গৌরনদীতে মুক্তিযোদ্ধার পরিবারকে নির্যাতনের অভিযোগ

গৌরনদী ডটকম ॥ বরিশালের গৌরনদী উপজেলার বাটাজোর গ্রামে অসহায় চাচাতো বোনের পরিবারকে ফিল্মি স্টাইলে তার বাড়িঘর থেকে উচ্ছেদ করে ঘরবাড়ি লুট ও দখল করে নেয়ার ঘটনায় থানায় মামলা হলেও পুলিশ ওই এলাকার মালেক খান নামের এক লাঠিয়ালকে আজো গ্রেফতার করতে পারেনি। ওই লাঠিয়াল ও তার বাহিনীর কাছে জিম্মি হয়ে পরেছে এলাকার নিরিহ বাসিন্ধারা। লাঠিয়াল বাহিনীর ভয়ে মুখ খুলতে পারছেনা নির্যাতিত সংখ্যা লঘুরা। একটি মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের উপর চালানো হয়েছে নগ্ন হামলা। মালেক খাঁর ভয়ংকর উত্থানে বিপর্যস্ত হয়ে পরেছে ওখানকার সামাজিক পরিবেশ বলে দাবী করেছেন এলাকাবাসি।

সরেজমিনে বাটাজোর গ্রাম ঘুরে স্থানীয় জন প্রতিনিধি ও নানা শ্রেনী পেশার মানুষের সাথে কথা বলে জানাগেছে, ওই গ্রামের এক সময়কার প্রতাপশালী লাঠিয়াল ছিলেন গফুর খাঁ ও কালু খাঁ নামের দুই সহোদর। স্থানীয় বৃত্তশালী লোকদের হুকুমে অন্যের জমি জোর পূর্বক দখল করে দেয়াসহ বিত্তশালীদের ভারাটে লাঠিয়াল হিসেবে কাজ করত তারা। ৪৭ এর দেশ বিভাগ ও ৭১ এর স্বাধীনতা অর্জনের পর ওই এলাকার সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের ফেলে যাওয়া সম্পত্ত্বি ডিক্রি করার প্রতিযোগীতায় লিপ্ত হয় ওই এলাকার ধর্নাঢ্য ও বৃত্তশালী রহমালী খলিফা ও তার প্রতিপক্ষরা। সে সময় রহমালী খলিফার ডিক্রির জমি দখলে রাখার জন্য ভাড়া করা হয় ওই এলাকার সেরা লাঠিয়াল কালু খাঁ’কে। কালু খাঁ রহমালী খলিফার নিরাপত্ত্বাসহ তার ডিক্রির জমি দখলে রাখার দায়িত্ব পালন করত। এ কারনে রহমালী খলিফা বাটাজোর বাসষ্ট্যান্ড সংলগ্ন একটি ডিক্রির জমিতে ঘর তুলে কালু খাকে তার পরিবারসহ থাকতে দেন। একটি মাত্র কন্যা সন্তান আলিমন বেগমকে রেখে বিগত ১৬/১৭ বছর পূর্বে কালু খাঁ মারা যান। কালু খাঁ’র মৃত্যুর পর তার ওই সম্পত্ত্বির উপর লোলুপ দৃষ্টি পরে তার ভাই লাঠিয়াল গফুর খাঁ’র পুত্র ভ্যান চালক লাঠিয়াল মালেক খাঁ’র। চাচার মৃত্যুর পর তার সম্পত্ত্বি আত্ত্বসাতের জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে সে। গত ৬/৭ বছর পুর্বে চাচাতো বোন আলিমনকে জোর পূর্বক বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করে বাড়িটি দখল করে নেয় ভ্যান চালক লাঠিয়াল মালেক খাঁ। এর পর ওই বাড়িটিকে জুয়ার আড্ডা, গাঁজা মদের আসর ও অসামাজিক কার্যকলাপের আখড়া হিসেবে গড়ে তোলে লাঠিয়াল মালেক। এর মধ্য দিয়েই অর্থনেতিক স্বচ্ছলতার পাশাপাশি ক্রাইম জগতে প্রবেশ ঘটে মালেক ও তার দুই পুত্র কাওছার (২৫) ও জুলহাস (২০) এর। তারা এলাকায় চুরি ডাকাতিসহ নানা অপকর্মে লিপ্ত হয়ে বিপর্যস্ত করে তোলে ওখানকার সামাজিক পরিবেশ। তাদের অসামাজিক কর্মকান্ডে বাঁধা দিতে গিয়ে ও সমালোচনা করে নির্যাতিত হয়েছে প্রতিবেশী সংখ্যালঘু কৃষক সুধীর চন্দ্র দাস ও শ্যামল চন্দ্র দাসের পরিবার। মালেকের বাহিনীর ভয়ে মুখ খুলতে সাহস পাচ্ছেনা তারা। গত বুধবার দুপুরে সুধীর দাসের নিজ বাড়িতে বসে স্থানীয় সাংবাদিকদের সাথে কথা হয় সুধীর দাসের স্ত্রী রাধারানী দাসের। এ সময় তাকে বেশ আতংকিত হতে দেখা যায়। ভয়ে জড়োসড়ো অবস্থায় তিনি সাংবাদিকদেরকে বলেন, ওরা আমাদের কোন ক্ষতি করেনা। ওদের সাথে আমাদের সম্পর্ক ভাল। একটু পরে প্রতিবেশী বীর মুক্তিযোদ্ধা খালেক বিশ্বাসের বাড়ীর উঠোনে বসে কথা হয় শ্যামল দাসের স্ত্রী খুকু রানী দাসের সাথে। আলাপের শুরুতেই তিনি সাংবাদিকদের কাছে অভিযোগ করেন তাদের বাড়ির সাথে মালেকের চাচা কালু খাঁর বাড়ির সিমানা। এ সুবাদে মালেক ও তার পরিবারের সদস্যরা শ্যামলদের সিমানায় ঢুকে গাছ লাগায় ও নিজেদের সিমানায় ঘর বাড়ী তুলতে গেলে তাদেরকে বাধা দেয়। জীবন নাশের হুমকীসহ নানা প্রকার ভয় ভীতি দেখায়। খুকু রানী দাস এ সময় সাংবাদিকদের কাছে জানতে চান তার বড় জা রাধারানী দাস ওদের সম্পর্কে কি বলেছে ? ওরা তাদের কোন ক্ষতি করেনা। ওদের সাথে তাদের সম্পর্ক ভাল, তার বড় জা’এর এমন বক্তব্য শোনার পর খুকুরানী দাস ভয়ে কুকড়ে যান। পরে তিনি বলেন দেখুন আমার বড় যিনি এবং বেশী নির্যাতিত যিনি তিনিই যদি ভয়ে চেপে যান তবে আমি আপনাদেরকে যা বলে ফেলেছি এর পর আর আমি কিছু বলতে সাহস পাচ্ছিনা। আমাকে মাপ করবেন। এ সময় তাকে ভিশন আতংকিত মনে হচ্ছিল। স্থানীয় সাংবাদিকরা অনেক অভয় দিয়েও আর তার মুখ খোলাতে পারেননি। এর পর কথা হয় মালেক খা’র প্রতিবেশী বীর মুক্তিযোদ্ধা খালেক বিশ্বাস ও তার পুত্র মামুন বিশ্বাসের সাথে।

তারা জানান, চুরি, ডাকাতি, মদ, গাঁজা, জুয়ার আড্ডা, নারী দেহের ব্যাবসাসহ হেন অপকর্ম নেই যা মালেক খাঁ তার পুত্র ও তাদের বাহিনী করেনা। মালেক ও তার দুই পুত্র দিনের বেলায় নসিমন ও মাইক্রো বাস চালায়, আর রাত হলেই জুয়া, মদ, গাঁজার আড্ডা জমায়। আর মালেকের স্ত্রী নাজমা বেগম জুয়ার আড্ডার টাকা তোলা ও নারী দেহের ব্যাবসার সর্দারনীর দায়িত্ব পালন করে। তাদের এ অপকর্ম সহ্য করতে না পেরে বাড়িতে সিমানা বাউন্ডারী দেয়ায় ক্ষিপ্ত হয়ে মালেকের পরিবার গত ২৬ নভেম্বর মুক্তিযোদ্ধা খালেক বিশ্বাসের পুত্র মামুন বিশ্বাস (৩০) এর উপর হামলা চালিয়ে তাকে এলোপাতারী কুপিয়ে আহত করে। এ ব্যাপারে ওই দিনই গৌরনদী থানায় একটি মামলা দায়ের করা হলেও অদৃশ্য শক্তির ইশারায় পুলিশ আসামীদেরকে আটক বা গ্রেফতার করেনি। এরই মধ্যে ওখানে হাজির হন মালেক খাঁ ও তার বাহিনীর নিষ্ঠুরতার শিকার তার চাচাতো বোন আলিমন বেগম। তিনি জানান, ৬/৭ বছর পূর্বে ওই মালেক খাঁ তাকে তাড়িয়ে দিয়ে ওই বাড়ি দখল করে নেয়ার পর তিনি স্বামী সন্তান নিয়ে আশ্রয় নেন তার পিতা কালু খানের একই গ্রামের পৈত্রিক ভিটায়। সেখানে স্বামী সন্তান নিয়ে বেশ সুখেই কাটছিল তার দিন। কিন্তু গত ১১ ডিসেম্বর সকাল ১০ টার দিকে মালেক খা তার বাহিনী নিয়ে চড়াও হয় চাচাতো বোন আলিমনের সর্বশেষ আশ্রয়স্থল তার পিতার পৈতিক ভিটায়। একেবারে ফিল্মি স্টাইলে তারা আলিমনের ঘরবাড়ি লুট ও দখল করে নিয়ে তার পরিবারকে বাড়িঘর থেকে উচ্ছেদ করে দেয়। পরে স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান ও মেম্বরের পরামর্শে থানা পুলিশের সহয়তায় ঘটনার দু’দিন পর মালেক খাঁ ও তার বাহিনীকে হটিয়ে বাড়িটির দখল বুঝে পান আলিমন। কিন্তু ঘরের লুট হয়ে যাওয়া স্বর্নালংকার ও মালমাল আজও বুঝে পাননি তিনি। এ ব্যাপারে থানায় মামলা দায়ের করা হলেও পুলিশ আসামীদের গ্রেফতার করছেনা বলে আলিমন অভিযোগ করেন। শুক্রবার দুপুরে বাটাজোর গ্রামের খাঁ বাড়িতে আলিমনের পৈত্রিক ভিটায় বসে কথা হয় ওই বাড়ির ৬৫ বছরের বৃদ্ধ কৃষক সোনামদ্দি খাঁ’র সাথে তিনি অভিযোগ করেন, মালেক খা অত্যান্ত বাজে স্বভাবের এক ভয়ংকর লাঠিয়াল। গায়ের জোরে সে ওই বাড়িতে রাম রাজত্ব কায়েম করতে চায়। এ সময় তার বক্তব্যকে সমর্থন জানিয়ে এই বাড়ির গৃহবধু রোজিনা বেগম (৫৫) শিফা বেগম (১৯) পারুল বেগম (৪০) বলেন মালেক খাঁ অতি জঘন্য একটি খারাপ লোক তাকে পুলিশ নিয়ন্ত্রন না করলে আলিমনদের পরিবারসহ এই বাড়ির অনেককেই তার বাহিনীর হাতে লাশ হতে হবে।

একই দিন দুপুরে বাটাজোর বাসষ্ট্যান্ডে বসে কথা হয় বাটাজোর ইউপির ৪ নং ওয়ার্ডের সাবেক সদস্য মো ইদ্রিস সরদারের সাথে। মালেক খাঁ কেমন লোক জানতে চাইলে তিনি বলেন, অপরাধ জগতের যত প্রকার শাখা প্রশাখা রয়েছে তার সব শাখায়ই মালেক ও তার বাহিনীর বিচরন রয়েছে, কিন্তু ভয়ে ওদের বিরুদ্ধে কেউ মুখ খুলছেনা এ কারনে ওদের অপরাধ কর্মকান্ড গুলো প্রকাশ পায়না। এর পর ওই বন্দরে বসে কথা হয় বাটাজোর ইউপি চেয়ারম্যান মোঃ আকতার হোসেন বাবুলের সাথে। তিনি জানান, মালেক খাঁ এলাকার কাউকে মানেনা। সে নিজে যেটা বোঝে সেটাই করে। তার কাছে আইন-কানুন, নিয়ম শৃঙ্খলার কোন বালাই নেই। গায়ের জোর ও নিজ বাহিনীর জোড়ই তার কাছে আইন। জানিনা তার পেছনে কোন অদৃশ্য শক্তি কাজ করছে। তা না হলে ফিল্মি ষ্টাইলে আলিমনের বাড়ি দখল ও ঘরের মালামাল লুটপাট করার পরও সে বীর দর্পে এলাকায় ঘুরে বেড়ায় কি করে। এত বড় একটি অপরাধ সংঘটিত করার পরও পুলিশ তাকে কিছু বলছে না। একটি সভ্য সমাজে এটা দেখাতো ভাল কল্পনা করাও কঠিন। মালেক খার অপকর্মের ব্যাপারে পুলিশের নিরব ভূমিকা নিয়ে এলাকাবাসীর অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে গৌরনদী থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মোঃ আবুল কালাম বলেন, আলিমনের ঘর বাড়ি দখল ও তার পরিবারকে উচ্ছেদের খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌছে আলিমনের ঘর বাড়ি দখল মুক্ত করে দেয় ও আসামীদের বিরুদ্ধে মামলা গ্রহন করে। মুক্তিযোদ্ধা খালেক বিশ্বাসের পরিবারের উপর হামলার ঘটনায়ও লাঠিয়াল মালেক গংদের বিরুদ্ধে একটি মামলা নেয়া হয়েছে মামলা দুটি বর্তমানে তদন্তাধীন আছে। অতি শীঘ্রই মামলা দুটির আসামিদের বিরুদ্ধে চার্জশীট দেয়া হবে।