আমার দেখা তিন রাষ্ট্রপতি

নির্মল সেনঃ আমার জীবনে তিনজন রাষ্ট্রপতিকে দেখেছি। প্রথম হচ্ছেন বাংলাদেশের স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমান। পরের দু’জন হলেন জোরজবর দখল করা রাষ্ট্রপতি নির্মল সেনজিয়াউর রহমান ও জেনারেল এরশাদ। এ তিনজনকে এক সারিতে দাঁড় করার ইচ্ছা আমার নেই। কোনো ঘটনাক্রমে এ তিন রাষ্ট্রপতির সঙ্গে আমার সাক্ষাত্ ও কথাবার্তা হয়েছে। সেই সূত্রে লিখছি। শেখ সাহেবের বাড়ি গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায়। আমার বাড়ি কোটালীপাড়ায়। আমি টুঙ্গিপাড়া এমই স্কুলে পড়তাম। কিন্তু তখন শেখ সাহেবের সঙ্গে আমার দেখা হয়নি। পাটগাতীর বাসায় গিয়ে শুনতাম শেখ সাহেব বাড়িতে এলে আমাদের বাসায় আসতেন। তার সঙ্গে যে পুলিশ আফিসাররা আসত তারা আমাদের বাসায় থাকত। শেখ সাহেবের সঙ্গে দেখা ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনের পর। তিনি জয়লাভ করে বরিশাল গিয়েছিলেন। আমি বরিশালের রুচিরা রেস্টুরেন্টে বসে চা খাচ্ছিলাম। এমন সময় শেখ সাহেব রুচিরা রেস্টুরেন্টে ঢুকলেন। আমাকে দেখে জিজ্ঞাসা করলেন-নির্মল সেন কেমন আছেন। আমি অবাক হয়ে গেলাম। তিনি বললেন, আপনি কার্তিক সেনের বড় ভাইয়ের ছেলে। কার্তিক মামার বড় ভাইয়ের ছেলেকে আমি চিনব না, এটা কেমন কথা। আমি বললাম, আপনি ১০ হাজার ভোটে অহিদুজ্জামান ঠাণ্ডা মিয়াকে পরাজিত করেছেন, এটা কীভাবে করলেন! শেখ সাহেব বললেন, আপনারা আমাকে বিশ্বাস করতে পারেননি। আমার বিরুদ্ধে হাজার হাজার মোল্লা, মৌলভি ক্ষেপে ছিল। ফলে ফল হয়েছে উল্টো।

এর পরে শেখ সাহেবের সঙ্গে জেলে ছিলাম। তবে দেখা হয়নি। মুখোমুখি দেখা হল ছয়-দফা দেওয়ার পরে। তিনি লাহোরে গোলটেবিল বৈঠকে ছয়-দফা দিয়েছিলেন। এ গোলটেবিল বৈঠকে যাওয়া নিয়ে অনেক আন্দোলন হয়েছিল। পাকিস্তান সরকার বলেছিল আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় বন্দি হিসেবে তাকে লাহোর গোলটেবিল বৈঠকে যেতে হবে। এর বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানে তীব্র আন্দোলন হয়। আমরা আন্দোলন করি। আমাদের দাবি ছিল গোলটেবিলে যাওয়ার আগে শেখ সাহেবকে মুক্তি দিতে হবে। এ আন্দোলনের প্রধান ভূমিকায় ছিলেন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ও শেখ সাহেবের স্ত্রী শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব। শেষ পর্যন্ত শেখ সাহেব মুক্তি পান। লাহোরে গিয়ে গোলটেবিল বৈঠকে ছয়-দফা পেশ করে ঢাকা ফিরে আসেন। একদিন ধানমণ্ডিতে তাজউদ্দীনের বাসার সামনে দাঁড়িয়ে ছিলাম। এমন সময় একটি গাড়ি এল। গাড়ি থেকে শেখ সাহেব হাত নেড়ে আমাকে ডাকলেন। বললেন, আপনি তো প্রেসক্লাবে যাবেন। আমি আওয়ামী লীগ অফিসে যাব। পথে প্রেসক্লাবে আপনাকে নামিয়ে দিয়ে যাব। আমি গাড়িতে উঠলাম। শেখ সাহেবকে জিজ্ঞাসা করলাম দলের কোনো সভা না ডেকে, কারও কাছে কিছু জিজ্ঞাসা না করে আপনি ছয়-দফা দিলেন কীভাবে। জবাবে শেখ সাহেব টুঙ্গিপাড়ার ভাষায় বললেন, অতো আলোচনা করতে হয় না, হঠাত্ করে ছুড়ে দিতে হয়। এরপর আমি প্রেসক্লাবে নেমে গেলাম।

এরপর শেখ সাহেবের সঙ্গে দেখা মুক্তিযুদ্ধের পর। আমি যুদ্ধ থেকে ফিরে এসেছি। সব পত্রিকার অবস্থা বেহাল। দৈনিক পাকিস্তান দৈনিক বাংলা হয়েছে। মোনায়েম খানের পত্রিকা পয়গাম বন্ধ হয়েছে। আকরাম খানের পত্রিকা আজাদ বন্ধ হওয়ার পথে। এদিকে সাংবাদিক ইউনিয়নের নেতা শহিদুল্লাহ কায়সার ও সিরাজ উদ্দিন হোসেন শহীদ হয়েছেন। ইউনিয়নের হাল ধরার মতো কোনো নেতা নেই। সবাই বলল আপনি কনিষ্ঠ নেতা। আপনি ইউনিয়নের হাল ধরেন। আমি ও গিয়াস কামাল চৌধুরী এগিয়ে এলাম। আমাদের দায়িত্ব ছিল পত্রিকা রক্ষা করা। একদিন আমি ও গিয়াস কামালসহ কয়েকজন সাংবাদিক মিলে গণভবনে গেলাম। গণভবনে ঢুকে দেখি শেখ সাহেব দরজায় দাঁড়িয়ে আছেন। শেখ সাহেব বললেন, নির্মল সেন আমাকে না জানিয়ে আসছেন, ভাবছেন আমি জানব না। চলেন ঘরে যাই। আপনাদের কথা শুনব। আমরা ঘরে গিয়ে শেখ সাহেবকে বললাম আজাদ পত্রিকায় টাকা দিতে হবে। সেখানে সাংবাদিক-কর্মচারীরা বেতন পাচ্ছে না। মালিক পালিয়েছে। আপনি অর্থমন্ত্রীকে ফোন করে দিন। তাকে বলুন আমাদের কিছু টাকা দিতে। শেখ সাহেব তখনই অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীনকে ফোন করলেন। তিনি অর্থমন্ত্রীকে বললেন, তাজউদ্দীন আমার কাছে নির্মল সেন ও গিয়াস কামাল এসেছে। আজাদের জন্য কিছু টাকা দিতে হবে। গিয়াস কামাল চৌধুরী আমার লোক, নির্মল সেন বিপ্লবী। নির্মল সেন আমার কথা শুনবে না। তুই ওদের কিছু টাকা দিয়ে দে। এ কথা শুনে আমরা চলে এলাম। পরে আমরা টাকা পেলাম। এ হচ্ছে স্বাধীনতার পর শেখ সাহেবের সঙ্গে আমার প্রথম দেখা।

এরপর একদিন আমি আর গিয়াস কামাল চৌধুরী গণভবনে গেলাম। প্রধানমন্ত্রীর রুমে ঢুকলাম। দেখলাম অসংখ্য সচিব নিয়ে শেখ সাহেব মিটিং করছেন।

শেখ সাহেব আমাকে দেখে বললেন, নির্মল সেন বসেন। আপনার সঙ্গে অনেক কথা আছে। আপনি বড় বড় কথা লেখেন। নিজে কিছুই করেন না। আমি এ সচিবদের বদল করব। আপনি বলুন কাকে কাকে রাখব। আমি আস্তে শেখ সাহেবকে বললাম অফিসারদের সামনে এ কথা বলা ঠিক নয়। ওনাদের যেতে বলুন। শেখ সাহেব সচিবদের যেতে বললেন। সচিবরা চলে গেলেন। এরপর শেখ সাহেব বললেন, এখন বলুন তো কাকে কাকে রাখব। আমি বললাম এটা ঠিক নয়। আমি আপনার দলের লোক নই। আমি এমন কেউ নই যে, আমার কথায় আপনি কাকে কাকে রাখবেন এটা ঠিক করবেন। এ কথা বলে গিয়াস কামালকে নিয়ে চলে এলাম। এটা হচ্ছে শেখ সাহেবের সঙ্গে আমার তৃতীয় সাক্ষাত্। এরপর একদিন ভোরবেলা কাগজে দেখলাম আমার দলের এক মহিলা কর্মীর স্বামীকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। তার নাম হুমায়ুন কবীর। হুমায়ুন কবীর সিরাজ শিকদারের সর্বহারা পার্টির লোক। আমি খবরটি পড়ে হাসপাতালে ছুটে গেলাম। হাসপাতালে গিয়ে দেখি হুমায়ুনের স্ত্রী সুলতানা রেবু কাঁদছে। সে বলল, আমি খাব কি? আমার তো একটি পয়সাও নেই। আমি বললাম তুই থাম। আমি আছি। পরে আমি গণভবনে গেলাম। গণভবনে গিয়ে শেখ সাহেবের সচিব রফিকুল্লাহ চৌধুরীকে ডাকলাম। আমি বললাম শেখ সাহেবের চেক বইটা আনো। ওতে সুলতানা রেবুর নামে দুই হাজার টাকার চেক কাট। ইতোমধ্যে দেখলাম শেখ সাহেব আমার পেছনে দাঁড়িয়ে হাসছেন। তিনি বললেন, নির্মল সেন আপনি কি প্রধানমন্ত্রী হয়ে গেছেন। আমি শেখ সাহেবকে বললাম টাকা দিতে হবে। টাকা না দিলে মেয়েটি না খেয়ে থাকবে। এ মামলা কতদিন চলবে জানি না। যতদিন চলবে ততদিন টাকা দিতে হবে। শেখ সাহেব আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন মেয়েটি কি রাজনীতি করে? আমি বললাম হ্যাঁ। শেখ সাহেব বললেন রফিকুল্লাহ চেকটা দিয়ে দে। এ হচ্ছে শেখ মুজিবুর রহমান। এক মহত্ হূদয়ের অধিকারী। এরপর আসি নিজের দলের কথায়। একদিন পার্টি অফিসে বসে আছি। এমন সময় খবর এল আমি রায়েরবাজারে যে বাড়িতে পালিয়ে ছিলাম সে বাড়িতে অনেক অস্ত্র পাওয়া গেছে। আমি ভাবলাম আমার সঙ্গে অনেক মুক্তিযোদ্ধা পালিয়েছিল তারা হয়তো অস্ত্রগুলো রেখে গেছে। আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। পরের দিন শেখ সাহেবের কাছে গেলাম। বললাম এখন কী হবে। শেখ সাহেব বললেন, আমি সবকিছু দেখে আসি। আপনি পরে আসুন। পরের দিন আবার শেখ সাহেবের কাছে গেলাম। শেখ সাহেব আমাকে দেখে চিত্কার করে বললেন, ওরে বাবা এত অস্ত্র! এ অস্ত্র দিয়ে তো ঢাকা দখল করা যায়। আমি বললাম এটা পরে দেখা যাবে। আমার নেতা যাতে গ্রেফতার না হয় তার ব্যবস্থা করুন। যার বাড়িতে অস্ত্র পাওয়া গেছে সে আমার দলের নগর সম্পাদক। আমার কথা শুনে আইজিকে ফোন করলেন। বললেন, রুহুল আমিন কায়সার, সিদ্দিকুর রহমান, মিছির আহম্মেদ ভূঁইয়া ওরা যেন কেউ গ্রেফতার না হয়। আমি চলে এলাম। এরপর মামলা চলল। যারা গ্রেফতার হয়েছিল তারা জামিন পেল। কিন্তু প্রধান আসামি মোহাম্মাদ হোসেন ধরা পড়েনি। একদিন আমি গণভবনে গিয়ে রফিকুল্লাহ চৌধুরীকে বললাম, পুলিশকে বল আমার কেস নিয়ে যেন বেশি হইচই না করে। এর পরদিন আমি গণভবনে যাওয়ামাত্র রফিকুল্লাহ চৌধুরী বললেন, আপনার জন্য আমাকে কথা শুনতে হয়েছে। আমি পুলিশকে আপনার কথা বলার পর পুলিশের আইজি, ডিআইজি, এসপি মিছিল করে গণভবনে আসেন। তারা বলেছেন, নির্মল সেনের বিরুদ্ধে হাজার চিঠি আছে। আমরা এ মামলা ছাড়ব না। তাই শেখ সাহেব রফিকুল্লাহকে তিরস্কার করেছেন। এরপর অনেক দিন কেটে গেল। মোহাম্মাদ হোসেন ধরা পড়েনি। একদিন শেখ সাহেব আমাকে ডাকলেন। বললেন, নির্মল সেন আমার কথা শুনুন আপনি আরএসপি করেন। কলকাতা ধর্মতলা স্ট্রিটে আরএসপির অফিস আছে। আমি সবাইকে চিনি। আপনি মোহাম্মাদ হোসেনকে আরএসপি অফিসে পাঠিয়ে দিন। ছয় মাস পরে ফিরে এলে পুলিশ সব ভুলে যাবে। তখন মামলা থাকবে না। আমি বললাম, কোন পথে মোহাম্মাদ হোসেন ভারতে যাবে। সীমান্ত পাড়ি দিবে কীভাবে। শেখ সাহেব বললেন, আসাম সীমান্ত দিয়ে যাবে। ওখানে আরএসপির সংগঠন আছে। আমি অবাক হয়ে প্রধানমন্ত্রীর দিকে তাকিয়ে রইলাম। একজন প্রধানমন্ত্রী একজন আসামিকে বাঁচানোর জন্য বিদেশে পাঠানোর পরামর্শ দিচ্ছেন। ভাবলাম একি মানুষ, না দেবতা। এ হচ্ছে শেখ মুজিবুর রহমানের অন্য রূপ। এ রূপ আমি ছাড়া অন্য কেউ দেখেনি। সেই দিন অবাক বিস্ময়ে শুধু তাকিয়ে শেখ সাহেবকে দেখা ছাড়া আমার আর কিছু করার ছিল না। ছয় মাস পর মোহাম্মাদ হোসেন কলকাতা থেকে ফিরে এল। কিন্তু পুলিশ তাকে গ্রেফতার করবেই। পরবর্তীকালে আর এক কাহিনী। সে কাহিনীতে শেখ সাহেব মোহাম্মাদ হোসেনের মামলা প্রত্যাহারের ব্যবস্থা করলেন। জানা গেল মোহাম্মাদ হোসেনের বাড়িতে যে অস্ত্র পাওয়া গিয়েছিল তা তার সীমানায় নয়। পাশের বাড়ির এক ইঞ্জিনিয়ারের বাড়ির সীমানায়। ইঞ্জিনিয়ারের বাড়ির সীমানা নিয়ে মোহাম্মাদ হোসেনের বিরোধ ছিল। তাই ইঞ্জিনিয়ার সাহেব মোহাম্মাদ হোসেনকে মামলায় জড়িয়েছিল।

এরপর আসি জবরদখলের কাহিনীতে। জিয়াউর রহমান সম্পর্কে আমার ধারণা ভালো ছিল না। তিনি সেনাবাহিনীর লোক। এদিন সেনাবাহিনীর এক লোক এসে জিয়াউর রহমানকে বলল শেখ সাহেব নিহত হয়েছেন। তখন জিয়া সেভ করছিলেন। জিয়া বললেন তাতে কি হয়েছে। ভাইস প্রেসিডেন্ট আছেন। এ কথা শুনে আমার মনে হয়েছিল জিয়াউর রহমান কঠিন হূদয়ের মানুষ। তিনি নিজের স্বার্থে সব কিছু করতে পারেন। জিয়াউর রহমানের সঙ্গে আমার প্রথম সাক্ষাত্ প্রেসক্লাবে। এক ভোজসভায়। প্রেসক্লাবের তখন সভাপতি এনায়েত উল্লাহ খান। তার ইচ্ছা ছিল জিয়াউর রহমানের কাছে যাওয়া। এ জন্য তিনি ভোজসভার আয়োজন করেন। ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি এ ভোজসভায় আসেননি। ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি হিসেবে আমাকে ভোজসভায় আসতে হয়েছিল। ভোজসভা শেষে একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়েছিল। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে স্পন্দন শিল্পীগোষ্ঠী গান গেয়েছিল। জিয়া আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন কেমন লাগছে এ অনুষ্ঠান। আমি বললাম মোটেও ভালো লাগছে না। তখন তিনি তথ্য সচিব গোলাম মোস্তফাকে ডেকে বললেন, কালকে নির্মল বাবুকে আমার খাল কাটা বিপ্লব দেখিয়ে আনো। পরের দিন এনায়েত উল্লাহ খানসহ কয়েকজন সাংবাদিক হেলিকপ্টারে চড়ে রাজবাড়ী জেলার গোয়ালন্দের উজানচরে গেলাম। সেখানে গিয়ে এনায়েত উল্লাহ খান কোদাল দিয়ে মাটি কাটতে শুরু করল। পরের দিন ঢাকায় ফিরে লিখেছিলাম অর্থহীনভাবে কয়েক গ্যালন পেট্রল পুড়িয়ে আমাদের হেলিকপ্টারে উড়িয়ে উজানচরে নেওয়া হয়েছিল। এর পরে জিয়ার সঙ্গে আমার সম্পর্ক শীতল হয়। কয়েকদিন পর আমাদের ইউনিয়নের চার নেতাকে জিয়াউর রহমান ডেকে পাঠালেন। আমি, গিয়াস কামাল চৌধুরী, কামাল লোহানী ও রিয়াজ উদ্দিন আহম্মেদ জিয়াউর রহমানের কাছে গেলাম। জিয়াউর রহমান আমাদের বললেন, জার্নালিস্টদের ট্রেনিংয়ের জন্য একটি জার্নালিস্ট ইনস্টিটিউশন করতে হবে। আমি বললাম, জার্নালিস্ট ইনস্টিটিউশন নয়। ওটার নাম হবে প্রেস ইনস্টিটিউট। তিনি বললেন, যা ইচ্ছা আপনারা করেন। আমি আপনাদের সব ব্যাপারে সাহায্য করব। এই বলে তিনি দরজার দিকে গেলেন। আমি বললাম, জেনারেল সাহেব আপনি সব করবেন এটা আপনি বলতে পারেন না। এটা বলতে পারতেন শেখ সাহেব। তবে শেষ পর্যন্ত প্রেস ইনস্টিটিউট জিয়াই করেছিলেন। এরপর জিয়াউর রহমানের সঙ্গে অনেকবার বঙ্গভবনে দেখা হয়েছে। তিনি আমাকে দেখলে তার স্ত্রীকে ডাক দিতেন। বলতেন খালেদা দেখো তো নির্মল সেন বিয়ে করে না কেন। বিয়ের কি কোনো খরচ লাগবে। আমি দেব। আমি বলতাম আপনার টাকায় আমি বিয়ে করব কেন। এ ধরনের কথাবার্তা প্রায়ই আমার সঙ্গে হতো। একদিন আমরা চার নেতা জিয়াউর রহমানের কাছে বঙ্গভবনে গেলাম। আমরা কতগুলো দাবি পেশ করলাম। তিনি বললেন, আমি সব দাবি মেনে নেব। কিন্তু আপনি বলেন বিয়ে করেননি কেন? এর মধ্যে জিয়াউর রহমানের প্রেস সচিব আমার কাছে এলেন। তিনি বললেন, প্রেসিডেন্ট বুখারেস্টে যাবেন। আপনি তার সঙ্গে যাবেন। আমি বললাম না। একজন সামরিক প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সাংবাদিক হিসেবে যেতে পারি না। তিনি বললেন, আপনার পত্রিকার সম্পাদক শামসুর রাহমানের প্রতিনিধি হিসেবে আপনি যাবেন। আমি বললাম তা হয় না। যার প্রতিনিধি হিসেবেই যাই না কেন আমি বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি হিসেবে পরিচিত হব। লোকে বুঝবে বাংলাদেশের সাংবাদিকরা সামরিক প্রেসিডেন্টকে সমর্থন করেন। আমার কথা শুনে তার মুখখানা কালো হয়ে গেল। এটাই ছিল জিয়াউর রহমানের সঙ্গে আমার শেষ দেখা। মাঝেমধ্যে দু-একবার দেখা হলে রসিকতা করে বিয়ের কথা জিজ্ঞাসা করতেন।

এরপর এরশাদের কথা। এরশাদ ক্ষমতায় এলেন। এরশাদের ক্ষমতায় আসা নিয়ে রাশেদ খান মেননের সঙ্গে আমার বিতর্ক হয়। তার ভাই তখন মন্ত্রী। তিনি বলেছেন এখনই এরশাদ ক্ষমতা দখল করবেন। আমি বললাম, বাজেটের আগে এরশাদ ক্ষমতা দখল করবেন না। মেননের কথা সত্য হল। এরশাদ তখনই ক্ষমতা দখল করলেন। আমরা সবাই পালিয়ে বাঁচলাম। এরশাদ সাহেব অনেক চেষ্টা করেছিলেন রাজনীতিবিদদের টাকা দিয়ে কিনতে। একদিন তার এক কর্নেল সিদ্দিক সাহেবের বাসায় আমার সঙ্গে দেখা করতে এলেন। আলাপ ভালোই হল। সে কর্নেল বলল, এরশাদ সাহেবের সঙ্গে আপনার আলাপ করতে হবে। আমি বললাম, আলাপ করতে পারি, তবে এরশাদকে আমার বাসায় আসতে হবে। আমি কারও বাসায় যাব না। এর মধ্যে আন্দোলনে ৮ দল, ৭ দল, ৫ দল সৃষ্টি হয়েছে। এরশাদ প্রস্তাব দিলেন তার সঙ্গে আলাপ করার। আমরা দুদিন আলাপ করতে গেলাম। আমি দ্বিতীয় দিন বললাম এরশাদ সাহেব আপনাকে আগে পদত্যাগ করতে হবে। মার্শাল ল’ উঠিয়ে দিতে হবে। এরশাদ বললেন কোন আইনে মার্শাল ল’ তুলে নেব। আমি বললাম মার্শাল ল’ ঘোষণায় এ বি সি ডি ই-তে আছে যেকোনো সময় মার্শাল ল’ তুলে নেওয়া যাবে। এরপর এরশাদ বললেন, আমার সেনাবাহিনীর কী হবে? আমি বললাম, আমাদের শ্রমিক, কৃষক, জনতার কী হবে? এমন সময় কমিউনিস্ট পার্টির সম্পাদক কমরেড ফরহাদ বললেন, প্রেসিডেন্ট সাহেব একটা মীমাংসা করা যায়। হঠাত্ শেখ হাসিনা উঠে বললেন, নির্মলদা যা বলেছে ওটাই ঠিক। মিটিং ভেঙে গেল। আমরা চলে এলাম। তখন এরশাদ ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন করেছিলেন। আমরা ঠিক করলাম নির্বাচন করব না। একদিন একজন আর্মি অফিসার আমার কাছে এল। সে একটি পত্রিকার সম্পাদক। পত্রিকাটির নাম বাংলাদেশ। ইংরেজিতে ছাপা হয়। পত্রিকাটি সামরিক বাহিনীর মুখপত্র। আমাকে বলল, আপনি একটি প্রবন্ধ লিখবেন। আমার চোখে বাংলাদেশ। আর ওপার বাংলার মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু লিখবেন। সে পত্রিকায় আমি লিখেছিলাম। জ্যোতি বাবু লিখেছিলেন। আমাদের দু’জনার ছবি দিয়ে লেখা দুটো ছাপা হয়েছিল। ওই সম্পাদকের সঙ্গে একটি ছেলে এসেছিল। ছেলেটি আওয়ামী লীগ নেতা মহিউদ্দিন আহম্মেদের। ছেলেটি পরে একদিন আমাকে বলল, চাচা ওটা ছিল আপনার বিরুদ্ধে একটি ষড়যন্ত্র। ভেবেছিল আপনি এমন কিছু লিখবেন যা দিয়ে আপনাকে ফাঁসিয়ে দেওয়া যায়। কিন্তু সরকার ব্যর্থ হয়েছে।

এরপর একদিন বাসায় বসে আছি। ভোরবেলা দেখলাম কাজী এনামুল আমার ঘরে ঢুকছে। এনামুল বলল, তুমি কি নির্বাচন করবে? সরকার হাসিনার সঙ্গে কথা বলেছে। নির্বাচন করলে তুমি এক কোটি টাকা পাবে। হাসিনা পাবে দুই কোটি। এর মধ্যে ফোন বেজে উঠল। এনামুল কাজীকে সেনাবাহিনী থেকে ফোন করা হয়েছে। হাসিনার সঙ্গে বৈঠক ভেঙে গেছে, তুমি চলে আস। আমি আমার বাবুর্চি আবদুর রফকে বললাম, তুমি এনামুলকে পথ দেখিয়ে দাও। এনামুলকে বললাম, ধন্যবাদ তুমি যাও। এরশাদের পর্ব এখানেই শেষ। এরশাদের আমলে আমি নয় মাস জেলে ছিলাম। আন্দোলনের মুখে আমাকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছে।