শেয়াল-কুকুরে লাশের গন্ধ ছড়াতো – সন্ধ্যায় শুরু হতো গুলির আওয়াজ

গৌরনদী সংবাদদাতাঃ “চোখের সামনে আজো ভেসে ওঠে শুধু লাশ আর লাশ। প্রতিদিন সন্ধ্যায় নারী-পুরুষদের একত্রে বেঁধে গুলি করে হত্যা করতো হায়নার দলেরা (পাক সেনারা)। একপর্যায়ে লাশগুলো পঁচে গন্ধ হয়ে যায়। শেয়াল, কুকুর ও কাকে নারী-পুরুষদের লাশগুলোর গন্ধ ছড়াতো। একটি মুহুর্তে লাশের গন্ধে বাড়ি ঘর ছাড়ার উপক্রম হয়ে দাঁড়ায়। তখন গ্রামবাসীর অনুরোধে রশি দিয়ে বাঁধা লাশগুলোর রশি খুলে ভাসিয়ে দিতাম গয়নাঘাটার খালে। এভাবেই প্রায় তিন শতাধিক নারী-পুুরুষের লাশ ভাসিয়ে দিয়েছি খালের পানিতে। অনেক চড়াই উৎরাইয়ের পর স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা ও মুজিব বাহিনীর যৌথ আক্রমনের একপর্যায়ে ১৯৭১ সনের ২২ ডিসেম্বর গৌরনদী কলেজে অবস্থানরত শতাধিক পাক সেনারা আত্মসমর্পন করেছিলো স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা ও মিত্র বাহিনীর কাছে। ’৭১-র জুলাই মাসের শেষের দিকে পাক সেনারা কাঠিরা থেকে ২১ জনকে ধরে এনে একত্রে বেঁধে গুলি করে হত্যা করে। এরমধ্যে নেপাল মিস্ত্রি নামের এক যুবককে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় খালের পাশ থেকে উদ্ধার করে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে নৌকাযোগে পৌঁছে দিয়েছিলাম তার বাড়িতে। আর এ কারনেই পাক মিলিটারীরা আমাকে তাদের ক্যাম্পে ধরে নিয়ে তিনদিন বেঁধে রেখে চালিয়েছিলো অমানুষিক নির্যাতন। জীবন বাঁচাতে সেদিন নাম লিখিয়েছিলাম রাজাকারের খাতায়। রাজাকারের খাতায় নাম লিখিয়েছিলাম ঠিকই, কোনদিন কাউকে উপকার ছাড়া ক্ষতি করিনি। পাক সেনাদের রোষানল থেকে কৌশলে নিকট আত্মীয় পরিচয় দিয়ে রক্ষা করেছি দক্ষিন পালরদী গ্রামের দিলীপ দাস, আশোকাঠী গ্রামের মানিক সরদার, বানিয়াশুরী গ্রামের হাচেন সিকদার, কালনা গ্রামের মোসলেম সরদারের সুন্দরী স্ত্রী মনোয়ারা বেগমসহ অনেক মা-বোনকে। পাক সেনাদের ক্যাম্প থেকে চুরি করে ২টি রাইফেল, ৩’শ রাউন্ড গুলি ও ২ বক্স গ্রেনেড দিয়েছিলাম দক্ষিণ বিজয়পুর গ্রামের খ্রীষ্টসম্প্রদায়ের মুক্তিযোদ্ধা রাফেল ও তার সহযোদ্ধাদের কাছে। ভয়ঙ্কর সেই দিনগুলির কথা আজো ভুলতে পারিনি। ভয়াবহ সেইদিনের কথা মনে পরলে আজো কেঁদে বুক ভাসাই” বলেই হু..হু করে কেঁদে ফেলেন বরিশালের গৌরনদী উপজেলার উত্তর বিজয়পুর গ্রামের রোগাক্রান্ত আব্দুল মালেক সিকদার ওরফে রাজাকার মালেক (৭২)।

রোগাক্রান্ত শরীর নিয়ে রিকসার প্যাডেল চেঁপে কোন একমতে অর্ধাহারে অনাহারে পরিবার পরিজন নিয়ে বেঁচে আছেন তিনি। ক্ষোভের সাথে বলেন, আমি রাজাকার আব্দুল মালেক স্বাধীনতা যুদ্ধে কাউকে উপকার ছাড়া ক্ষতি করেছি একথা এখনো যদি কেউ বলতে পারেন তাহলে দেশের প্রচলতি আইনে আমার বিচার করা হোক। নতুবা কেন সরকারি সকল প্রকার সাহায্য সহযোগীতা থেকে আমাকে ও আমার পরিবারকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। কেন অর্থাভাবে আমি আজ বিনাচিকিৎসায় ধুঁকে ধুঁকে জীবন কাটাচ্ছি। এর কি কোন সঠিক উত্তর কারো কাছে আছে।

একান্ত আলাপকালে আব্দুল মালেক সিকদার আরো জানান, ৭১’র মে মাসের প্রথম দিকে সরকারি গৌরনদী কলেজে পাক সেনারা স্থায়ী ক্যাম্প স্থাপন করে (ওই ক্যাম্পের পিছনেই মালেক সিকদারের বাড়ি)। তখন মালেক সিকদার ও তার পিতা ইসাহাক আলী সিকদার রিকসা চালক। তাদের বাড়ির পার্শ্বের হাতেম পিয়নের বাড়ির সম্মুখের ঘাটলা ও তার পাশ্ববর্তী স্থানের গয়নাঘাটা খাল পাড়ে বসে পাক সেনারা প্রতিদিন সন্ধ্যায় নিরিহ গ্রামবাসীদের ধরে এনে গুলি করে হত্যা করতো। ওইখানে (গয়নাঘাটা খাল পাড়ে) এতদাঞ্চলের প্রায় সহস্রাধীক নারী-পুরুষকে পাক সেনারা হত্যা করেছিলো। পাক সেনাদের প্রত্যক্ষ ভাবে সহযোগীতা করে স্থানীয় উমার আলী, গোলাপ খান, সালাউদ্দিন, ছালাম খান, লালু খানসহ প্রায় অর্ধশতাধিক রাজাকাররা।

আট ডিসেম্বর রাজাকার আব্দুল মালেক সিকদার কৌশলে ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট (ইপিআর)’র ৩০ জন সদস্য নিয়ে বাবুগঞ্জের মুক্তিযোদ্ধার গ্রুপ কমান্ডার ওহাব খান ও আব্দুল মজিদ মিয়ার কাছে অস্ত্র ও গোলাবারুদ নিয়ে আত্মসমর্পন করেছিলেন। দেশ স্বাধীনের পর তাদের কারাগারে পাঠানো হয়। দীর্ঘ ৫ বছর কারাভোগের পর স্বাধীনতার স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাধারন ক্ষমায় আব্দুল মালেক সিকদার জেল থেকে মুক্তি পায়। স্বাধীনতার ৪০ বছর পেরিয়ে গেলেও গয়নাঘাটা খাল পাড়ের বধ্যভূমিটি এখনো সংরক্ষণসহ সেখানে কোন স্মৃতিস্তম্ভ নির্মান না হওয়ায় তিনি তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেন।