বরিশালে ভৌগোলিক বিবেচনায় সংসদীয় আসন বিন্যাসের দাবি

খোকন আহম্মেদ হীরা, বরিশাল ॥ বরিশাল বিভাগের ছয়টি জেলার ২৩টি সংসদীয় আসনকে জনসংখ্যা কমার অজুহাতে ২০০৮ সনে ২১টি আসনে পুনর্বিন্যাস করা হয়। প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ বিভাগের আসন সংকুচিত করে থানা, উপজেলা ও জেলাকে বিভাজনের পাশাপাশি ইউনিয়ন পর্যন্ত অপর জেলা কিংবা ভিন্ন আসনের সাথে যুক্ত করে দিয়েছেন। দেশে জরুরি অবস্থা চলাকালে নির্বাচন কমিশনের একক সিদ্ধান্তে যেভাবে আসন বিন্যাস করা হয়েছে তাতে সংকুচিত হয়ে গেছে বরিশাল জেলার নির্বাচনী এলাকার ভৌগোলিক সীমারেখা। এ অঞ্চলের রাজনৈতিক নেতারা তাই ভৌগোলিক অবস্থান বিবেচনা করে পূর্বের আসন বহাল রেখে নির্বাচনী এলাকা পুনর্গঠনের জন্য নির্বাচন কমিশনের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।

জানা গেছে, বরিশাল জেলার সাড়ে ছয়টি নির্বাচনী আসন এখন ছয়টিতে পরিণত হয়েছে। স্বরূপকাঠী উপজেলাকে বাদ দিতে গিয়ে বাকি ১০ উপজেলার মধ্যে যে ভাঙ্গাগড়া করা হয়েছে তাতে শুধু উন্নয়ন বৈষম্য নয়, প্রশাসনিক কাজেও মানুষকে হয়রানির মুখোমুখী হতে হচ্ছে। স্বরূপকাঠীকে বাদ দেয়ার পাশাপাশি বাবুগঞ্জ-উজিরপুর নিয়ে গঠিত আসনটি বিলুপ্ত করে উজিরপুর উপজেলাকে বানারীপাড়ার সাথে যুক্ত করা হয়। বাবুগঞ্জকে দেয়া হয় মুলাদীর সাথে। সে সময় ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন ও স্থানীয় আওয়ামীলীগ নেতা হাবিবুর রহমান খান মুলাদীর সাথে বাবুগঞ্জকে সংযুক্ত করার বিরোধীতা করেছিলেন। আপত্তি জানিয়েছিলেন বানারীপাড়া-স্বরূপকাঠী আসনের মনোনয়ন প্রত্যাশী বর্তমান সংসদ সদস্য অধ্যক্ষ শাহ আলমও। রাশেদ খান মেনন কিংবা অধ্যক্ষ শাহ আলম তাদের আপত্তি নির্বাচন কমিশনে জানিয়েও কোনো সুফল পাননি। আসন বিন্যাসের জটিলতায় মেনন তার দীর্ঘদিনের নির্বাচনী এলাকা বাবুগঞ্জ-উজিরপুরের পরিবর্তে ঢাকা থেকে মহাজোটের ব্যানারে নির্বাচনে অংশগ্রহন করেন। সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, বাবুগঞ্জ উপজেলাকে মুলাদীর সাথে যুক্ত করায় জনসাধারনের চরম দুর্ভোগ বেড়েছে। দু’উপজেলার মধ্যদিয়ে বয়ে গেছে প্রমত্তা আড়িয়াল খাঁ, সন্ধ্যা ও সুগন্ধা নদী। এখন দু’উপজেলার উন্নয়ন সমন্বয় করতে গিয়ে স্থানীয় সংসদ সদস্যসহ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। বাবুগঞ্জ উপজেলা আওয়ামীলীগের সাধারন সম্পাদক সরদার খালেদ হাসান স্বপন জানান, আগে বাবুগঞ্জ-উজিরপুর আসন থাকায় কারো কোনো সমস্যা হতো না। একইকথা জানিয়েছেন মুলাদী বিএনপি দলীয় উপজেলা চেয়ারম্যান আব্দুস সাত্তার খান। তিনি বলেন, হিজলা-মুলাদীর নয়াভাংগুলী নদীর ওপর ব্রিজ তৈরি করায় এখন আর এ দুই উপজেলার মধ্যে কোনো ভেদাভেদ নেই। কিন্তু ২০০৮ সনে মুলাদীকে বাবুগঞ্জের সাথে এবং হিজলাকে মেহেন্দিগঞ্জের সাথে যুক্ত করায় দুর্ভোগ পোহাচ্ছে মুলাদীবাসী। নদী বেষ্টিত মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলায় ইউনিয়ন রয়েছে ১৩টি। হিজলায় ইউনিয়ন রয়েছে ৬টি। এটিকে সবচেয়ে দুর্ভোগের নির্বাচনী আসন (বরিশাল-৪) হিসেবে এখন অভিহিত করা হয়েছে। মেহেন্দিগঞ্জের ১৩টি ইউনিয়নের মধ্যে আলিমাবাদসহ কয়েকটি ইউনিয়ন পটুয়াখালী ও ভোলার সীমান্তবর্তী এলাকায় অবস্থিত। এসব এলাকার উন্নয়ন কাজ তদারকি করতে চরম দুর্ভোগের কথা জানালেন সেখানকার বিএনপি দলীয় সংসদ সদস্য মেজবাহ উদ্দিন ফরহাদ। একই কথা জানিয়েছেন সাবেক বিএনপি দলীয় অর্থ ও পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শাহ মোহাম্মদ আবুল হোসাইন। তিনি জানান, মেহেন্দিগঞ্জের নদী বেষ্টিত ১৩টি ইউনিয়ন বিশাল ভৌগোলিক সীমারেখার মধ্যে অবস্থিত। মেঘনা, আড়িয়াল খাঁ ও কালাবদরসহ বেশ কয়েকটি নদীর কারণে বিশাল এলাকা সত্ত্বেও এখানে জনবসতি কম। কম জনবসতিপূর্ণ এলাকা হলেই ভৌগোলিক সীমারেখা কমে যায় না। ইতিপূর্বে শুধু মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলাকে নিয়েই বরিশাল-৪ আসনের ভৌগোলিক সীমারেখা সীমাবদ্ধ ছিলো। এখন নদী ভাঙ্গনে সহায়-সম্বলহীন এ ১৩টি ইউনিয়নের সাথে হিজলার যে ৬টি ইউনিয়ন যুক্ত করা হয়েছে তাও ভাঙ্গন কবলিত। এরকম উন্নয়ন বঞ্চিত নদী বেষ্টিত দু’টি উপজেলাকে নিয়ে একটি আসন সৃষ্টি করার মধ্য দিয়ে উন্নয়ন বৈষম্যের সৃষ্টি করা হয়েছে। এমপিদের কোটা অনুযায়ী যে বরাদ্দ দেয়া হয় তা কখনোই এ নির্বাচনী এলাকার মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছানো সম্ভব হয় না। এদিকে বাকেরগঞ্জের ১৪টি ইউনিয়ন নিয়ে বরিশাল-৬ আসন বহাল রাখা গেলে মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলা ও পৌরসভাকে নিয়ে কেনো বরিশাল-৪ আসন বহাল রাখা যাবে না, এমন প্রশ্ন করেছেন স্বেচ্ছাসেবক লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক পঙ্কজ দেবনাথ। তিনি জানান, আসন বিন্যাসের নামে মানুষের ওপর দুর্ভোগ চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। পঙ্কজ দেবনাথসহ ওই আসন থেকে যারা আওয়ামীলীগের মনোনয়ন প্রত্যাশী তারা সকলেই পূর্বের আসন বহাল রাখার দাবি জানিয়েছেন।

বানারীপাড়া উপজেলাকে পিরোজপুর জেলা থেকে বরিশাল জেলায় অন্তর্ভুক্ত করার আন্দোলনের প্রথম সারির নেতা ছিলেন বানারীপাড়ার সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান এ্যাডভোকেট এস.এম ইকবাল। তিনি জানান, আইনি মারপ্যাচ আর বিশাল জনগোষ্ঠীর দোহাই দিয়ে ঢাকায় আসন বৃদ্ধি আর দক্ষিণাঞ্চলে আসন কমিয়ে জনপ্রতিনিধি কমানো হয়েছে।

বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের মেয়র শওকত হোসেন হিরন, বরিশাল-১ (গৌরনদী-আগৈলঝাড়া) আসনের সংসদ সদস্য এ্যাডভোকেট তালুকদার মোঃ ইউনুস ও জনতা ব্যাংকের পরিচালক এ্যাডভোকেট বলরাম পোদ্দার বলেন, দক্ষিণাঞ্চলের আসন জনগণের হিসেব অনুযায়ী করলে হবে না। এ আসন বিন্যাস করতে হবে ভৌগোলিক অবস্থান থেকে। নৌ-পথ আর সড়কপথ একই বিবেচনায় আনলে সমান উন্নয়ন কখনই সম্ভব নয়। নদী বেষ্টিত হওয়ার কারণেই যোগাযোগে পিছিয়ে থাকা এ অঞ্চল উন্নয়ন বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। এ কারণে তারাও পুরনো আসন বহাল রাখার দাবি জানিয়েছেন।