কাজী গোলাম মাহবুব (১৯২৭-২০০৬)

গৌরনদী ডটকম ॥ ১৯৫২ সালের সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক কাজী গোলাম মাহবুব ১৯২৭ সালের ২৩ ডিসেম্বর তৎকালীন বাকেরগঞ্জ জেলার গৌরনদী থানার কসবা গ্রামে এক ঐতিহ্যবাহী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম কাজী আব্দুল মজিদ ও মাতার নাম আছিয়া কাজী গোলাম মাহবুবখাতুন। তিনি ১৯৪২ সালে টরকী বন্দর হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিক, ১৯৪৪ সালে কলকাতার ইসলামিয়া কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট এবং ১৯৪৫ সালে বিএ পাশ করেন। ১৯৫১ সালে ঢাকা বিশ্বদ্যিালয় থেকে এলএলবি ডিগ্রি লাভ করেন।

১৯৪২ সাল থেকেই তিনি ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের একজন সক্রিয় কর্মী হিসেবে রাজনীতিতে সক্রিয় হন। ১৯৪৬ সালেতিনি কলকাতা ইসলামিয়া কলেজ ছাত্র সংসদের ভিপি নির্বাচিত হন। ইসলামিয়া কলেজের ছাত্র থাকা অবস্থায় তিনি ছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। ১৯৪৭ সালে তিনি ১৫০ নং মোগলটুলীর ওয়ার্কস ক্যাম্পে যোগদান করেন। তৎকালীন পূর্ব পাকিসত্মান মুসলিম ছাত্রলীগ, আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠাকালীন সময় থেকেই তিনিএ দলের সাথে জড়িত ছিলেন।

১৯৫৩ সালে বৃহত্তর বরিশালের আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, ১৯৪৯ সাল থেকে ১৯৫৮ সাল পর্যনত্ম তিনি ছিলেন প্রাদেশিক আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির অন্যতম সদস্য এবং ১৯৫৫ সালে এবং ১৯৫৭ সালে তিনি আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য ছিলেন। তিনি প্রত্যক্ষ ভূমিকা রাখেন স্বাধীকার ও স্বাধীনতা সংগ্রামে। পরবর্তীকালে তিনি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলে যোগদান করেন এবং কেন্দ্রীয় কমিটির ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। পেশাগত জীবনে তিনি ছিলেন রাজনীতিবিদ ও আইনজীবী।

১৯৫৩ সাল থেকে আইন পেশায় নিযুক্ত হন। ১৯৯৩ সালে তিনি সুপ্রিমকোর্ট বার এসোসিয়েশনের সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৯৪ সালে হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি নিয়োগের ব্যাপারে বারের সভাপতি হিসেবে আইনজীবীদের স্বার্থ সংরক্ষণ ও দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় তিনি ব্যক্তি স্বার্থ তুচ্ছ করে নিজ দলের বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে যে ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেছিলেন তা বাংলাদেশের ইতিহাসে চিরদিন এক অনন্য সম্মান ও মহৎ দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।

১৯৪৭ সালে ১৪ জন ভাষা সংগ্রামী পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ‘আমাদের দাবি’ সম্বলিত ২১ দফা ইস্তেহার প্রণয়ন করেন। এই একুশ দফার দ্বিতীয় ও অন্যতম দফাটি ছিল বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করা সংক্রান্ত। এই ঐতিহাসিক ইস্তেহারের অন্যতম উদ্যোক্তা ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। কাজী গোলাম মাহবুব ছিলেন এর অন্যতম স্বাক্ষরদাতা।

১৯৪৮ সালের ১১ মার্চের ধর্মঘটে কাজী গোলাম মাহবুবের ভূমিকা ছিল খুবই স্মরণীয়। তিনি সেদিন সচিবালয়ের দ্বিতীয়গেটের সামনে পিকেটিং করেন। এক পর্যায়ে পুলিশের আইজি জাকির হোসেনের গাড়ি সচিবালয়ে প্রবেশ করার চেষ্টা করলে কাজী গোলাম মাহবুবসহ অন্যান্যরা রাস্তায় শুয়ে পড়ে গাড়ির গতি রোধ করেন। এ সময় পুলিশের ব্যাপক লাঠিচার্জে তিনি আহত হন। পুলিশ তাঁকে গ্রেফতার করে প্রথমে কোতোয়ালী থানা পরে সেন্ট্রাল জেলে পাঠিয়ে দেয় এবং তাঁর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে।

১৫ মার্চ রাষ্ট্রভাষা চুক্তির শর্ত মোতাবেক সবাইকে মুক্তি দেয়া হলেও কাজী গোলাম মাহবুব ও শওকতআলীকে পৃথক মামলার কারণে মুক্তি দেয়া হবে না বলে জানানো হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই দুজনকে ছাড়া জেলখানা পরিত্যাগ করবেন না বলে সিদ্ধান্ত নেন। পরে সরকার বাধ্য হয়ে উক্ত দুজনসহ সকলকে মুক্তি প্রদান করেন।

১৬ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বেলতলায় শেখ মুজিবুর রহমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় কাজী গোলাম মাহবুব অংশগ্রহণ করেন এবং বিক্ষোভ মিছিল চলাকালে পুলিশী আক্রমণে আহত হন।

১৯ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে মুহম্মদ আলীজিন্নাহর ভাষণের অন্যতম প্রতিবাদকারী ছিলেন কাজী গোলাম মাহবুব।

১৯৪৮ সালের শেষের দিকে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষাকরার পড়্গে কাজ করতে যেয়ে নাজিমুদ্দীন রোডে রেডিও স্টেশনের সামনে তিনি বাংলা ভাষাবিরোধীদের দ্বারা আক্রান্ত হন এবং অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে যান।

১৯৪৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪র্থ শ্রেণির কর্মচারীদের ধর্মঘটে সক্রিয় অংশগ্রহণের কারণে শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে কাজী গোলাম মাহবুবও গ্রেফতার হন।

১৯৫২ সালে কাজী গোলাম মাহবুব তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি ছিলেন এবং একই সাথে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সদস্য ছিলেন।

১৯৫২ সালের ২৭ জানুয়ারি পল্টন ময়দানে খাজা নাজিমুদ্দীন উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা দিলে আন্দোলন তীব্র হয় এবং ৩১ জানুয়রি ঢাকা বার লাইব্রেরি হলে গঠন করা হয় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ। মওলানা ভাসানীর সভাপতিত্বে কাজী গোলাম মাহবুব সর্বসম্মতিক্রমে পরিষদের আহ্বায়ক মনোনীত করা হয়।

সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক নিযুক্তির পর কাজী গোলাম মাহবুব তাঁর উপর অর্পিত দায়িত্ব ও কর্তব্যের ব্যাপারে অত্যন্ত সচেতনতার পরিচয় দেন। সংগ্রাম পরিষদের গৃহীত কর্মসূচিকে সাফল্যমন্ডিত করার জন্য তিনি নানা কর্মোদ্যোগ গ্রহণ করেন। প্রথমে আসে ৪ ফেব্রম্নয়ারির ছাত্র ধর্মঘট। এ কর্মসূচিকে সফল করার জন্য তিনি তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের ঢাকা শহরের প্রতিটি শাখাকে নির্দেশ প্রদান করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হলসমূহের শাখা এবং ভিপি ও জিএসদের সাথে পৃথক পৃথকভাবে আলোচনায় বসে ছাত্র ধর্মঘট কর্মসূচি সফল করার জন্য তাদের সর্বাত্মক সহযোগিতা কামনা করেন। ছাত্র ধর্মঘটের দিন মিছিলেরও ঘোষণা দেয়া এবং তদানুযায়ী ৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকা শহরে ছাত্রদের বিরাট মিছিল অনুষ্ঠিত হয়।

তিনি ৬ ফেব্রুয়ারি পূর্ববঙ্গ কর্মশিবির অফিসে (১৫নং মোগলটুলি, ঢাকা) সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের প্রথম বৈঠকের আয়োজন করেন। এ বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। এ বৈঠকে ভাষা আন্দোলন পরিচালনার জন্য অর্থ সংগ্রহের বিষয় আলোচনা হয় এবং ১১ ও ১৩ ফেব্রুয়ারি ঢাকা শহরে পতাকা দিবস পালনের মাধ্যমে অংশগ্রহের কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। ২০ ফেব্রুয়ারি তিনি সন্ধ্যে ৭টার সময় ৯৪ নং নবাবপুর রোডস’ আওয়ামী মুসলিম লীগ অফিসে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের বৈঠক আহ্বান করেন।

সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সিদ্ধান্ত অনুসারে কাজী গোলাম মাহবুব শামসুল হককে সাথে নিয়ে ২১ ফেব্রুয়ারি সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলাস’ সমাবেশস্থলে হাজির হন। সভায় সংগ্রাম পরিষদের পক্ষে কাজী গোলাম মাহবুব ও শামসুল হক ১৪৪ ধারা ভঙ্গ না করার পক্ষে যুক্তি প্রদর্শন করে বক্তব্য রাখেন। এ সভায় গাজীউল হক সভাপতিত্বে করছিলেন।

কাজী গোলাম মাহবুব কিংবা শামসুল হকের বক্তব্য সেখানের দর্শকেরই পছন্দ হয়নি। ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে উত্তাল জনতা সরকারকে কড়া জবাব দেয়ার প্রস্তুতি নেয়। সভার সিদ্ধান্ত অনুসারে ১০জন করে ছাত্রনেতা বের হয়ে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে গ্রেফতার বরণ শুরু করেন।

স্পষ্টত কাজী গোলাম মাহবুবসহ সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দ ১৪৪ ধারা ভঙ্গের বিপক্ষে থাকলেও যখন আমতলার ছাত্রসভায় ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার পক্ষে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় এবং ছাত্র-জনতার উপর নেমে আসে পুলিশের অত্যাচার, তখন তিনিও সংগ্রাম পরিষদের অধিকাংশ নেতা বাস্তব পরিস্থিতি মেনে নেন।

একুশের গুলিবর্ষণের পরবর্তী পরিস্থিতিতে সংগ্রাম পরিষদের করণীয় নির্ধারণের জন্য কাজী গোলাম মাহবুব ২১ ফেব্রুয়ারিরাতে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে একটি বৈঠক ডাকেন। আবুল হাশিম, সাপ্তাহিক সৈনিক সম্পাদক আবদুল গফুর, কমরুদ্দীন আহমদ, অলি আহাদ, মোহাম্মদ তোয়াহা, কবির উদ্দীন আহমদ, শহীদুল্লাহ কায়সার, কেজি মোস্তাফা, মাহবুব জামাল জাহেদী, ডা. গোলাম মাওলা প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

২৩ ফেব্রুয়ারি বিকেল ৩টায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হোস্টেলে ভাষা আন্দোলনে কারারুদ্ধ কর্মী আজমল হোসেনের কামরায় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক কাজী গোলাম মাহবুব বৈঠক ডাকেন। উক্ত বৈঠকে সভাপতিত্বকরেন আবুল হাশিম। এ সভায় ২৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত হরতাল কর্মসূচি অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত হয়। তাছাড়া ভাষা আন্দোলনের মূল বিষয়ে গণসচেতনতা জাগ্রত করার জন্য লিফলেটসহ ছাত্রকর্মীদেরকে নিজ নিজ এলাকায় পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়।

আন্দোলনের অধিকাংশ নেতাকর্মীকে গ্রেফতার, যাদেরকে ধরা যায়নি তাদের বিরুদ্ধে হুলিয়া জারী ইত্যাদি ব্যাপক দমননীতির মধ্যে কাজী গোলাম মাহবুব গোপন অবস্থানে থেকেও আন্দোলনের কৌশল পরিবর্তন করে কিছু তৎপরতা চালিয়ে যেতে দেখা যায়। ৬ মার্চ একটি গোপন বৈঠকের মাধ্যমে পত্রিকায় একটি খবর পাঠানো হয়। এতে সেদিন থেকে সংগ্রাম পরিষদের সকল কর্মসূচি প্রত্যাহারের ঘোষণা দেয়া হয়। একই সাথে ভাষা আন্দোলনের কারণে গ্রেফতারকৃতদের মুক্তি দাবি করা হয় এবং যাদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারী পরোয়ানা জারী করা হয়েছে তা প্রত্যাহারের দাবি করা হয়।
একই সাথে কাজী গোলাম মাহবুব গোপনে গোপনে সংগঠিত হওয়ার প্রচেষ্টা চালান।

৭ মার্চ শান্তিনগরে ডাক্তার আবদুল মোতালেবের বাসায় যেসব ভাষা সংগ্রামী গ্রেফতার হননি, তাদের একটি বৈঠক। পুলিশ গোপন সংবাদটি জেনে যায় এবং বাড়িটি ঘিরে ফেলে। সেখান থেকে ৭ জনকে গ্রেফতার করা হয়। তাঁরা হলেন মোহাম্মদ তোয়াহা, অলি আহাদ, আবদুল মতিন, সাদেক খান, আবদুল লতিফ, হেদায়েত হোসেন চৌধুরী ও মজিবুল হক। অলি আহাদ বলেছেন, কাজী গোলাম মাহবুব বাঁশের খাঁচার উপর এমনভাবে শুয়ে পড়েছিলেন যে, পুলিশ তাঁকে দেখতে পায়নি। বেশ কিছুদিন আত্মগোপন করে থাকার পর তিনি আতাউর রহমান খানের সাথে সাক্ষাত করে পরামর্শ করেন। তিনি ঢাকা জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট আত্মসমর্পণ করেন। সেখান থেকে তাঁকে কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠিয়ে দেয়া হয়।

কাজী গোলাম মাহবুব প্রায় এক বছর সেন্ট্রাল জেলে বন্দি থাকেন। ১৯৫৩ সালে প্রথম শহীদ দিবসে আরমানিটোলা ময়দানের বিশাল জনসভায় তিনি বক্তব্য রাখেন। তিনি ২০০৬ সালে ঢাকায় ইন্তেকাল করেন।