যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ – মুহাম্মদ মোস্তাফিজুর রহমান

এ ইরাক ও ইরানসহ বেশ কয়েকটি দেশের মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থার গোপন তৎপরতার ইতিহাস প্রকাশ করেছেন। বইটিতে তিনি দাবি করেছেন, ডক্টর আলহাদাদের মতো কমপক্ষে ৩০ জন ইরাকি মার্কিন নাগরিককে তাদের পরিবারের কাছ থেকে ইরাকের সমরাস্ত্র গবেষণা সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহের জন্য ইরাক পাঠিয়েছিল সিআইএ। তাদের প্রত্যেকেই ফিরে এসে সিআইএকে জানায় যে, ইরাকে সব বড় মাপের সমরাস্ত্র কর্মসূচি বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। ডক্টর আলহাদাদের স্বামীকে একজন সিআইএ কর্মকর্তা বলেছিলেন, আলহাদাদের ভাই তাকে মিথ্যা বলেছেন। ২০০২ এর অক্টোবরে অর্থাৎ আলহাদাদের ইরাক সফরের এক মাস পরই সিআইএ ঘোষণা করে যে, ইরাক তাদের পরমাণু কর্মসূচী পুনরুজ্জীবিত করেছে এবং সিআইএ’র হাতে এ সংক্রান্ত তথ্য প্রমাণ রয়েছে। এ তথ্যের ওপর নির্ভর করেই পেন্টাগন ইরাক হামলার পরিকল্পনা চূড়ান্ত করে।

মার্কিন নিরাপত্তাকে আরো সুসংহত করতে সিআইএ প্রতিষ্ঠা করা হয়
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ক্রান্তিলগ্নে ১৯৪৭ সালে প্রেসিডেন্ট হ্যারি এস ট্রুম্যানের সময় সিআইএ (Central Intelligence Agency) গঠন করা হয়। বিশেষ নিরাপত্তা আইনের আওতায় মার্কিন কংগ্রেস এটি গঠন করা হয়। সিআইএ গঠনের পর যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা অফিস অব স্ট্র্যাটেজিক সার্ভিসেস (ওএসএস) বিলুপ্ত করা হয়। সিআইএ গঠনের উদ্দেশ্য ছিল মার্কিন নিরাপত্তাকে আরো সুসংহত করা। এর অফিসিয়াল ভিশন  হচ্ছে- ‘One Agency. One Community. An Agency unmatched in its core capabilities, functioning as one team, fully integrated into the Intelligence Community.’ তবে সিআইএ গঠনের মূল উদ্দেশ্য ছিল আমেরিকার প্রতি বৈরি রাষ্ট্রগুলোর ওপর তীক্ষ নজরদারি ও মার্কিন স্বার্থ হাসিল করা। পাশাপাশি আমেরিকার প্রতিদ্বন্দ্বী তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের ওপর সবসময় চোখ রাখা।

সিআইএ’র তথ্য সংগ্রহের বড় মাধ্যম মিডিয়া:
সিআইএ’র কর্মকৌশল বিশ্বের আর দশটা গোয়েন্দা সংস্থার মতোই। তবে কাজ করতে গিয়ে সিআইএ যে ধরণের প্রযুক্তি ব্যবহার করে ও যে পরিমাণ অর্থ খরচ করে সেটা বিশ্বের কোনো গেয়েন্দা সংস্থাই করতে পারে না। বিশ্বের সব দেশেই রয়েছে এর শক্তিশালী নেটওয়ার্ক। সিআইএ’র তথ্য সংগ্রহের বড় একটি মাধ্যম হচ্ছে মিডিয়া বা সংবাদমাধ্যম। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের পত্রপত্রিকা, টিভিচ্যানেল, সরকারি প্রকাশনা, পরিসংখ্যান, সরকারি কর্মকর্তা ও রাজনীতিবিদদের বক্তৃতা-বিবৃতি থেকে তারা তথ্য সংগ্রহ করে। সাবেক রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধান, মন্ত্রী, এমপি, সেনাপ্রধান থেকে শুরু করে বড় বড় কর্মকর্তাতের তারা কিনে নেয়। বিনিময়ে আদায় করে নেয় প্রয়োজনীয় তথ্য। সব দেশের বড় বড় রাজনীতিকদের সাথে সিআইএ গোপনে যোগাযোগ রাখে। তাদের টাকা ও বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা দিয়ে সময়মত ব্যবহার করে। এছাড়া ভূ-উপগ্রহ, ইন্টারনেট, গোয়েন্দা বিমান এবং ফোনে আড়ি পেতেও সংস্থাটি তথ্য সংগ্রহ করে। সবচেয়ে বড় কথা হলো বিশ্বের সব দেশে ছড়িয়ে আছে সিআইএ’র নিজস্ব এজেন্ট। এরা অত্যন্ত দক্ষ ও চতুর। এরা সব পরিস্থিতির সাথে নিজেদের খাপ খাওয়াতে পারে। এরা ছদ্মবেশেও থাকে আবার মার্কিন দূতাবাসের কর্মকর্তা হিসেবেও থাকে। এরা নানাভাবে তথ্য-উপাত্ত ও ম্যাপ সংগ্রহ করে। কোনো দেশের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধান, বিরোধীদলের নেতা বা অন্য কারো মগজ ধোলাইয়ে ভূমিকা রাখে।

সিআইএ’র বাজেট সবসময় গোপন রাখা হয়:
আমেরিকার সামরিক বাজেট থেকে শুরু করে সব কিছু উন্মুক্ত হলেও সিআইএ’র ব্যাপারে মার্কিন সরকার সবসময় গোপনীয়তা বজায় রেখেছে। সিআইএ’র বাজেট, লোকবল, ব্যবহৃত প্রযুক্তি সম্পর্কে সুস্পষ্টভাবে এখনো কিছু জানা যায়নি। দীর্ঘ ৫৫ বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্র এব্যাপারে গোপনীয়তা বজায় রেখে চলেছে। তবে সিআইএ’র নিজস্ব ওয়েবসাইটে ১৯৯৭ সালে মার্কিন নিরাপত্তা ও নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট কার্যক্রমে ২৬ দশমিক ছয় বিলিয়ন মার্কিন ডলার ও ১৯৯৮ সালে ২৬ দশমিক সাত বিলিয়ন মার্কিন ডলার বাজেটের কথা উল্লেখ আছে। এর আগের বা পরের বছরগুলোর কোনো হিসাব দেয়া হয়নি। বছরের নির্দিষ্ট সময়ে একাডেমিক কার্যক্রম ছাড়া সিআইএ’র  প্রধান কার্যালয়ে কোনো ভিজিটরকে প্রবেশ করতে দেয়া হয় না। ২০০৬ সালে নিউইয়র্ক টাইমসে সিআইএ’র গোপন বন্দীশালা ও মার্কিন নাগরিকদের ফোনে আড়িপাতার বিষয়টি প্রকাশিত হলে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি হয়। তখন প্রেসিডেন্ট বুশসহ উর্ধতন মার্কিন কর্মকর্তারা পত্রিকাটির ওপর বেজায় ক্ষেপে যান।

সিআইএ’র অধিকাংশ প্রকাশনা গোপনীয়:
সিআইএ প্রতি বছর মিলিয়ন মিলিয়ন পৃষ্ঠার দলিল প্রকাশ করলেও মার্কন নাগরিকরা এর সামান্যই জানতে পারে। মার্কিন নাগরিকদের জন্য সিআইএ মার্কিনীদের ইতিহাস ও নিরাপত্তার প্রয়োজনীয়তা সংশ্লিষ্ট দলিল বেশি প্রকাশ করে। ওয়ার্ল্ড ফ্যাক্টবুক সিআইএ’র প্রধান উন্মুক্ত প্রকাশনা।

সিআইএ’র স্থায়ী কর্মকর্তা নেই:
সিআইএ’র অধিকাংশ কর্মকর্তা ওয়াশিংটন ডিসি এলাকায় বসবাস ও কাজ করে। তবে এর স্থায়ী কর্মকর্তা নেই বললেই চলে। মার্কিন সামরিকবাহিনীর কর্মকর্তাসহ দেশের অন্যান্য সিকিউরিটি কাউন্সিলের কর্মকর্তাদের সিআইএতে প্রেষণে নিয়োগ দেয়া হয়। দেশের বাইরে ওই দেশের সামরিকবাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাসহ সরকারি ও বেসরকারি কর্মকর্তা, রাজনীতিবিদ, আইনজীবী, সাংবাদিক, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবীসহ দেশের উচ্চপর্যায়ের লোকদের এজেন্ট হিসেবে নিয়োগ দেয় সিআইএ। সিআইএ যাদের স্পাই বলে। এসব স্পাইদের মধ্যে কেউ বিশ্বাস ভঙ্গ করলে তাদের হত্যা পর্যন্ত করা হয়। গত পাঁচ দশক ধরে হেন অপকর্ম নেই যা সিআইএ করেনি। এখন সিআইএ রাখঢাক করে কাজ করলেও ৫০ এর দশকে এ সংগঠনটি ছিল বেপরোয়া। তখন এর ভয়ে তটস্থ থাকতো সারা দুনিয়া।

সিআইএ’র প্রধান কাজ ছিল কমিউনিজমের বিরুদ্ধে:
পঞ্চাশের দশকে পূর্ব ইউরোপে সিআইএ’র মূল কাজ ছিল কমিউনিস্ট প্রভাব থেকে ওই অঞ্চলের দেশগুলোকে রক্ষা করা। এ লক্ষ্যে সিআইএ ওইসব দেশের ডানপন্থী দল ও গেরিলা গোষ্ঠিীগুলোকে অর্থ ও অস্ত্র সরবরাহ করত। তবে এত কিছুর পরও সে সময় পূর্ব ইউরোপে সিআইএ বলতে গেলে ব্যর্থ হয়। ইউক্রেন ও বেলারুশকে সিআইএ সর্বাত্মক সহযোগিতা করলেও কমিউনিজমের হাত থেকে রক্ষা করতে পারেনি। পোল্যান্ডকে রাশিয়ার প্রভাব বলয় থেকে রক্ষা করতে না পারলেও সিআইএ ইতালি ও ফ্রান্সকে রক্ষা করতে পেরেছিল সফলভাবে।

তৃতীয় বিশ্বে সিআইএ’র অপকর্মের শেষ নেই। নিউইয়র্ক টাইমস, জেমস রাইজারের ‘State of War : The Secret History of the CIA and The Bush Administration’ বই, এ সংস্থার সাবেক পদস্থ কর্মকর্তা জন স্টক ওয়েলসহ ইন্টারনেটে বিভিন্ন ওয়েবসাইট থেকে প্রাপ্ত তথ্য মতে, কোরিয়া ও ভিয়েতনাম যুদ্ধে লাখ লাখ বেসামরিক লোকের মৃত্যুর পেছনে ছিল সিআইএ’র হাত। আমেরিকার কারণে এ পর্যন্ত তৃতীয় বিশ্বে ৬০ লাখ লোক নিহত হয়েছে। এর নেপথ্যে ছিল সিআইএ। স্নায়ুযুদ্ধের সময় চিলির পিনোশে, ইরানের রেজাশাহ’র মতো একনায়কদের সমর্থন জুগিয়েছে সিআইএ। ১৯৫৪ সালে গুয়েতেমালার নবীন গণতন্ত্রকে গলাটিপে হত্যা করেছিল সিআইএ। গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সে দেশের প্রথম প্রেসিডেন্ট জ্যাকব আরবেনজ গুজমানকে উৎখাত করে সামরিকজান্তার কাছে ক্ষমতা তুলে দিয়েছিল এ সংস্থা। ১৯৫২ সালে ইরানে সামরিক ক্যু ঘটাতে প্রত্যক্ষভাবে সহযোগিতা করে আমেরিকার এই দুর্ধর্ষ গোয়েন্দা সংস্থা। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ মোসাদেখ দেশের তেল সম্পদকে রাষ্ট্রীয়করণের উদ্যোগ নিলে তাকে ক্ষমতাচ্যুত করে রেজাশাহ পাহলোভিকে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করতে প্রত্যক্ষভাবে সহযোগিতা করে সিআইএ। শাহের যুলুম-নির্যাতনে ইরানবাসী অতিষ্ঠ হলেও সিআইএ তাকে সমর্থন দেয়া অব্যাহত রাখে। কিউবার প্রেসিডেন্ট ফিদেল ক্যাস্ট্রোকে হত্যার জন্য কয়েক দফা পরিকল্পনা করেছিল সিআইএ। ভাড়া করেছিল মাফিয়াদের। কিন্তু সিআইএ’র ওইসব ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হয়। ফলে ক্যাস্ট্রো এখনো বেঁচে আছেন। ১৯৬১ সালে ক্যাস্ট্রোকে হত্যার জন্য জন এফ কেনেডি সরাসরি তদারকিতে ছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে। যিনি আমেরিকার সবচেয়ে জনপ্রিয় প্রেসিডেন্টদের একজন।

স্বার্থসিদ্ধির পর যে কাউকে ছুড়ে ফেলতে পারে সিআইএ:
স্বার্থসিদ্ধির জন্য সিআইএ যে কারো সাথে হাত মেলাতে পারে। আবার স্বার্থ হাসিল হয়ে গেলে তাকে ছুড়ে ফেলে দিতে একটুও কার্পন্য করে না। এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ ইরাকের প্রয়াত প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেন। ১৯৬৩ সালে ইরাকের কাসিম সরকারের সেনা অভ্যাত্থান ঘটাতে বাথ পার্টিকে সর্বোতভাবে সহায়তা করে সিআইএ। ফলে ক্ষমতায় আসে বাথ পার্টি। সর্বময় ক্ষমতা চলে আসে বাথ পার্টির শীর্ষনেতা আরিফ রহমান ও সাদ্দাম হোসেনের কাছে। ১৯৬৮ সালে আরিফ রহমানকে হটিয়ে ইরাকের কর্তৃত্ব গ্রহণ করে সাদ্দাম হোসেন। এটাও হয় সিআইএ’র সহযোগিতায়। ইরানের সাথে যুদ্ধে সাদ্দামকে প্ররোচিত করে ওই একই সংস্থা। ইরাকের কুয়েত দখলের ব্যাপারেও সিআইএ’র হাত ছিল বলে মনে করা হয়। সাদ্দাম হোসেনকে আরববিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলতে পরবর্তী সময়ে তাকে ওই কাজে প্ররোচিত করে। ইরাক আগ্রাসনের পথ পরি®কার করতে একটি ভুয়া রিপোর্ট তৈরি করে ওই গোয়েন্দা সংস্থা। তাতে বলা হয় আল-কায়েদার সাথে সাদ্দাম হোসেনের সম্পর্ক আছে। তার কাছে আছে গণবিধ্বংসী মারণাস্ত্র। ওই রিপোর্টকে অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করে বুশ ইরাকে আগ্রাসন চালায়। দখল করে নেয় দেশটি। ফাঁসিতে ঝোলায় আরববিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী রাষ্ট্রনায়ক সাদ্দাম হোসেনকে।

ভুল দিতে গিয়ে সঠিক তথ্য দেয় ইরানের এজেন্টদের:
২০০২ সালে বেশ কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় আল-কায়েদা নেতাকে আটক করার পর সিআইএ তাদের এনএসএ (ন্যাশনাল সিকিউরিটি এজেন্সি) স্পাইং প্রোগ্রাম শুরু করে। আটককৃত আল-কায়েদা নেতাদের মোবাইল নম্বর ও ই-মেইল এড্রেসের ওপর সিআইএ তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে যাতে কেউ ফোনে বা ই-মেইলে যোগাযোগের চেষ্টা করলে তাকে সনাক্ত করা সম্ভব হয়। এনএসএ’র হাতে এত বেশি ক্ষমতা দেয়া হয়েছিল যে, নতুন কোনো পদক্ষেপ নেয়ার আগে তাদের হোয়াইট হাউজের অনুমোদন নেয়ার প্রয়োজন পড়তো না। ইরানকে ভুল পথে পরিচালিত করার জন্য সিআইএ তাদের এক ডাবল এজেন্টের মাধ্যমে সিআইএ সংক্রান্ত বেশকিছু অতি গোপনীয় তথ্য ইরান পাঠায়। ইরানের দায়িত্বপ্রাপ্ত এজেন্টের হাতে ভুল তথ্য দেয়ার কথা থাকলেও ভুলক্রমে সিআইএ সঠিক তথ্য পাঠায় এবং তা ইরানের হাতে পৌঁছে যায়। ফলে ইরানে মার্কিন গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়। এ অপরাধে ওই সময় বেশ কয়েকজন সিআইএ কর্মকর্তাকে কারাগারে পাঠায় যুক্তরাষ্ট্র। ওই সময়ে এসব তথ্যের সাহায্যে ইরানে মার্কিন গোয়েন্দা তৎপরতার খুঁটিনাটি পর্যন্ত শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছিল।

মাদক ও অস্ত্র চোরাচালানের সাথেও সিআইএ সম্পৃক্ত:
আফ্রিকার অনেক দেশে অশান্তি জিইয়ে রাখার জন্য ক্ষমতাসীন সরকারকে সাহায্য করতো আবার একসাথে গোপনে বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোকে মদদ যোগাতো। ফলে গৃহযুদ্ধ আফ্রিকার এক চিরন্তন বিষয়ে পরিণত হয়।
চিলিতে ১৯৭৩ সালে যে রক্তাক্ত ক্যু হয় তাতে সিআইএ সরাসরি অংশ নেয়। ওই ক্যু এর মাধ্যমে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আলেন্দকে হত্যা করে জেনারেল অগাস্তা পিনোশে ক্ষমতায় অধিষ্ট হন। আজ যে লাদেনকে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র এত হইচই করছে সেই লাদেন এই সিআইএ’র তৈরি। তৎকালীন রাশিয়াকে কোণঠাসা করতে লাদেনকে অস্ত্র, অর্থ, প্রশিক্ষণ সবই দিয়েছে সিআইএ। আফগানিস্তানে বছরের পর বছর অশান্তি জিইয়ে রেখেছে এ সংগঠন। মাদক ও অস্ত্র চোরাচালানের সাথেও সিআইএ’র সম্পৃক্ততার প্রমাণ রয়েছে। ভিয়েতনাম যুদ্ধের আগে ও পরে এশিয়ার বিভিন্ন দেশের মাদক ও চোরাচালান করতো সিআইএ। ভিয়েতনামে অস্ত্র ও গোলা নিয়ে যেত মার্কিন বিমান ও যুদ্ধজাহাজগুলো। আসার সময় খালি বিমান ও জাহাজগুলো ভিয়েতনাম, চীন, থাইল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশের চোরাকারবারীদের মাদক ও অস্ত্র নিয়ে আসতো এবং নিরাপদ জায়গায় সেগুলো পৌঁছানোর ব্যবস্থা করত। নিকারাগুয়ার কণ্ট্রা বিদ্রোহীদের মাধ্যমে সিআইএ বহুদিন অস্ত্র ও মাদক ব্যবসা করেছে। আফ্রিকার বিদ্রোহীগোষ্ঠীগুলোর মাধ্যমেও সিআইএ এ কাজ করেছে। এছাড়া মাফিয়া চক্রের সাথেও সিআইএ’র নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। বহু রাষ্ট্রনেতাকে হত্যার কাজে সিআইএ মাফিয়াদের সাহায্য নিয়েছে। গণতান্ত্রিক কঙ্গো প্রজাতন্ত্রের প্রথম নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট লুমামবা, পানামার সাবেক প্রধানমন্ত্রী ওমর তারিসজকে হত্যা করা হয়েছিল মাফিয়ার সাহায্যে। ১৯৬১ সালে কিউবার প্রেসিডেন্ট ফিদেল ক্যাস্ট্রোকে হত্যার জন্য সিআইএ মাফিয়াকে দায়িত্ব দেয়। মাফিয়ারা বিষ প্রয়োগের মাধ্যমে ক্যাস্ট্রোকে হত্যার চেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হয়।

সিআইএ’র গোপন বন্দীশালা:
নিউইয়র্ক টাইমস গত বছর সিআইএ’র গোপন বন্দীশালার খবর প্রকাশ করলে সারাবিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি হয়। টাইমস জানায়, পোল্যান্ড, চেক প্রজাতন্ত্র, রুমানিয়াসহ পূর্ব ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশে সিআইএ’র গোপন বন্দীশালা রয়েছে। আফগানিস্তান, ইরাকসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে সন্দেহভাজন আল-কায়েদা জঙ্গীদের ধরে ওইসব বন্দীশালায় নিয়ে আসা হয়। এসব বন্দীদের ওপর চালানো হয় অকথ্য নির্যাতন। বিশ্বের প্রতিটি দেশে সিআইএ’র শক্তিশালী নেটওয়ার্ক থাকলেও অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য এ সংগঠনটি দিতে পারেনি। ১৯৫০ সালের ১৩ অক্টোবর সিআইএ’র পক্ষ থেকে প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যানকে বলা হয় চীন কোরিয়ায় কোনোভাবেই সৈন্য পাঠাবে না। অথচ এর মাত্র ছয় দিন পরেই চীন সেখানে ১০ লাখ সৈন্য পাঠায়। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের ব্যাপারেও সিআইএ আগে থেকে কিছু জানাতে পারেনি। ভারত-পাকিস্তানের পরমাণু বোমার সফল পরীক্ষার বিষয়টিও সিআইএ আগে জানতে পারেনি। ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরের হামলার ব্যাপারেও সংস্থাটি ছিল অন্ধকারে। এছাড়া ইরাকে গণবিধ্বংসী অস্ত্র থাকার যে তথ্য তারা দিয়েছিল সেটিও ভুল প্রমাণিত হয়।

বি:দ্র: প্রবন্ধটি ২০০৮ সালে লেখা


লেখক পরিচিতি : মুহাম্মদ মোস্তাফিজুর রহমান
সহ-সম্পাদক
দৈনিক নয়া দিগন্ত
ই-মেইল: pavelmostafiz@gmail.com