আমাদের শিক্ষাব্যবস্হা – তৌফিক ইমাম চৌধুরী

বলেই পরিচিত, তার পত্রিকায় লেখা প্রকাশের প্রয়াশ করার দুঃসাহস দেখাবার জন্য। আচ্ছা বর্তমানে দেশে যে শিক্ষাব্যবস্হা আছে তা নিয়ে কি আপনি পুরোপুরি সন্তুষ্ট? প্রাথমিক কিংবা নিম্নমাধ্যমিক শ্রেণীতে প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে অনেকগুলি বিষয় পড়তে হয়। তার যুক্তিসঙ্গত কারনও অবশ্য আছে। মাধ্যমিকেও নাহয় শিক্ষার্থীরা অনেক বিষয় পড়ল, কিন্তু উচ্চমাধ্যমিকেও কেন এতগুলো বিষয় পড়তে হবে? কেউ যদি পদার্থবিদ্যায় পড়তে আগ্রহী হয়, তবে তাকে কেন বাধ্যতামূলকভাবে জটিল জটিল বাংলা কবিতার নিগূড় তত্বের ব্যখ্যা মুখস্হ করতে হবে? কিংবা জটিল ব্যকরনের নিয়ম মুখস্হ করতে হবে? সে কি এসব পড়তে আদৌ আগ্রহী নাকি জোর করে পড়ছে? অপরপক্ষে কেউ যদি হিসাববিজ্ঞানের শিক্ষার্থী হয়, কেন সে পদার্থবিজ্ঞান বা রসায়ন পড়ার অনুমতি পাবেনা? অর্থাৎ কেউ বিজ্ঞান/বানিজ্য/কলা এই ৩টি বিভাগের একটি নিলে কেন তাকে বাধ্যতামূলকভাবে কয়েকটি বিষয় পড়তে কিংবা না পড়তে হবে? একজন জীববিজ্ঞান পড়ুয়া ছাত্রের বাংলা ব্যকরণ কিংবা রসায়ন পড়ার ইচ্ছা নাও হতে পারে। কেন তাকে তা গলঃধকরণ করতে হবে? অথবা একজন ইতিহাসের ছাত্রের রসায়ন পড়ার ইচ্ছা হতে পারে, কেন সে রসায়ন পড়তে পারবেনা? অর্থাৎ আমাদের মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্তরে কেউ না চাইলেও তাকে তার অপছন্দের বিষয়ের ঘানি টানতে হয়। কিন্তু তার পছন্দের বিষয় পড়ার অনুমতি সে পায়না!

প্রাতিষ্ঠানিকভাবে না পড়তে পারলেও নিজ উদ্যোগে কেউ সেসব বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করে দক্ষ হয়ে উঠতে পারে, কিন্তু সেই বিষয়ে উচ্চতর শিক্ষায় অথবা চাকুরীর বাজারে তার দাম নাই। কারন আমাদের শিক্ষাব্যবস্হা ও সমাজ সার্টিফিকেটসর্বস্ব। শিক্ষার মান কি সার্টিফিকেটে পরিমাপ করা যায়? এর চেয়ে ভাল কোন পদ্ধতি দুনিয়ায়নেই? আর যদি নাই থাকে,তাহলে অন্তত নিজ উদ্যোগে যারা কোন বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করেছে, সরকার তাদের জন্য কমপক্ষে একটি পরীক্ষার আয়োজন করতে পারে।সেই বিষয়ে কৃতকার্য হলে অন্তত প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শিক্ষিতদের সমমানের একটি সার্টিফিকেট পাওয়া যাবে।

আমি জানিনা শিক্ষার মান পরিমাপের জন্য কোন প্রতিষ্ঠান আছে কিনা, যদি থাকে তবে স্বাক্ষরের সংখ্যার দিক থেকে নয়,শিক্ষার মানে আমাদের দেশ কত নম্বর পেয়ে কততম হয়েছে তা খুব জানতে ইচ্ছা করে। অন্যান্য বিষয়ের কথা নাহয় বাদই দিলাম শুধু যদি সবচেয়ে নবীনতম বিষয় কম্পিউটার শিক্ষার উদাহরণ টানি, তবে আমাদের মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শ্রেনীর কম্পিউটার বই দেখেই মনে হয় বইয়ের অধিকাংশই একটি বিশেষ কোম্পানীর প্রোডাক্টের বিজ্ঞাপন! কম্পিউটার চালানো কি কোন বিশেষ কোম্পানীর (মাইক্রোসফট এর, কিন্তু লিনাক্স বা ম্যাক ওএসও আছে) কিছু সফটওয়্যার চালানো? আর এই যদি হয় শিক্ষার হাল, তবে সেই শিক্ষা গ্রহণ করা কতটা গুরুত্বপূর্ণ? আমি শিক্ষা বিষয়ে নিয়মিত কলাম লেখক কোন শিক্ষাবিদ নই। একজন সাধারণ ছাত্র মাত্র। ১৮ বছর বয়সে এপর্যন্ত প্রায় ১২ বছর প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শিক্ষাগ্রহণ করছি। যদিও বাংলাদেশের মাপকাঠিতে এটা কোন সময়ই না তবু গুরুত্বের দিক থেকে এই ১৮ বছর সময়ের দাম বেশী নয় কি? এই সময়ে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে কোন শ্রেণীতে ভাল নৈতিক শিক্ষা পেয়েছি বলে মনে পড়েনা। মানুষের সাথে কিভাবে মিশতে হয়, কিভাবে ভদ্রভাবে কথা বলতে হয়, কোন আচার-ব্যবহার সমাজে স্বীকৃত, কোনটা কাজটা ঠিক, কোনটা বেঠিক, কোন কাজে মানুষ কষ্ট পায় আর কোন কাজে মানুষের কষ্ট লাঘব হয় ইত্যাদি কি প্রাথমিক শ্রেণীতে খুব ভালোভাবে শিখানো উচিত নয় কী?

হয়তো যারা ভালো পরিবারের সন্তান তারা এসব শেখে। কিন্তু যারা পরিবার থেকে এসব শিখতে পারেনা, তারা নিজেরাও বিশৃঙ্খলা সৃস্টি করে, সাথে ভালোদেরও মন্দ করে ফেলে। আমরা সর্বোচ্চ বলি “ওসব বাজে ছেলেদের সাথে মিশবেনা।” কিন্তু এই ‘ওসব’ ছেলেদের শোধরাবার দায়িত্ব তাদের পরিবার কিংবা আমরা কেউই নেইনা। সকল ধর্মেই যথেষ্ট নৈতিক শিক্ষার উপকরণ আছে। তাই প্রাথমিক শ্রেণীতে ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষা আরও বেশি করে শেখালে দূর্নীতি ও নোংরামী কোন শাস্তির ভয় না থাকলেও কমে যেত নয় কি? কিন্তু আমাদের দেশে প্রচলিত মূলধারার ধর্মশিক্ষার যে বেহাল অবস্হা বিদ্যমান তা সত্যিই দুঃখজনক। ধর্মশিক্ষা বিষয়টি নিতান্ত অবহেলার সাথে রাখা হয়েছে। এমনকি তৃতীয় থেকে নবম শ্রেণীর ধর্ম বইগুলো মলাটবিহীন অবস্হায় কোনটা কোন শ্রেণীর তা আলাদা করা কষ্টকর! সমগ্র শিক্ষাব্যবস্হাটাই যেন শুধুমাত্র কালপনিক ভোগবাদী সমাজের জন্য। এই শিক্ষাব্যবস্হায় নৈতিক শিক্ষার কোন মূল্য নেই। বাস্তবজীবনের সাথে এই শিক্ষার কোন মিলও নেই। আর আমাদের শিক্ষকগণ বর্তমানে শিক্ষক শব্দের অর্থ জানেন কিনা তা নিশ্চিত করে বলা মুশকিল। পূর্বে ঠিকমতো ক্লাস না নেয়া, প্রাইভেট না পড়লে ক্লাস পরীক্ষা ও ব্যবহারিক পরীক্ষায় নম্বর না দেয়া সহ বিভিন্নভাবে হেনস্তা করার অভিযোগতো ছিলই, বর্তমানে তার সাথে যোগ হয়েছে ছাত্রীদের পাশবিক নির্যাতন করা। পাশবিক অর্থ পশুর ন্যায়।

একজন ব্যক্তি যখন নূন্যতম মানুষের মত আচরণ না করে পশুর ন্যয় আচরণ করে, তখন সে শিক্ষার্থীদের কি শিক্ষা দিতে পারে? আমি দাবী করছিনা সকল শিক্ষকগণ এমন। কিন্তু প্রশাসনের কোন হস্তক্ষেপ না থাকায় শিক্ষকদের আচরণ যেভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে, তাতে কিছুদিন পর ‘শিক্ষক’ শব্দের সংজ্ঞা বদলে যেতে পারে। দেশে কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর সংজ্ঞা এভাবে দেয়া যায়, “সাধারণ শিক্ষাব্যাবস্হায় পড়তে অক্ষম ও লেখাপড়ায় সবচেয়ে দুর্বল শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ার স্হানই হল কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।” এই বিভাগের ছাত্ররা লেখাপড়ার চেয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের দলবাজি আর প্রতিষ্ঠানের লেদ মেশিদে ‘পাইপগান’, ‘ককটেল’ ইত্যাদি বানাতেই বেশি আগ্রহী। যেখানে কারিগরি প্রতিষ্ঠানে দক্ষ জনশক্তি তৈরি হবার কথা, সেখানে তৈরি হচ্ছে দক্ষ সন্ত্রাসী বাহিনী। বিভিন্ন সভা-সেমিনারে আমাদের শিক্ষানীতি ও এর পরিবর্তন ও সংস্কার নিয়ে নানাজন নানা ছবক প্রদান করেন। কিন্তু যারা প্রত্যক্ষভাবে এই শিক্ষাব্যবস্হার ফল ভোগ করেন, অর্থাৎ সাধারণ শিক্ষার্থীদের মতামত কি কোথাও গ্রহণ করা হয়? আর মতামত গ্রহণ করেই কি লাভ? বিভিন্ন সরকার শিক্ষানীতির পরিবর্তন বলতে যা করেন, তা স্বাধীনতার ঘোষক আর জাতির পিতা নির্ধারণেই সীমাবদ্ধ। যাহোক, লেখা এখানেই শেষ করি। কারণ এতক্ষন আপনাদের মূল্যবান সময় নষ্ট করে লেখাটা পড়ার পর মনে মনে আমাকে বেয়াদব, মূর্খ ইত্যাদি বিশেষণ প্রদান করে ফেলেছেন। আর এই গরমে আপনার মাথার তাপমাত্রা আরও কয়েক ডিগ্রী বাড়িয়ে দেবার জন্য আন্তরিকভাবে দুঃখিত। আশাকরি আপনাদের কষ্টার্জিত জ্ঞান ও বিবেক দিয়ে তা ক্ষমা করবেন।

লেখক : তৌফিক ইমাম চৌধুরী
http://www.toufique.co.cc/