আজ গৌরনদী মুক্ত দিবস

মুক্ত হয়েছে ২২ ডিসেম্বর। বাংলাদেশের মধ্যে সর্বশেষ স্বাধীন হয়েছে গৌরনদী। দীর্ঘ ২৮ দিন মুক্তিবাহিনী ও মুজিব বাহিনীর যৌথ আক্রমণের পর ওইদিন গৌরনদী কলেজে অবস্থানরত শতাধিক পাক সেনা মিত্র বাহিনীর হাতে আত্মসমর্পণ করেছিলো। হানাদার বাহিনী অত্র এলাকায় নির্মম হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে পাঁচ সহস্রাধিক নিরীহ জনসাধারণকে হত্যা ও তিন শতাধিক মা-বোনের ইজ্জত হরন করছিলো। স্বাধীন বাংলাদেশে সর্বশেষ হানাদার মুক্ত গৌরনদীতে ১৯৭৫ সালের ৭ মে তৎকালীন মন্ত্রী আব্দুর রব সেরনিয়াবাত “শহীদ মুক্তিযোদ্ধা স্মৃতি সৌধ” নির্মানের জন্য ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করলেও দীর্ঘ ৩৯ বছর পেরিয়ে গেলেও গৌরনদীতে আজো নির্মিত হয়নি কোন স্মৃতি সৌধ। স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা গৌরনদীতে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতি সংরক্ষনের জন্য জরুরি ভিত্তিতে স্মৃতি সৌধ নির্মানের জন্য প্রধানমন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রনালয়ের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের হস্তক্ষেপ কামনা করছেন।

সূত্রমতে, ২৫ এপ্রিল পাকসেনারা ঢাকা-বরিশাল মহাসড়ক দিয়ে দক্ষিণাঞ্চলের এ জনপদে প্রবেশের মাধ্যমে হত্যাযজ্ঞ শুরু করে। তাদের প্রবেশের খবর শুনে গৌরনদীর স্বেচ্ছাসেবক দলের কর্মীরা গৌরনদীর সাউদের খালপাড় নামকস্থানে তাদের প্রতিহত করার জন্য অবস্থান নেয়। হানাদাররা সেখানে পৌঁছামাত্রই মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধের মুখে পরে। ওইদিন হানাদারদের সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ হন নাঠৈর সৈয়দ হাসেম আলী, চাঁদশীর পরিমল মন্ডল, গৈলার আলাউদ্দিন সরদার ওরফে আলা বক্স ও বাটাজোরের মোক্তার হোসেন। মুক্তিযোদ্ধাদের গুলিতে ওইদিন ৮ জন পাকসেনা নিহত হয়েছিলো। স্থলপথে এটাইছিলো দক্ষিণাঞ্চলের প্রথমযুদ্ধ আর এরাই হচ্ছেন প্রথম শহীদ। গৌরনদীর প্রবেশদ্বার মুখে পাক হানাদাররা খাঞ্জাপুরে মোস্তান নামের এক পাগলকে গুলি করে হত্যা করেছিলো। ওইদিন মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে ৮ জন পাক সেনা নিহত হবার পর তারা (পাক সেনারা) ক্ষিপ্ত হয়ে এলোপাথাড়ি গুলি ছুঁড়তে থাকে। তাদের গুলিতে ওইদিন ২ শতাধিক নিরিহ গ্রামবাসী মারা যায়। হানাদাররা গৌরনদী বন্দরসহ শত শত ঘর বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করেছিলো।  মে মাসের প্রথম দিকে পাকবাহিনী গৌরনদী কলেজে স্থায়ী ক্যাম্প স্থাপন করে। ক্যাম্পে ছিল আড়াই শতাধিক সৈন্য ও ৫০ জন রাজাকার, আলবদর। বাটাজোর, ভুরঘাটা, মাহিলাড়া, আশোকাঠী, কসবাসহ প্রতিটি ব্রীজে পাক মিলিটারীদের বাংকার ছিল। উত্তরে ভুরঘাটা, দক্ষিণে উজিরপুরের শিকারপুর, পশ্চিমে আগৈলঝাড়ার পয়সারহাট, পূর্বে মুলাদী পর্যন্ত গৌরনদী কলেজ ক্যাম্পের সৈন্যদের নিয়ন্ত্রনে ছিলো। এদের দোসররা ছিল এলাকার রাজাকার, আলবদর ও পিচ কমিটির সদস্যবৃন্দ। হত্যাকান্ড, লুটতরাজ, নারী ধর্ষণসহ নানা কাজে তারা পাক সেনাদের সহযোগীতা করতো। পাক মিলিটারীরা গৌরনদী কলেজের উত্তর পার্শ্বে একটি কূপ তৈরি করে সেখানে লাশ ফেলতো। কলেজের উত্তর পার্শ্বে হাতেম পিয়নের বাড়ীর খালপাড়ের ঘাটলায় মানুষ জবাই করে খালের পানিতে ভাসিয়ে দেয়া হতো। গৌরনদী গালর্স হাইস্কুলের পার্শ্ববর্তী পুল ও গয়নাঘাটা ব্রীজের ওপর বসে মানুষ খুন করে খালে ফেলতো পাক সৈন্যরা। সেইদিনের প্রত্যক্ষদর্শীদের ও মুক্তিযোদ্ধা সংগঠক সৈয়দ মনিরুল ইসলাম বুলেট ছিন্টুর বর্ননায় জানা গেছে, শত শত লোক ধরে এনে ওইসবস্থানে হত্যা করেছে পাক সেনারা।

গৌরনদী-আগৈলঝাড়ার ইতিহাসে সবচেয়ে লোমহর্ষক ঘটনা ঘটিয়েছিল ১৯৭১ সালের ১৫ মে। ১৪ মে দোনারকান্দিতে চিত্ত বল্লভের নেতৃত্বে স্থানীয় লোকজন ঢাল শুড়কী নিয়ে পাক হানাদারদের মুখোমুখি ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং ৪ জন সেনাকে কুপিয়ে হত্যা করে। এ ঘটনায় পাকসেনারা ক্ষিপ্ত হয়। কসবার হযরত মল্লিক দুত কুমার পীর সাহেবের মাজার সংলগ্ন রাস্তা দিয়ে চাঁদশী হয়ে পশ্চিম দিকে শতাধিক সেনা অগ্রসর হয়ে জনতার ওপর এলএমজির ব্রাশ মারে এবং গুলি করে পাখির মতো মানুষ মারতে থাকে। পাক সেনাদের  ভয়ে আশে পাশের ৭/৮টি গ্রামের ৪/৫ হাজার মানুষ এদিক সেদিক ছুটাছুটি করতে থাকে। রাংতার উত্তর পাশের সুবিশাল ক্যাতনার বিলে ধান ও পাট ক্ষেতের মধ্যে আশ্রয় নিতে এসে পাক বাহিনীর গুলিতে ৫ শতাধিক লোক ওইদিন প্রাণ হারায়। নর পশুদের কবল থেকে পশুরাও সেদিন রেহাই পায়নি। ওইদিন শত শত ঘর বাড়িতে অগ্নিসংযোগের ফলে বহু গরু-ছাগল ও হাস মুরগী মারা যায়। ২ আষাঢ় কোদালধোয়া নামকস্থানে দি রয়েল বেঙ্গল সার্কাসের মালিক লক্ষণ দাস ও তার ১টি পোষা হাতিকে পাকসেনারা এক সাথে গুলি করে হত্যা করে। জুলাই মাসে বাটাজোরে নিজাম বাহিনীর নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীর সাথে সম্মুখ যুদ্ধে ১০ জন পাকসেনা মারা যায় এবং ৪ জন ধরা পড়ে। পাকসেনাদের গতিরোধ করার জন্য ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কের আশোকাঠী বাসষ্ট্যান্ডের ব্রীজ মুক্তিযোদ্ধারা ভেঙ্গে দিয়েছিল অক্টোবর মাসের শেষের দিকে। মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার নিজামের নেতৃত্বে পুলটি সম্পূর্ণরূপে উড়িয়ে দেয়া হয়েছিলো। কিছুদিন পর নিজামের নেতৃত্বে হোসনাবাদে পাক বাহিনীর অস্ত্র ও মালবাহী বোটে হামলা চালিয়ে প্রচুর অস্ত্র উদ্ধার করেছিল মুক্তিবাহিনীরা। ওইদিন যুদ্ধে ২৫ জন পাকসেনা মারা যায়। মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার নিজামউদ্দিনের সাথে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য মুক্তিযোদ্ধারা হচ্ছেন গ্র“প কমান্ডার বাদশা হাওলাদার, কুতুব উদ্দিন, তাহের কমান্ডার, হামেদ কমান্ডার ও আলাউদ্দিন মিয়া। গৌরনদীর কসবায় আল্লাহর মসজিদের নিকট ২৭ নবেম্বর পাক বাহিনীর সাথে বন্দুক যুদ্ধে মোঃ ছাত্তার কমান্ডার গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন। পরেরদিন একইস্থানে দক্ষিণ চাঁদশীর আলতাফ হোসেন শহীদ হন। গৌরনদী-আগৈলঝাড়ার কৃষক শ্রমিক নেতা আব্দুর রব সেরনিয়াবাত (সাবেক মন্ত্রী), আঃ করিম সরদার (সাবেক এমএলএ) সর্বপ্রথম স্বেচ্ছাসেবক দল গঠন করেন। ওইদলের প্রধান ছিলেন গৈলার মতি তালুকদার। তার সহযোগী ছিলেন পতিহারের নুরু গোমস্তা। কোটালীপাড়ার মুক্তিযোদ্ধা হেমায়েত উদ্দিনের নেতৃত্বে গঠিত হয় হেমায়েত বাহিনী। তিনি সর্বপ্রথম এ অঞ্চলে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেন। তার নেতৃত্বে আগৈলঝাড়ার শিকির বাজার, রামশীল ও পয়সারহাটে পাক সেনাদের সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মুখে যুদ্ধ হয়। পরবর্তীতে গৌরনদীর হোসনাবাদ গ্রামের নিজামউদ্দিন আকনের নেতৃত্বে ৬০/৭০ জনের মুক্তিবাহিনীর একটি দল ভারত থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে গৌরনদী ও আগৈলঝাড়ায় আসেন। নিজাম উদ্দিন কৃতিত্বের সাথে স্বাধীনতা যুদ্ধে ৯ নং সেক্টরের সাব সেক্টর কমান্ডার হিসাবে দ্বায়িত্ব পালন করেন। সর্বশেষে মুজিব বাহিনীর একটি দল ভারত থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশে ফিরে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। ওই দলের নেতৃত্বে ছিলেন আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহ (সাবেক চীফ হুইপ)। তার চাচাত ভাই আঃ রকিব সেরনিয়াবাত, কসবার ফজলুর রহমান হাওলাদার, বিল্লগ্রামের মেজর শাহ আলম তালুকদার ছিলেন তার সহযোগী। গৌরনদী কলেজে নিজাম বাহিনী ও মুজিব বাহনীর যৌথ প্রচেষ্টায় আক্রমন চালানো হয়েছিল। পশ্চিম দিক থেকে মুজিব বাহিনী ও পূর্বদিক থেকে নিজাম বাহিনী আক্রমন করে। দীর্ঘ ২৮দিন যুদ্ধের পর পাক বাহিনীরা পরাস্ত হয়। একপর্যায়ে ২২ ডিসেম্বর মিত্র বাহিনীর মেজর ডিসি দাসের মাধ্যমে মুক্তিবাহিনীর হাতে গৌরনদী কলেজের পাক হানাদাররা আত্মসমর্প করে। স্বাধীন বাংলাদেশে সর্বশেষ হানাদার মুক্ত গৌরনদীতে ১৯৭৫ সালের ৭ মে তৎকালীন মন্ত্রী আব্দুর রব সেরনিয়াবাত “শহীদ মুক্তিযোদ্ধা স্মৃতি সৌধ” নির্মানের জন্য ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করলেও দীর্ঘ ৩৯ বছর পেরিয়ে গেলেও গৌরনদীতে আজো নির্মিত হয়নি কোন স্মৃতি সৌধ।

স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা গৌরনদীতে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতি সংরক্ষনের জন্য জরুরি ভিত্তিতে স্মৃতি সৌধ নির্মানের জন্য প্রধানমন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রনালয়ের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের হস্তক্ষেপ কামনা করছেন।