বরিশালের বধ্যভূমি’র স্মৃতি কথা

শুধু মাত্র ধর্মীয় ব্যানার ব্যবহার করেই এ নারকীয় হত্যাকান্ড ঘটিয়েছে পাকহানাদার বাহিনী। নারী থেকে শুরু করে শিশু কিংবা বৃদ্ধরাও সেদিন রেহাই পায়নি পাকসেনাদের কালো থাবা থেকে। ভাগ্যক্রমে বেঁচে যাওয়া অনেকে ভয়ে এখনো শিউরে উঠছে অবুঝ শিশুর মতো। সেই বিভৎস নির্যাতন চালানো হয়েছিলো তার বিবরন দিয়ে শেষ করার মত নয়। মুক্তিযোদ্ধা সন্দেহে তরুন যুবকদের ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালান হয়েছিলো। বেশ কিছু অঞ্চলে ব্যাপক হারে নারী নির্যাতনও হয়েছিল। বেদনাবাহী রক্তাক্ত সেই মর্মান্তিক ট্রাজেডির এতদিন পরে তার বেশ কিছু স্মৃতি বিবরন হারিয়ে গেছে। ১৯৭১ সালে পাকবাহিনীর এই অঞ্চলে আগমন ও যুদ্ধের সকল নিয়মনীতি ভংগ করে নারী ও শিশুদের নিয়ে রক্তের হোলি খেলা-মধ্যযুগের হিংস্র জলদস্যুদের কথাই স্মরন করিয়ে দেয়। তার পরেও যা আছে তা শুধু মানবিক ট্রাজেডি নয়, একটি জাতির জন্ম যন্ত্রনার মানুষের আর্তনাদ শুধু নয় সভ্যতা ও মানবতা বিরোধী  মানুষ রুপী পশুদের জঘন্য কর্মকান্ডের দলিল। যা এ অঞ্চলের মানুষ যতো দিন বেঁচে থাকবে যুগ-যুগান্তর ধরে এই মানবিক ট্রাজেডি দুঃসহ স্মৃতি হিসেবেই বেঁচে রবে।


প্রত্যক্ষদর্শী ও মুক্তিযোদ্ধাদের তথ্য অনুসারে বরিশাল অঞ্চলের বধ্যভূমির সম্ভাব্য তালিকার মধ্যে রয়েছে বরিশাল সদরের পানি উন্নয়ন র্বোড সংলগ্ন কীর্তনখোলা তীরে সরকারীভাবে স্তম্ভ র্নিমিত বধ্যভূমিতে (চিহ্নিত) গনহত্যা করা হয় ১ থেকে দেড় হাজার লোককে। তালতলী বধ্যভূমি বেসরকারীভাবে ফলক নির্মিত (চিহ্নিত) এখানে গনহত্যা করা হয় অর্ধশতাধিক ব্যক্তিকে। চরকাউয়া মোসলেম মিয়ার বাড়ি সংলগ্ন খালের পাড় বধ্যভূমিতে (অচিহ্নিত) গনহত্যা করা হয় ৩০/৪০ জনকে। বরিশাল নগরীর ১ নং সিএনবি পুল বধ্যভূমিতে (অচিহ্নিত) গনহত্যার শিকার হয়েছিলো ৮ থেকে ১০ জন ব্যক্তি।

গৌরনদীর বাটাজোর হরহর মৌজার মরার ভিটার বধ্যভূমিতে (অচিহ্নিত) গনহত্যা করা হয় ১৪০ থেকে ২০০ জনকে। গৌরনদীর পালরদী নদীর তীরে সহকারী পুলিশ সুপারের কার্যালয়ের সামনে বধ্যভূমিতে (অচিহ্নিত) গনহত্যা করা হয় ২ থেকে ৩ শতাধিক নিরিহ গ্রমবাসীকে। গৌরনদীর গয়নাঘাটা পুল ও পাশ্ববর্তী হাতেম পিয়নের বাড়ির সম্মুখের ঘাটলার বধ্যভূমিতে (চিহ্নিত) গনহত্যা করা হয় ৫ থেকে ৬’শ জনকে। আগৈলঝাড়ার কাঠিরা ব্যাপ্টিষ্ট চার্চ সংলগ্ন বধ্যভূমিতে বেসরকারী সংস্থা সিসিডিবির উদ্যোগে ফলক নির্মিত (চিহ্নিত) এখানে গনহত্যা করা হয় অর্ধশতাধিক গ্রামবাসী ও মুক্তিযোদ্ধাদের, রাংতার বিলের বধ্যভূমিতে (অচিহ্নিত) হত্যা করা হয় ৫ শতাধিক ব্যক্তিকে। ক্যাতনার বিলের বধ্যভূমিতে (অচিহ্নিত) গনহত্যা করা হয় ৬ থেকে ৭ শতাধিক ব্যক্তিকে। রাজিহারের ফ্রান্সিস হালদারের বাড়ির বধ্যভূমিতে ব্যক্তিগত ভাবে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মিত (চিহ্নিত) এখানে গনহত্যা করা হয় ১২জনকে। পতিহার গ্রামের বধ্যভূমিতে (অচিহ্নিত) গনহত্যা করা হয় ১৫ থেকে ২০ জনকে। দক্ষিন শিহিপাশা গ্রামের বধ্যভূমিতে (অচিহ্নিত) গনহত্যা করা হয় ২০ থেকে ৩০ জনকে।

বাকেরগঞ্জের কলসকাঠী বধ্যভূমি ব্যক্তিগতভাবে ফলক নির্মিত (চিহ্নিত) এখানে গনহত্যা করা হয় ৪ শতাধিক ব্যক্তিকে। বেবাজ বধ্যভূমিতে গনহত্যা করা হয় ২শতাধিক (অচিহ্নিত)। শ্যামপুর বধ্যভূমিতে গনহত্যা করা হয় ৩০ থেকে ৪০ জনকে (অচিহ্নিত)।

বানারীপাড়ার দক্ষিন গাভা নরের কাঠী বধ্যভূমিতে (অচিহ্নিত) গনহত্যা করা হয় ৭৫ থেকে ১ শত জনকে। গাভা বাজার বধ্যভূমিতে (অচিহ্নিত) গনহত্যা করা হয় ২৫ থেকে ৩০ জনকে। গাভা বিল্ববাড়ি বধ্যভূমিতে (অচিহ্নিত) গনহত্যা করা হয় ৫ থেকে ৭ জনকে। গাভা পূর্ববেড় মহল বাওনের হাট বধ্যভূমিতে (অচিহ্নিত) গনহত্যা করা হয় ২৫ থেকে ৪০ জনকে। গাভা রাম চন্দ্রপুরের পূর্ববের মহল (অচিহ্নিত) এখানে গনহত্যা করা হয় অর্ধশতাধিক ব্যক্তিকে।

বাবুগঞ্জের ক্যাডেট কলেজ বধ্যভূমিতে (অচিহ্নিত) গনহত্যা করা হয় অর্ধশতাধিক ব্যক্তিকে। উজিরপুরের বড়াকোঠা দরগাবাড়ি বধ্যভূমিতে (অচিহ্নিত) গনহত্যা করা হয় প্রায় শতাধিক গ্রামবাসিকে। উত্তরবড়াকোঠা মল্লিক বাড়ি বধ্যভূমিতে (অচিহ্নিত) গনহত্যা করা হয় ৮ থেকে ১০ জনকে। বড়াকোঠা মুক্তিযুদ্ধের মিলন কেন্দ্র সংলগ্ন বধ্যভূমিতে (অচিহ্নিত) গনহত্যা করা হয় অর্ধশত ব্যক্তিকে। খাটিয়ালপাড়া বধ্যভূমিতে (অচিহ্নিত) গনহত্যা করা হয় ১৫ থেকে ২০ জনকে। বড়াকোঠা চন্দ্র কান্ত হালদার বাড়ির বধ্যভূমিতে (অচিহ্নিত) গনহত্যা করা হয় ৫ থেকে ১০ জনকে। উজিরপুরের নারায়নপুর বধ্যভূমিতে (অচিহ্নিত) গনহত্যা করা হয় প্রায় অর্ধশতাধিক গ্রামবাসীকে। মুলাদীর পাতারচর গ্রাম বধ্যভূমিতে গনহত্যা করা হয় ৪০ থেকে ৫০ জনকে। মুলাদী নদীর দক্ষিন পাড় বেলতলা বধ্যভূমিতে গনহত্যা করা হয় ১০ থেকে ২০ জনকে। মেহেন্দিগঞ্জ থানা সংলগ্ন বধ্যভূমিতে  গনহত্যা করা হয় ২ থেকে ৩ শতাধিক ব্যক্তিকে। পাতারহাট গার্লস স্কুলের দক্ষিন পাড়ের খলিল মোল্লার বাড়ি সংলগ্ন বধ্যভূমিতে গনহত্যা করা হয় ১২ জন ঘুমন্ত মুক্তিযোদ্ধাকে। পাতারহাট গার্লস স্কুল সংলগ্ন ব্রীজ সংলগ্ন বধ্যভূমিতে গনহত্যা করা হয় শতাধিক গ্রামবাসীকে। ঝালকাঠী জেলার নলছিটি সুগন্ধা নদীর তীরের বধ্যভূমিতে গনহত্যা করা হয় ১৩ জনকে। নলছিটি মানপাশা ঋৃষি পাড়া বধ্যভূমিতে গনহত্যা করা হয় অর্ধশত গ্রামবাসিকে। স্বরূপকাঠি কুড়িয়ানা খালের বধ্যভূমিতে গনহত্যা করা হয় প্রায় ১ হাজার জনকে। কুড়িয়ানা জয়দেব হালদার বাড়ি বধ্যভূমিতে গনহত্যা করা হয় ৪ থেকে ৫ শতাধিক ব্যক্তিকে। পূর্বজলাবাড়ী খালপাড় বধ্যভূমিতে গনহত্যা করা হয় ১ থেকে ২ শতাধিক নারী-পুরুষকে। ১৯৭১ সালে বাবা ও ভাই হারানো শহিদ পরিবারের সদস্য মুক্তিযোদ্ধা সাংবাদিক তিমির দত্ত (ঢাকায় কর্মরত) জানান, জাতির প্রত্যাশা পুরনের চেয়ে গ্লানি বেশী। যে গ্লানি নিয়ে আজো আমরা লড়াই করে যাচ্ছি। কি বিচিত্র এ দেশ! যারা এদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছে, যারা এ দেশে স্বাধীনতা যুদ্ধে মা, বোনদের ইজ্জত লুন্ঠন করেছে, তারা বেঁচে গিয়ে বুড়ো আঙ্গুল দেখাল আমাদের। এ চিত্র কি আমার একার ! আমি বিচার চাই। একাত্তরের শহিদ বাবা ও ভাইয়ের হত্যাকারীর বিচার চাই। আমি অন্য কিছু চাই না । আমার বাবা ভাইসহ অসংখ্য শহিদ মুক্তিযোদ্ধার আত্মার শান্তির জন্য আমি বিচার চাই।

বরিশাল রিপোর্টাস ইউনিটির সভাপতি ও বরিশালে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে বজলুর রহমান ফাউন্ডেশন পুরস্কার প্রাপ্ত লেখক সুশান্ত ঘোষ বলেন, বরিশাল অঞ্চলে সরকারীভাবে চিহ্নিত বধ্যভূমির চেয়ে অচিহ্নিত বধ্য ভূমির সংখ্যাই বেশি। সরকারীভাবে সেগুলো চিহ্নিত করা উচিৎ। বধ্যভূমি সম্পর্কিত অনুসন্ধানী বেশ কয়েকটি প্রতিবেদন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে জমা দিয়েছি। তিনি আরো বলেন, সরকারের উচিৎ নতুন প্রজন্মের কাছে এ বধ্যভূমির ইতিহাস তুলে ধরা।

মুক্তিযুদ্ধকালীন ৯ নং সেক্টরের নৌ-কমান্ড সৈয়দ আবুল বাশার বলেন, কষ্ট লাগে স্বাধীনতার ৩৯ বছর পেরিয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত পাক হানাদার কর্তৃক নির্মম হত্যা যজ্ঞের ইতিহাস সঠিকভাবে নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরা হয়নি। তিনি আরো বলেন, এ অঞ্চলের সকল বধ্যভূমি সরকারীভাবে চিহ্নিত করে স্মৃতি স্তম্ভ তৈরির মাধ্যমে প্রকৃত ইতিহাস তুলে ধরা দরকার।

মুক্তিযোদ্ধা ও বরিশাল-১ আসনের সংসদ সদস্য এডভোকেট তালুকদার মোঃ ইউনুস জানান, বরিশাল তথা দেশবাসী মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষ শক্তিকে দেশ চালানোর দায়িত্ব দিয়েছেন। সরকার তার প্রতিশ্রতি মোতাবেক কাজ করে যাচ্ছে। তিনি আরো বলেন, মহাজোট সরকার দেশের সব কয়টি বধ্যভূমিকে প্রত্যক্ষদর্শী ও মুক্তিযোদ্ধাদের তথ্যের ভিত্তিতে চিহ্নিত করে স্মৃতি স্বম্ভ নির্মানের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

উল্লেখ্য, নলছিটি ঝালকাঠীতে, কুড়িয়ানা ও স্বরূপকাঠী পিরোজপুর জেলার হলেও এসব অঞ্চল ১৯৭১ সালে বরিশাল জেলার অন্তর্ভুক্ত ছিলো। সেই সাথে বরিশালের বহু মানুষ ওই সবস্থানে আশ্রয়ের জন্য এসে হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছিলো। বরিশালের মুক্তিযোদ্ধারা এ সকলস্থানে বসে যুদ্ধ পরিচালনা করেছিলো।