৮ টি বিভাগে ঘুষ দিতে দিতে রোগীরা দিশেহারা – বছরে প্রায় ২৬ লাখ চলে যায় ঘুষ খোরদের পকেটে

শাহীন হাসান, বরিশালঃ শেবাচিম হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা পেতে রোগীদেরকে বিভিন্ন বিভাগে নির্ধারিত ফি’র বাইরে প্রায় তিন গুন ঘুষ গুনতে হয়। সংশ্লিষ্টরা উপরি কামাইয়ে রাতারাতি ধনকুবের হচ্ছে। সরেজমিনসূত্রে, রোগীকে চিকিৎসাসেবা পেতে কমপক্ষে প্রতিষ্ঠানটির ৮ টি দপ্তরে যেতে হয়। এসুযোগে বছরে প্রায় ২৫ লাখ ৫৬ হাজার টাকা বিভিন্নভাবে রোগীর পকেট থেকে হাতিয়ে নেয় নেপথ্যে থাকা সংশ্লিষ্ট কতিপয় কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং এমএলএসএস রা। প্রতিষ্ঠানটির অফিস তথ্যমতে, রোগীদেরকে প্রায় ৬০ শতাংশ ফি পরিশোধ করতে হয় চিকিৎসাসেবা পেতে। জরুরী বিভাগের ভর্তি ফি থেকে শুরু করে, ট্রলিম্যান, লিফটম্যান, ওয়ার্ডে সিট বাণিজ্য, প্যাথলজি এবং এক্সরে, ওটি বিভাগ, সিটিস্ক্যান, এমআরআই, ক্লোনস্কপি বিভাগসহ রোগীদেরকে ফি’র বাইরে প্রায় তিন গুন ঘুষ দিতে হয়।

সরেজমিনসূত্রে, প্রতিষ্ঠানটিতে দীর্ঘদিন চলমান অর্থনৈতিক দুনীর্তিতে ক্ষতিগ্রস্থ রোগীরা কিন্তু নেই কোন পরিবর্তন কিংবা প্রশাসনিক ফলপ্রসু পদক্ষেপ। জরুরী বিভাগ ভর্তি রেজিস্টারসূত্রে, প্রতিদিন গড়ে ২শ রোগী ভর্তি হয়। কর্তব্যরত ব্রাদাররা সিন্ডিকেট করে ভর্তির সময় সরাসরি রোগীদের পকেট থেকে দৈনিক ৩ হাজার এবং বছরে ১০ লাখ ৮০ হাজার টাকা হাতিয়ে নেয় এভাবে, ভর্তি টিকেট ছোট ১০ টাকা, রোগী কল্যান সমিতির ১ টাকা এবং বড় টিকেট ১৫ টাকাসহ মোট ২৬ টাকা। দৈনিক ২ শ রোগীর প্রায় ৬০ জন রোগী বিভিন্ন পরিচিতি, অজ্ঞাত, দুস্থ:সহ ফ্রি ১০ জন এবং আরো ৩০ জন রোগীর ভর্তি সম্পর্কে অভিজ্ঞতা থাকায় সংশ্লিষ্টরা নির্ধারিত ফি রাখতে বাধ্য হয়। কিন্তু বাকী ১ শ জন রোগী বিভিন্ন জেলা-উপজেলার হওয়াতে তাদের কাছ থেকে সরকার নির্ধারিত ফি ২৬ টাকার পরিবর্তে বাড়তি ৩০ থেকে ৪০ টাকা হাতিয়ে নেয় তারা। ট্রলিম্যানরাও উপড়ি ইনকামে বেপরোয়া, অবসরে যাওয়ার পরও নিয়মিতই ডিউটি করছে অবসরপ্রাপ্ত ট্রলিম্যানরা, মূল কারণ রোগী টেনে দৈনিক নগদ উপড়ি কামাই। ভর্তিকৃতদের মধ্যে ১ শ ২০ জন রোগী স্বজনরদের সহযোগীতায় হেটে, আড় কোলে চড়ে, বাকী ৮০ জন রোগীকে বাধ্য হয়ে ট্রলিতেই বিভিন্ন ওয়ার্ডে এবং কেবিনে যেতে হয়। এসুযোগে ওয়ার্ডে পৌছামাত্রই ট্রলিম্যানরা জন প্রতি রোগীর কাছ থেকে ২০/৩০ টাকা হাতিয়ে নেয়। এভাবে ৮০ জনের কাছ থেকে দৈনিক ১ হাজার ৬ শ এবং বছরে ৫ লাখ ৭৬ হাজার টাকা হাতিয়ে নেয় ট্রলিম্যানরা। নিয়মিত ৩/৪ টি ট্রলি জরুরী বিভাগ থেকে রোগী নিয়ে ওর্য়াডগুলোতে যাওয়া আসা করে। থেমে নেই লিফটম্যানরাও। প্রতিদিন লিফট অপারেটররা রোগী ও ভিজিটরদের কাছ থেকে ২ শ ৫০ টাকা এবং বছরে ৯০ হাজার টাকা হাতিয়ে নেয়। প্রতিষ্ঠানটির অফিস সূত্রে জানা যায়, দৈনিক প্রায় রোগী ও ভিজিটর মিলিয়ে ৮শ জন বিভিন্ন কেবিন এবং ওয়ার্ডে যায়। ১০ টি লিফট  থাকলেও দিনে রাতে চালূ থাকা ৫/৭ টা লিফটে প্রায় ৪ শ ভিজিটর এবং রোগী উঠা-নামা করে।

সরেজমিন সূত্রে আরো দেখা যায়, এদের মধ্যে ২ শ জন শহুরে ও স্থানীয় হওয়াতে লিফটম্যানরা টাকা নিতে সাহস করেনা। আরো ১ শ জন বিভিন্ন পরিচিতিতে, ১৫ জন গরীব বৃদ্ধ-বৃদ্ধা হওয়াতে লিফটে টাকা না দিয়ে উঠা-নামা করে এবং পরিবেশ পরিস্থিতি অনুকুলে না থাকায় ৫০ জন টাকা না দিয়ে রেহাই পায়। কিন্তু বাকী ৫০ শ জনকে অবশ্যই লিফট অপারেটরদেরকে জন প্রতি ৫ টাকা করে দিতে হয়। টাকা দিতে না চাইলে নামিয়েও দেয়া হয়। শেবাচিম হাসপাতালের প্যাথলজি এবং এক্স-রে বিভাগে কর্মচারীদের রির্পোট বাণিজ্যর উপরি কামাই চলছে হরদম। প্রতিদিন গড়ে প্রায় ১ হাজার ২ শ, মাসে ৩ হাজার ৬ শ এবং বছরে প্রায় ৪ লাখ ৩২ হাজার টাকা হাতিয়ে নেয়া হয়। প্রতিষ্ঠানটির ভর্তি রেজিষ্ট্রার সূত্রে দৈনিক গড়ে ২শ রোগী ভর্তি হয়। সরেজমিন পর্যবেক্ষণে, ৪০ জন রোগী কোন প্রকার টেস্ট বা এক্সরে ছাড়াই সুস্থ্য হয়ে ওঠে। আরো ৬০ জনকে বাহিরের ক্লিনিকে যেতে হয় ডাক্তারদের নির্দেশে এবং হাসপাতালের নিম্নমানের জন্য। কিন্তু প্রায় ৯০ জন রোগীকে বিভিন্নধরণের টেষ্ট করাতে রক্ত পরিসঞ্চালন এবং এক্সরে বিভাগে যেতে হয়। এরমধ্যে ৪০ জন রোগী শহুরে, সচেতন এবং বিভিন্ন পরিচিতিতে নির্ধারিত ফি দিয়েই টেষ্ট করাতে সক্ষম হয় এবং ১০ জন দুস্থ্য ও গরীব রোগী থাকায় ফ্রি করতে হয়।  কিন্তু ঝোপ বুঝে কোপ মারার পদ্ধতিতে তারা অন্তত গড়ে ৪০ জন রোগীর কাছ থেকে প্রায় প্রতি টেষ্টে এবং এক্সরেতে ৩০/৫০ টাকা বেশি নেয় সরকার নির্ধারিত ফি’র বাইরে। এদিকে শেবাচিম হাসপাতালে বেড বাণিজ্য আরো বেপরোয়া। প্রতিদিন প্রায় ২০ জন রোগীর কাছ থেকে ৮ শ টাকা, মাসে ২৪ হাজার এবং বছরে ২ লাখ ৮৮ হাজার টাকা বেড বাণিজ্যের করে সরাসরি রোগীদের পকেট থেকে হাতিয়ে নিচ্ছে কন্টাক্ট সার্ভিসের আয়া-বুয়া, ওয়ার্ড বয় এবং অণ্যান্যরা। রোগী নিয়ে ওয়ার্ডগুলোতে যাওয়া মাত্র রোগী ও স্বজনদেরকে আড়ালে ডেকে নিয়ে ঐ আয়া-বুয়ারা বলে ৪০/৫০ টাকা দিলে বেড পাবেন। ভর্তি রেজিস্টারসূত্রে, ভর্তিকৃত গড়ে ২শ জন রোগীর মধ্যে মাত্র ৫০ জন কেবিনে ১ শ জন নিয়মমতো বেড পায়। ৩০ জন রাজনৈতিক এবং পেশাগত ও আত্মীয়তার পরিচয়ে বেড বাগিয়ে নেয়। বাকি ২০ জন রোগীকে প্রতিদিন আয়া-বুয়াদের ঘুষ দিয়ে সরকারি বেড কিনে তবেই হাসপাতালে থাকতে হয়। দৈনিক ৩০ টির বেশি মেজর এবং মাইনর অপারেশন করা হয় শেবাচিমে। নূন্যতম ওটি চার্জ ৪শ টাকা। ওটি নার্স ব্রাদার আর এমএলএসএসরা বকশিসের চুক্তি করে বলে স্পেশাল খেয়াল দিয়ে ওটি করা হবে তবে ৪শ টাকার পরিবর্তে ১ হাজার টাকা কিংবা আরও বেশি দিতে হয়। এরমধ্যে অজ্ঞাত এবং দুস্থ্য ও বিভিন্ন রাজনৈতিক এবং স্টাফদের পরিচিতির প্রায় ১৫ জন রোগীর ওটি থাকে। কিন্তু বাকি ১৫ জন রোগীকে অবশ্যই ৫শ টাকা ঘুষ দিয়ে ওটি করাতে হয়। এভাবে দৈনিক ৭ হাজার ৫শ এবং মাসে ৯০ হাজার টাকা হাতিয়ে নেয় তারা।  নয়তো ডাক্তার নেই, এখানে ভালো হবেনা এর চেয়ে বাইরের ক্লিনিকে অপারেশন করান এভাবে মিথ্যা বলে রোগীদেরকে ফেরত দেয়া হয়। যদি সংশ্লিষ্টদেরকে বাড়তি টাকা দেয়া হয় তাহলে সহসাই ওটি করানো যায়। শেবাচিম পরিচালক এ ব্যাপারে বলেন, আমি বিষয়টি নিয়ে ইচ্ছা থাকা সত্বেও কোন স্থায়ী এবং কঠোর পদক্ষেপ নিতে পারছিনা। কারণ ঘুষের অভিযোগের কোন লিখিত অভিযোগ পাইনা আর লিখিত অভিযোগ না পেলে মৌখিক অভিযোগের ভিত্তিতে কোন অফিসিয়াল পদক্ষেপ নেয়া সম্ভব হচ্ছেনা। তাহলে কি এভাবে কি অর্থনৈতিক দুনীর্তি চলবে এর কোন সদুত্তর মেলেনি।