ভূয়া কাগজে তিনি প্রতিবারই সুপার

মাদ্রাসার সুপার পদে নিয়োগে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। জাল কাগজপত্র তৈরি করে, সাজানো নিয়োগ বোর্ডের মাধ্যমে  হেতালবুনিয়া দাখিল মাদ্রাসার সুপারের পদে নিয়োগলাভ করেছে ওই মাদ্রাসারই ম্যানেজিং কমিটির সভাপতির পুত্র ‘সহকারী মৌলভী’ মোঃ মুনিরুল ইসলাম। একই কায়দায় মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতরের মাদ্রাসা শাখার যোগসাজসে এমপিওভূক্ত হয়ে তিনি সাত মাসের বেতন-ভাতা বাবদ লক্ষাধিক টাকা হাতিয়েও নিয়েছেন। শিক্ষা অধিদফতরের তদন্তকালে জালিয়াতির এই চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে এসেছে। তবে এরপরেও ওই ‘সুপার’ বহাল তবিয়তেই তার দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। অন্যদিকে, মাদ্রাসার ‘প্রকৃত সুপার’ বিচারের আশায় দ্বারেদ্বারে ঘোরা ছাড়াও বেতন না পেয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, এলাকার মোঃ নুরুল ইসলামের উদ্যোগে ১৯৮৭ সালে মাদ্রাসাটি প্রতিষ্ঠিত হয়। এরপর এমপিওভূক্ত হয় ১৯৯৪ সনের ১ জুলাই। প্রতিষ্ঠার পর থেকে এমপিওভূক্তির পূর্ব পর্যন্ত প্রতিষ্ঠাতাই সুপারের দায়িত্ব পালন করেন। সুপার পদটি হাতছাড়া হবার পর থেকে একটি মহল ‘নিজস্ব লোক’ বসানোর জন্য চেষ্টা-তদবির অব্যাহত রাখে।

এ ব্যাপারে কয়েকবার উদ্যোগ নিয়েও তারা সফল হয়নি। পূর্বে উপজেলা নির্বাহী অফিসার পদাধিকার বলে মাদ্রাসার সভাপতি ছিলেন। ২০০৯ সালে পদটির দায়িত্বভার গ্রহণ করেন প্রতিষ্ঠাতা মোঃ নুরুল ইসলাম। দায়িত্ব হস্তান্তরের কিছু দিন পূর্বে ২০০৯ সালের ২৬ ফেব্র“য়ারি ‘সুনির্দিষ্ট কারণ ছাড়াই’ সাময়িক বরখাস্ত হন মাদ্রাসার সুপার মাওঃ শেখ মোঃ ওবায়দুল হক। প্রতিষ্ঠাতার সভাপতি পদে দায়িত্বগ্রহণের পর নতুন করে কুটকৌশল শুরু হয়। ভারপ্রাপ্ত সুপারের দায়িত্ব দেয়া হয় তার পুত্র মাদ্রাসার সহকারী মৌলভী মুনিরুল ইসলামকে। সাসপেন্ডের বিষয়টি নিয়ে আদালতে মামলা করেন সুপার ওবায়দুল হক। বিষয়টি বিপক্ষে যেতে পারে বুঝতে পেরে ওই বছরের ২৫ নভেম্বর ওবায়দুল হকের স্বাক্ষর জাল করে ‘পদত্যাগপত্র’ তৈরি করা হয় এবং ১০ নভেম্বরের মাদ্রাসা কমিটির সভায় তা অনুমোদন করে সুপার পদটি শূন্য ঘোষণা করা হয়।

২০১০ সালের ২৮ ফেব্র“য়ারি ‘ভূয়া নিয়োগ বোর্ড’ গঠন করে সভাপতির পুত্র মুনিরুল ইসলামকে সুপার পদে নিয়োগ দেয়া হয়। নিয়োগ বোর্ডে ঝালকাঠির জেলা শিক্ষা অফিসার, কাঁঠালিয়া উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার ও চিংড়াখালী সিনিয়র মাদ্রাসার অধ্যক্ষ ছিলেন বলে উল্লে¬¬খ করা হলেও তারা এ সম্পর্কে কিছুই জানেন না বলে জানা যায়। এর কিছু দিনের মধ্যেই শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মহাপরিচালকের দফতর থেকে গত বছরের ১০ নভেম্বর সুপার হিসেবে মুনিরুল ইসলামের নাম এমপিওভূক্ত করা হয়। সাময়িক বরখাস্তকৃত সুপার ওবায়দুল হক মাদ্রাসাটিতে দুইজন সুপার কর্মরত থাকাসহ পুরো বিষয়টি জানিয়ে গত বছরের ২০ ডিসেম্বর অভিযোগপত্র পাঠান শিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালকের কাছে। এরপ্রেক্ষিতে অধিদফতরের কমার্শিয়াল এডুকেশন সেলের অফিসার ইনচার্জ একেএম মুজিবুর রহমান গত ১৯  ফেব্র“য়ারি সরেজমিনে বিষয়টি তদন্ত করেন। এ সময় মাদ্রাসার ‘তথাকথিত সুপার’ মোঃ মুনিরুল ইসলাম লিখিতভাবে জানান যে, সুপার হিসেবে নিয়োগের কাগজপত্র সে তৈরি করেছে। এজন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে তিনি সুপার পদ থেকে তাকে অব্যাহতি দিয়ে পূর্বের পদে ফিরিয়ে নেয়ার জন্যও আবেদন জানান। ঝালকাঠির জেলা শিক্ষা অফিসার মাহাবুবা হোসেন তদন্তকারীকে জানান, ওই মাদ্রাসায় সুপার হিসেবে মুনিরুল ইসলামকে নিয়োগের ব্যাপারে তিনি কিছুই জানেন না বা তার অফিসে এ সংক্রান্ত কোন কাগজপত্র নেই।

তদন্ত কর্মকর্তা মুজিবুর রহমান গত ২৮ মার্চ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে তার প্রতিবেদন দাখিল করেন। এতে বলা হয়, হেতালবুনিয়া দাখিল মাদ্রাসার সুপার পদটি এখনও শূন্য হয়নি। কারন বর্তমান সুপার ওবায়দুল হক সাময়িক বরখাস্তকৃত। কোন সুপার সাময়িক বরখাস্ত হলে পদটি শূন্য হয় না। তিনি আরও বলেন, মুনিরুল ইসলাম কাগজপত্র তৈরি করে সুপার হিসেবে নিয়োগ লাভ করেছেন। তার এ নিয়োগ বৈধ নয়। এমপিও শিটে দুইজন সুপারের নামে বেতন ভাতা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।

এছাড়া ২০১০ সালের আগস্ট থেকে ২০১১ সালের ফেব্র“য়ারি পর্যন্ত মুনিরুল ইসলামের অবৈধভাবে নেয়া বেতন-ভাতা ফেরৎযোগ্য বলেও তিনি মন্তব্য করেন। অভিযোগে প্রকাশ, মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতার পুত্র মুনিরুল ইসলামের সুপার পদ দখলের এটা প্রথম ঘটনা নয়। এর আগেও একই ধরনের ঘটনা ঘটে। কামিল পাসের ভূয়া সার্টিফিকেট তৈরি করে ১৯৯৬ সালের ৩ ফেব্র“য়ারিও তিনি সুপারের পদটি দখল করেছিলেন। ২০০২ সালে তার এ জালিয়াতি ধরা পড়লে ওই বছরের ২৮ এপ্রিলের সভায় নিয়ম বহির্ভূত সিদ্ধান্তের মাধ্যমে তিনি ‘সহকারী মৌলভী’ পদে ফিরে যান।

এ ব্যাপারে মুনিরুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি ‘কমিটির মাধ্যমে বৈধভাবে নিয়োগ পেয়েছেন’ বলে দাবি করেন। তবে নিয়োগ কমিটির সদস্যদের অস্বীকৃতির ব্যাপারে তিনি কিছু বলতে রাজী হননি। তিনি বলেন, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কর্মকর্তা তাকে ভুল বুঝিয়ে কাগজে সই নিয়েছেন। মন্ত্রণালয়ে নতুন করে তদন্তের আবেদন করা হয়েছে।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কমার্শিয়াল এডুকেশন সেলের অফিসার ইনচার্জ একেএম মুজিবুর রহমান জানান, হেতালবুনিয়া মাদ্রাসা পরিদর্শনকালে তিনি যে সত্য পেয়েছেন তাই রিপোর্ট করেছেন। মুনিরুল ইসলাম কমিটির লোকজনের সামনে স্বেচ্ছায় লিখিতভাবে অপরাধের কথা স্বীকার করেছে। এখানে ভুল বুঝানোর প্রশ্নই উঠে না।