মোঃ জামাল উদ্দিন ॥ দেশের দক্ষিণাঞ্চলে পাটের আবাদ ও উৎপাদন এখনও সম্ভাবনাময় হলেও গত তিন বছরের অব্যাহত দরপতনে কৃষকেরা পাটের আবাদে আগ্রহ হারাতে শুরু করেছে। সদ্য সমাপ্ত মৌসুমেও আশানুরূপ দর না পাওয়ায় আগামীতে কৃষকদের পাট আবাদে কতটুকু উৎসাহ থাকবে সে বিষয়ে মাঠ পর্যায়ের কৃষিবিদদের সন্দেহ রয়েছে। সরকারি পাটকলগুলো কৃষকদের কাছ থেকে সরাসরি পাট না কেনার সুযোগ নিয়ে ফড়িয়া ও বেসরকারি মিল মালিকরা অনেকটা সিন্ডিকেট করেই পাটের বাজারকে গত তিন মৌসুমেই নিম্নমুখী রেখেছে বলে অভিযোগ করছেন সাধারণ কৃষকেরা। পাশাপাশি মৌসুমে মহাজন, ফড়িয়ারা তাদের খেয়াল খুশিমতো দর নির্ধারণ করায় কৃষকরা এখন পাট নিয়ে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। ২০০৮ সনের পাট মৌসুমে ফরিদপুর, রাজবাড়ী ও বরিশাল অঞ্চলে ২ হাজার থেকে আড়াই হাজার টাকা দরে পাট কিনলেও গতবছর তা ৮’শ থেকে ১ হাজার ২’শ টাকায় কিনেছে। সদ্য সমাপ্ত পাট মৌসুমে প্রকার ভেদে ১ হাজার ২’শ থেকে ১ হাজার ৫’শ টাকা মন দরে পাট বিক্রি হয়েছে দক্ষিণাঞ্চলের মোকামগুলোতে।
পাট উৎপাদনকারী কৃষকেরা জানিয়েছেন, এক মন পাটের উৎপাদন ব্যয় এখন প্রায় ১ হাজার ৫’শ টাকা। ফলে দীর্ঘ ৪ মাসের পরিচর্যা ও পরিশ্রমসহ নগদ অর্থ ব্যয় করে পাট উৎপাদন করলেও তাতে কৃষকদের ঘরে কোন লাভ আসে না। গত তিন বছর ধরে সরকারি পাট ক্রয় কেন্দ্রগুলো অকার্যকর করে রাখার ফলেই বেসরকারি মিল মালিক ও মহাজনরা তাদের খুশিমতো দরে পাটের মূল্য নির্ধারণ করায় কৃষকদের সর্বনাশ হচ্ছে। আর এতে করে দক্ষিণাঞ্চলের কৃষি অর্থনীতিরও চরম সর্বনাশ হচ্ছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের পরিসংখ্যান মতে, ২০১০ সনে বরিশাল কৃষি অঞ্চলের ১১টি জেলায় ১ লাখ ৪৫ হাজার ৪১ হেক্টর জমিতে পাট আবাদের লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে প্রকৃত আবাদ হয়েছিল ১ লাখ ২৪ হাজার ৫৮ হেক্টরে। আর ওইবছর ১৫ লাখ ৫০ হাজার ৮৬ বেল উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে এ অঞ্চলের ১১টি জেলায় লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে লক্ষাধিক বেল কম পাট উৎপাদন হয়ে ১৪ লাখ ৪২ হাজার ৪২ বেল পাট উৎপাদিত হয়। ২০১১ সনে এই অঞ্চলের ১১টি জেলায় ১ লাখ ৩৩ হাজার ৮৮৩ হেক্টর জমিতে পাট আবাদের লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে প্রকৃত আবাদ হয় প্রায় ৫০ হাজার হেক্টর বেশি জমিতে। ২০১০ সনে ১ লাখ ৮০ হাজার ৪৮৪ হেক্টর জমিতে পাটের আবাদ হয়েছিল। সে বছর এ অঞ্চলে উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রার ৬ লাখ বেল বেড়ে ২১ লাখ ১১ হাজার ১৩৩ বেলে উন্নীত হয়। আর সদ্য সমাপ্ত মৌসুমে বরিশাল কৃষি অঞ্চলের ১১টি জেলায় ১ লাখ ৫৮ হাজার ৮৪ হেক্টর জমিতে আবাদের লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে ১ লাখ ৭৭ হাজার ৬৯৯ হেক্টর জমিতে পাটের আবাদ হয়েছে বলে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর জানিয়েছে। এবার উৎপাদনও ১৭ লাখ ৩৩ হাজার বেলের বিপরীতে ১৯ লাখ ৫ হাজার ৯১ বেল হলেও তা গত বছরের তুলনায় ২ লক্ষাধিক বেল কম বলে জানা গেছে।
পাটের মূল্য কম থাকায় গত কয়েক বছর ধরে দেশের দক্ষিণাঞ্চলে ধানের পরই এক সময়ের বৃহত্তম অর্থকরী ফসল পাট এখন কৃষকের কাছে ক্রমেই অনর্থের ফসলে পরিণত হচ্ছে। ফলে আবাদে লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত বা অতিক্রম করলেও সঠিক পরিচর্চার অভাবে উৎপাদন ব্যহত হচ্ছে। তব গত কয়েকটি বছর ধরে কৃষকের গোলার পাট বিক্রি শেষ হলে স্থানীয় মহাজনরা দাম বাড়িয়ে পাট বিক্রি করছে। মূল মৌসুমে কম দামে কৃষকদের কাছ থেকে পাট কিনে রেখে বেসরকারি মিল মালিকদের কাছে সেই পাট অধিক দামে বিক্রি করার একটি প্রবনতাও বাড়ছে। চলতি বছরেও একই পরিস্থিতি বিরাজ করছে। কৃষকের গোলার পাট মহাজনের ঘরে ওঠা শেষ হওয়ার পরেই মণপ্রতি ২’শ টাকা পর্যন্ত দাম বেড়ে যাচ্ছে। এদিকে পরিস্থিতি উত্তরণে অবিলম্বে সরকারের পদক্ষেপ গ্রহণের তাগিদ দিয়েছেন মাঠ পর্যায়ের কর্মরত কৃষিবিদরা। পাশাপাশি দক্ষিণাঞ্চলে পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট উদ্ভাবিত অধিক ফলনশীল পাট বীজ ও এর আবাদ প্রযুক্তি মাঠ পর্যায়ে কৃষকদের কাছে পৌঁছে দেয়ারও কোন বিকল্প নেই বলে মনে করছেন সাধারণ কৃষিবিদরা। যদিও দক্ষিণাঞ্চলের ফরিদপুরে পাট গবেষণা ইনস্টিটিউটের একটি আঞ্চলিক কেন্দ্র রয়েছে। এর আওতায় বরগুনার আমতলীতে একটি উপ-কেন্দ্র থাকলেও তা কোন কাজে আসছে না বলে অভিযোগ রয়েছে। জনবল সংকটসহ এ কেন্দ্রটির কর্মপরিধিও যথেষ্ট সীমিত। মূলত বরিশালে এ ধরনের একটি উপ-কেন্দ্র বা কেন্দ্র স্থাপন করা উচিত বলে মনে করছেন কৃষিবিদরা।কারণ বরিশাল বিভাগের মধ্যে একমাত্র বরিশাল জেলাতেই পাটের আবাদ তুলনামূলকভাবে বেশি। পটুয়াখালী, বরগুনা ও ভোলা জেলায় যে সামান্য পাটের আবাদ হচ্ছে তা সবজি হিসেবেই কৃষকরা বিক্রি করে দিচ্ছে। অথচ বরিশাল ও ঝালকাঠি জেলার মতো ভোলাতেও অধিক পরিমাণে পাট আবাদের সুযোগ ও সম্ভাবনা রয়েছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর ও পাট গবেষণা ইনস্টিটিউটের এক্ষেত্রে তেমন কোন উদ্যোগ লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। মাঠ পর্যায়ের কৃষিবিদদের মতে দেশের অন্যতম বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী ও বিপুল কর্মসংস্থানের ফসল পাটের আবাদ, উৎপাদন ও কৃষকদের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তি নিশ্চিতকরণ এবং প্রবৃদ্ধি অব্যাহত রাখার লক্ষ্যে সরকারের নজরদারিসহ কার্যকর পদক্ষেপের কোন বিকল্প নেই বলে পাটচাষী ও মাঠ পর্যায়ের কৃষিবিদরা মনে করছেন।