয়ারম্যান পদে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্ধিতাকারী ফরহাদ হোসেন মুরাদ ঈদ-উল ফিতরের পূর্বে বিজিএফ এর সাড়ে চার টন চাল গুদাম থেকেই বিক্রি করে ফেলেছেন বলে অভিযোগ করেছেন নবনির্বাচিত ইউপি সদস্যদের অনেকে। এলাকাবাসী জানান, ফরাজগঞ্জ ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি অনিচল হক বিজিএফ এর দুই বস্থা চাল লুট করে তার ছেলের শশুর নাছিরের বাড়িতে পৌঁছাতে চাইলে ১নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক নূরে আলম জনতাকে সামনে রেখে তা আটক করে। পরে ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ নেতা ও ইউপি সদস্য ফয়েজুল্যাহ খোকনের মধ্যস্ততায় সে চাল আনিচল হককে ফিরিয়ে দেয়া হয়। স্থানীয় অনেকেই অভিযোগ করে বলেন, নবনির্বাচিত ইউপি সদস্যরা দায়িত্ব পালন করতে না পারার কারণে লালমোহন উপজেলার এ ইউনিয়নে যে যার মতো করে লুটপাট চালিয়ে যাচ্ছে। সরকারী চাল বিতরণে পুরাতন ইউপি সদস্যদের বাইরে যারা দায়িত্ব পালন করছেন তারা স্থানীয় সংসদ সদস্য নূরুন্নবী চৌধুরী শাওনের পক্ষে থেকে দায়িত্ব পেয়েছেন বলে দাবী করছেন।     

 স্থানীয়রা জানিয়েছেন, জনগনের নির্বাচিত প্রতিনিধিদেরকে সেবার কাজের বাইরে রাখায় সরকারী দান-অনুদান ও সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে এলাকার প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্থরা। দরিদ্র মানুষের জন্য বরাদ্দকৃত খয়রাতি চালসহ ইউনিয়ন পরিষদ হতদরিদ্র জনগোষ্ঠির জন্য দেয়া সব কিছু বণ্টনের দায়িত্ব নিচ্ছে সরকার দলীয় ক্যাডাররা। ফলে যেকোনো সময় এলাকার নবনির্বাচিত প্রতিনিধি, পুরাতন ইউপি সদস্য ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ যুবলীগ নেতাকর্মীদের মধ্যে ত্রিমূখী দ্বন্ধ সৃষ্টি হতে পারে বলে মনে করছে এলাকাবাসী।

সরকারের পক্ষ থেকে দেয়া বরাদ্দ ও সুবিধা বঞ্চিতরা জানিয়েছেন, বিজিডি-ভিজিএফ পাওয়ার জন্য নবনির্বাচিত ইউপি সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলে আমাদেরকে দায়িত্ব বুঝিয়ে দেয়া হয়নি বলেন এড়িয়ে যান। আবার পুরাতন ইউপি সদস্যদের কাছে গেলে তারা বলেন, বিজিএফ এর চাল পেতে হলে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের  সঙ্গে দেখা করেন। দরিদ্র সাধারণ মানুষ চেয়ারম্যানের দুয়ারে গেলে চেয়ারম্যান মেম্বারের দুয়ারে পাঠায়। আবার মেম্বার পাঠায় নেতাদের কাছে। এভাবে এক দুয়ার থেকে অন্য দুয়ারে যাওয়া আসার ফাঁকে বরাদ্দ চলে যায় চেয়ারম্যান, মেম্বার ও নেতাদের ঘরে।

খবর নিয়ে জানা গেছে, চলতি বছরের মার্চ মাসের ৩১ তারিখে ভোলার লালমোহন উপজেলার ফরাজগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।  ঐ নির্বাচনে ৯টি কেন্দ্রের মধ্যে সকল কেন্দ্রেগুলোতে সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন সম্পন্ন হয়। নির্বাচনের সময় পার হওয়ার পর ভোট গণনা শেষে ইউপি চেয়ারম্যান পদ প্রার্থী ফরহাদ হোসেন মুরাদ তার নিজ বাড়ির এলাকার কেন্দ্রে ভোট গ্রহণের অনিয়মের অভিযোগ এনে ৩টি কেন্দ্র নতুন নির্বাচন দাবী করে। যা বর্তমানে মিমাংশার অপেক্ষায় রয়েছে। আইনি এসব জটিলতার কারণে নির্বাচিত হয়েও নবনির্বাচিত ইউপি সদস্যরা ইউনিয়ন পরিষদের কাজে অংশ নিতে পারছে না নির্বাচিত এসব ইউপি সদস্যরা।

চলতি  বছরের ৩১ মার্চ নির্বাচন শেষ হওয়ার পর উক্ত ইউনিয়নের ৭নং ওয়ার্ড ছাড়া অন্য সব ওয়ার্ডে ইউপি সদস্যদেরকে প্রিজাইডং অফিসার ও রিটার্নিং অফিসার কর্তৃক নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণা ও হস্তান্তর করা হয়েছে। কিন্তু এসব ওয়ার্ডে নির্বাচিতদের গেজেট প্রকাশিত না হওয়ায় তারা দায়িত্ব পালন করতে পারছেন না।

প্রিজাইডং অফিসার ও রিটার্নিং অফিসার কর্তৃক নির্বাচনের ফলাফল প্রাপ্ত ইউপি সদস্যরা পৃথক পৃথকভাবে ২০১১ সালের ২৭জুন ইউপি সদস্য হিসেবে গেজেট পাওয়ার জন্য প্রধান নির্বাচন কমিশনারের বরাবর আবেদন করেন। যার এখনো কোনো সুরাহ হয়নি। এসব জটিলতা নিরসনে নির্বাচন কমিশনের ধীরগতির কারণে এলাকায় নতুন-পুরাতন ইউপি সদস্য ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ নেতাদের মধ্যে দ্বন্ধ সৃষ্টি হচ্ছে।
এ ব্যাপারে লালমোহন উপজেলার ফরাজগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবুল বশার সেলিম জানান, সরকার সমর্থিত প্রার্থী না হওয়ায় নির্বাচন চলাকালে আমাকে জনগনের কাছে ভোট চাইতে দেয়া হয়নি। এর পরও প্রায় ৮ বছর পূর্ব থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালনে অনিয়ম ও দুর্নীতি না করায় এলাকাবাসী আমাকে আবারও নির্বাচিত করেছে। ৯টি কেন্দ্রের মধ্যে ফলাফল প্রাপ্ত ৮ কেন্দ্রে আমার নিকটতম প্রতিদ্বন্ধি ফয়জুল্যাহ খোকন এর কাছ থেকে আমি ৮১৪ ভোট বেশি পেয়েছি। যে ফলাফল আমার জেলাসহ দেশের দক্ষিণাঞ্চলে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। নির্বাচন কমিশন কেন ফলাফল ঘোষণা করছেন না তা আমার বোধগম্য নয়।

অনিয়মের ব্যপারে জানতে চাইলে আবুল বশার সেলিম বলেন, চেয়ারম্যান হিসেবে এসব চাল বিতরণের দায়িত্ব আমার হলেও স্থানীয় সংসদ সদস্য নুরুন্নবী চৌধুরী শাওনের সমর্থিত চেয়ারম্যান প্রার্থী ও বর্তমান ইউপি সদস্য ফরহাদ হোসেন মুরাদ এসব চাল বিতরনের দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি বলেন, পবিত্র ঈদ-উল-ফিতরের পূর্বে ফরাজগঞ্জ ইউনিয়নের ১৫শ ৫৬ জনকে ১০ কেজি করে চাল বরাদ্দ দেয়া হয়। এর মধ্যে পুরাতন (বর্তমান) ইউপি সদস্যদেরকে ৬শ লোকের নাম দেয়ার দায়িত্ব দিয়ে  বাকী ৯শ ৫৬ জনের দায়িত্ব নেয় স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও যুবলীগ  নেতারা। চেয়ারম্যান হিসেবে ঘরে বসে ভাগ বাটোয়ারায় অংশ নেয়ার কথা অস্বীকার করে আবুল বাশার সেলিম জানান, বর্তমান সরকারের আমলে আমি সব চাইতে বেশি নির্যাতিত হয়েছি। ফরাজগঞ্জ ইউনিয়নের বিজিডি-বিজিএফ বিতরণের দায়িত্ব আমার নয়। এ অবস্থায় আমার ব্যপারে অভিযোগ করা হস্যকর ব্যপার।

এদিকে ফরাজগঞ্জ ইউনিয়নের নবনির্বাচিত ইউপি সদস্যরা এলাকায় দায়িত্ব পালন ও নির্বাচিত হিসেবে তাদের গেজেট প্রকাশে স্থানীয় সংসদ সদস্য নূরুন্নবী চৌধুরী শাওনের সঙ্গে চলতি বছরের ১২ সেপ্টেম্বও ঢাকায় দেখা করতে এলে সংসদ সদস্য শাওন তাদের সহযোগিতার আশ্বাস দেন। তাছাড়া এলাকায় বিজিএফ লুটপাটকারীদের কয়েকজনকে  এমপির পক্ষ থেকে মোবাইল ফোনে সতর্ক করা হয় বলেও একটি সূত্র জানিয়েছে। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, ইউনিয়নের ১নং ওয়ার্ডের নবনির্বাচিত ইউপি সদস্য হচ্ছে মো. আবদুর রশিদ। পুরাতন সদস্য হচ্ছে ফয়েজুল্যাহ খোকন। আর এই ওয়ার্ডের রিলিপ বিতরণের দায়িত্ব পালন করেন ফয়েজুল্যাহ খোকন ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ সাংগঠনিক সম্পাদক আবুল বাশার। ২নং ওয়ার্ডের নবনির্বাচিত ইউপি সদস্য হচ্ছে মো. নুরুল আলম। পুরাতন সদস্য হচ্ছে আবদুস শহিদ। আর এই ওয়ার্ডের রিলিপ বিতরণের দায়িত্ব পালন করেন স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও যুবলীগ নেতারা। ইউনিয়নের ৩নং ওয়ার্ডের নবনির্বাচিত ইউপি সদস্য হচ্ছে বাবুল ফরাজী। পুরাতন সদস্য হচ্ছে নুরুল ইসলাম। আর এই ওয়ার্ডের রিলিপ বিতরণের দায়িত্ব পালন করেন ঐ ওয়ার্ডের মহিলা মেম্বারের স্বামী ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও যুবলীগ নেতা, ছাত্রলীগ নেতারা। ইউনিয়নের ৪নং ওয়ার্ডের নবনির্বাচিত ইউপি সদস্য হচ্ছে ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ নেতা বজলুর রহমান। পুরাতন সদস্য হচ্ছে মনিরুল হক মিঠু। আর এই ওয়ার্ডের রিলিপ বিতরণের দায়িত্ব পালন করেন ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ সভাপতি ওয়ালী উল্যাহসহ স্থানীয় নেতারা। ইউনিয়নের ৫নং ওয়ার্ডের নবনির্বাচিত ইউপি সদস্য হচ্ছে মো. সালাউদ্দিন শামিম। পুরাতন সদস্য হচ্ছে মরহুম নাসির আহম্মেদ। আর এই ওয়ার্ডের রিলিপ বিতরণের দায়িত্ব পালন করেন ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ নেতা ও বর্তমান ইউপি সদস্যের পিতা আনিসুল হক। ইউনিয়নের ৬নং ওয়ার্ডের নবনির্বাচিত ইউপি সদস্য হচ্ছে মো. বিল্লাল হোসেন। পুরাতন সদস্য হচ্ছে দেলোয়ার হোসেন। আর এই ওয়ার্ডের রিলিপ বিতরণের নেতৃত্ব দেন বর্তমান ইউপি সদস্যেও বড় ভাই কামাল, নুরুন্নবীসহ স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও যুবলীগ নেতারা। ইউনিয়নের ৭নং ওয়ার্ডের ৩১ মার্চ নির্বাচনে ফলাফলে এগিয়ে রয়েছে (প্রিজাইডিং অফিসার কর্তৃক ফলাফল স্থগিত) ইয়াছিন। পুরাতন সদস্য হচ্ছে ফরহাদ হোসেন মুরাদ। এই ওয়ার্ডের সব কিছুই নিয়ন্ত্রয় হয় মুরাদ মুরাদের ইশারায়। ইউনিয়নের ৮নং ওয়ার্ডের নবনির্বাচিত ইউপি সদস্য হচ্ছে মো. নাসিম। পুরাতন সদস্য হচ্ছে মোস্তাফা। আর এই ওয়ার্ডের রিলিপ বিতরণের দায়িত্ব পালন করেন ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ সভাপতি নুর হোসেনসহ স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও যুবলীগ নেতারা।  

ইউনিয়নের ৯নং ওয়ার্ডের নবনির্বাচিত ইউপি সদস্য হচ্ছে আবদুল হাই। পুরাতন সদস্য হচ্ছে রুহুল আমীন। রুহুল আমীন মেম্বার আওয়ামী লীগ সমর্থিত হওয়ায় ওয়ার্ডের রিলিপ ভাগ বাটাওয়ারা করেন মেম্বার নিজেই। আর এই ওয়ার্ডের রিলিপ বিতরণের দায়িত্ব পালন করেন ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ সভাপতি নুর হোসেনসহ স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও যুবলীগ নেতারা।