চিঠি লিখলাম ও লিখলাম তোমাকে পরে জবাব দিয়গো আমাকে – তথ্য প্রযুক্তির যুগে হারিয়ে যাচ্ছে চিঠি

খোকন আহম্মেদ হীরা ॥ “চিঠি লিখলাম ও লিখলাম তোমাকে-পরে জবাব দিয়োগো আমাকে” প্রিয়জনের কাছে লেখা চিঠির প্রচলন তথ্য প্রযুক্তির যুগে আজ হারিয়ে যেতে বসেছে। এখন আর সেই আগেকার দিনের মতো পিয়নের পানে চাহিয়া থাকিতে হয়না প্রিয়জনদের। অথচ এক সময় চিঠিই ছিলো যোগাযোগের একমাত্র উপায়। তথ্য প্রযুক্তি আজ শহর ছেড়ে অজপাড়া গাঁয়েও পৌঁছে চিঠি লিখলাম ও লিখলাম তোমাকে পরে জবাব দিয়গো আমাকে - তথ্য প্রযুক্তির যুগে হারিয়ে যাচ্ছে চিঠিগেছে। তাই প্রিয়জনদের সাথে যোগাযোগ রক্ষায় এখন আর চিঠির প্রচলন নেই বললেই চলে। ডিজিটাল যুগে পা রাখতেই এখন হাতে থাকা মোবাইল ফোন, ই-মেইল কিংবা ফেইসবুক ও স্কাইপেতে ভিডিও চ্যাটের মাধ্যমে এখন যেকোন সময় যোগাযোগ করিয়ে দিচ্ছে প্রিয়জনদের সাথে। এ জন্য চিঠি লেখার প্রবণতা কমে আসায় এর ভাষার নান্দনিকতা হারিয়ে যাচ্ছে। অথচ চিঠি লেখার মধ্য দিয়েই সাহিত্য রচনা শুরু হয়েছিলো। কিশোর কিংবা যুবক বয়সে প্রেমের চিঠি লেখার মধ্য দিয়েই শুরু হয়েছিলো কবিত্বের। তাই চিঠির আনন্দ কোনভাবেই প্রযুক্তির মধ্যদিয়ে পাওয়া সম্ভব নয়।

বরিশালের গৌরনদী উপজেলার প্রবীন সমাজ সেবক কালিয়া দমন গুহ বলেন, পোষ্ট অফিসের পিয়ন কতোদিন ধরে যে দরজায় এসে কড়া নাড়ে না। বলেনা, বাবু আপনার চিঠি আছে। তিনি আরো বলেন, প্রিয়জনের কথা জানবার প্রতি মানুষের যে তীব্র ব্যাকুলতা তা যেন জীবন থেকে হঠাৎ করেই উঠে যাচ্ছে। অথচ ডাক ব্যবস্থাকে ঘিরেই শত শত বছর ধরে রচিত হয়েছে মানুষের অগ্রযাত্রার কতো না ইতিহাস। বর্তমান প্রজন্মের অধিকাংশদের মতে কাগজে লিখলে চিঠি আর ই-মেইল করলে তা যে চিঠি নয়, এমন তো নয়। চিঠি সবই। তবে এটা ঠিক, কাগজে চিঠি লিখতে বসলে একাকি ঘরে অনেক সুখ-দুঃখের কথা চলে আসে। ই-মেইলে যেন সেই সুখ-দুঃখটা ধরা দেয় না। চিঠিতে প্রিয়জনকে বহুগুনে আকৃষ্ট করতে হাতের আঙ্গুল কেটে রক্ত দিয়ে লেখা থাকতো কতোনা স্মৃতিমাখা বেদনার ছন্দ কথা। ই-মেইলে সে সব ছন্দ কথা কখনোই ধরা দেয় না। এই চিঠিকে ঘিরে রচিত হয়েছে কতোনা কবিতা ও বাংলা ছবির রোমান্টিক কিংবা বেদনার গান। যেমন-“চিঠির উত্তর দিসরে বন্ধু যদি মোনে লয়, কাগজ গেল দিস্তায় দিস্তায় কলম গোন্ডা ছয়/ বিদেশ গিয়া বন্ধু তুমি আমায় ভুইলো না, চিঠি দিও পত্র দিও জানাইও ঠিকানা/চিঠি লিখেছে বউ আমার ভাঙ্গা ভাঙ্গা হাতে/চিঠি দিও প্রতিদিন, চিঠি দিও, নইলে থাকতে পারবো না। কবি হেলাল হাফিজ তার কবিতায় লিখেছিলো-‘এখন তুমি কোথায় আছো, কেমন আছো পত্র দিও, শেষ বিকালে মেলায় কেনা খামখেয়ালীর তাল পাখাটা, খুব নিশীথে তোমার হাতে কেমন আছে-পত্র দিও’ এসব আবেগমাখা গান ও কবিতা আজ কেবলই স্মৃতি।

শুধু রোমান্টিক মুহুর্তের জন্যই চিঠির ব্যবহার ছিলোনা। প্রাচীনকাল থেকেই মানুষের জীবন, প্রকৃতি, রাজনীতি, সমাজনীতিসহ সব কিছুতেই যোগাযোগের একমাত্র উপায়ই ছিলো চিঠির ব্যবহার। বিভিন্ন দেশের মনিষী ও রাজনীতিবিদদের কাছে লেখা চিঠি দিয়ে ইতোমধ্যে তৈরি হয়েছে অসংখ্য গ্রন্থ। ওইসব চিঠির গ্রন্থে উঠে এসেছে সময় ও মানুষের জীবনযাত্রার প্রকৃত ইতিহাস। চিঠির মাধ্যমে যোগাযোগের সূত্রধরে ভালবেসে বিয়ে করে দীর্ঘ ১৩ বছরের সুখের সংসার করা গেরাকুল গ্রামের শাহারা শারমিন সিমা বলেন, সব কথা মুখে বলা যায় না। মোবাইল ফোনের এসএমএসেও সব কথা লেখা যায় না। তাই চিঠির কোন বিকল্প নেই। তিনি আরো বলেন, আমাদের ভালবাসার তিন বছরে আমি ওর কাছে অসংখ্য চিঠি লিখেছি। সেও অসংখ্য চিঠি লিখেছে আমার কাছে। যা আজ বিয়ের ১৩ বছর পরেও আমাদের লেখা সেসব চিঠিগুলো যতœ সহকারে রাখা রয়েছে। গৌরনদীর সবার প্রিয় ব্যক্তিত্ব ও সাদা মনের মানুষ বলেখ্যাত কবি শিকদার রেজাউল করিমের মতে, চিঠিতে শুধু বিষয় বৈচিত্রই নয়, মনের কথা লিখবার আকুতি তা বলবার ধরনেরও ছিল নানা আঙ্গিক। চিঠি লেখার মাঝেও রয়েছে নানা বৈচিত্র। যেমন চিঠির শুরুতেই ‘এলাহী ভরসা’ লেখার প্রচলন আজো রয়েছে। গুরুজনদের কাছে চিঠি লেখার সময় ‘শত কোটি সালাম’ লেখাটিও ছিল বেশ জনপ্রিয়। চিঠিতে সম্বোধনের পরে ‘পর সমাচার এই যে’ এই বলেও চিঠি লিখতেন অনেকে। তবে ভালোবাসার মানুষের কাছে চিঠি লেখার জন্য বাহারি প্যাড পাওয়া যেতো হাট-বাজারের দোকানে। হলুদ, গোলাপী, নীলসহ নানা রোমান্টিক রঙ্গের প্রেমের আমন্ত্রণী বাণী জলছাপ দিয়ে লেখা থাকতো ওইসব প্যাডে। থাকতো ফুলের কিংবা প্রেমের নকশার বাহার। ভালোবাসার মানুষের কাছে চিঠি লিখবার সম্বোধনগুলোই ছিলো বেশ চমকপ্রদ। ‘প্রিয়তমা’ ‘মনের রানী’ দিয়ে অনেকেই শুরু করতেন চিঠি লেখা। তিনি আরো বলেন, তথ্য প্রযুক্তির যুগে একটি সময় আসবে ভবিষ্যত প্রজন্ম প্রবীণদের কাছে জিজ্ঞেস করবে, চিঠি-সেটা আবার কি?